নীলক্ষেতে নীল হাতি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

স্কুল ছুটি হলেই নিলয় নিউমার্কেটেরে পাশ দিয়ে যায়। মানে নীলক্ষেত হয়ে শাহবাগের দিকে। আজও তাই। নিউমার্কেট ছেড়ে নীলক্ষেতের বাঁক ঘুরতেই চমকে গেল ও। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে একটা হাতি। বাপ রে! গাড়ি-ঘোড়ার ভিড়ে হঠাৎ হাতি এল কোথা থেকে! চট করে লুকিয়ে গেল নিলয়। দূর থেকে ফলো করতে লাগল হাতিটাকে। নিলয় কেন লুকিয়ে গেল জানো তো? এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাসটাই আগে বলি।

একদিন নিলয় নানুবাড়ি এলাকার বাজার থেকে ফিরছিল। সঙ্গে ছিল মামাতো ভাই হিমেল। সেবারও পথের বাঁক ঘুরেই দেখেছিল একটা হাতি। বিশাল বিশাল পা ফেলে হেঁটে আসছিল হাতিটা। হাতির পিঠে ছিল একটা ছেলে, যেন পুরোনো আমলের জমিদার! ছেলেটা নিলয়ের সমবয়সী হবে। পেছনে অনেকগুলো ছেলেপুলে। ওরা হইহই রইরই করে হাতির পিছু নিয়েছিল। একসময় মুখোমুখি হতেই হাতিটা ওদের পথ রোধ করে দাঁড়াল। ভয় পেয়ে হিমেল লুকাল নিলয়ের পেছনে। মাহুত ছেলেটা বলল,

 ‘হাতি সবার সাথি,

যদি তারে করো সম্মান

করবে মাতামাতি।

ওই বড় লোকের বেটা হাতিরে সম্মান কর।’

সম্মান করে সম্মানী দিতে হয়েছিল নিলয়কে। পকেটে ৫০ টাকার একটা নোট ছিল। হাতিকে তো আর ভাঙতি দেওয়ার কথা বলা যায় না। অতএব ওই পুরো টাকাই খোয়াতে হয়েছিল তাকে।

সে ঘটনা নিলয় ভোলেনি। এরপর অবশ্য দীর্ঘ দিন আর কোনো হাতির সঙ্গে ওর দেখা হয়নি। আজ আবার হাতির দেখা। আগের অভিজ্ঞতা যেহেতু খুব ভালো নয়, না লুকিয়ে উপায় আছে? আবার যদি চাঁদা দিতে হয়! কিন্তু এই হাতিটা ঢাকা শহরে ঢুকল কীভাবে? প্রশ্ন জাগে নিলয়ের মনে। তাও আবার এই ব্যস্ত নীলক্ষেতের মোড়ে।

নিলয় লুকিয়ে লুকিয়ে ফলো করতে করতে দেখল, হাতিটা নীল রঙের। নীল রঙের হাতি আছে কি না, ওর জানা নেই। তবে হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে নীল হাতির একটা গল্প পড়েছিল ও। সেটা মনে পড়তেই হাতিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল ও। হাতিটা ঠিক ওই বইয়ের নীলুর হাতির মতোই। গলায় ঘণ্টাও আছে। বইয়ের নীলুর হাতিটা ছিল খেলনা হাতি। যেটা ওর মামা আমেরিকা থেকে পাঠিয়েছিল। চাবি ঘুরলেই সেটা চলত। কিন্তু নীলক্ষেতের হাতিটা জ্যান্ত। কৌতূহলটা ধীরে ধীরে এতই বাড়তে লাগল যে নিলয় আর লুকিয়ে থাকতে পারল না। পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল। এমন সময় দেখল নীল হাতিটাকে এক দোকানদার ১০০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিচ্ছে। শুঁড় দিয়ে হাতিটা নোটটা নিজের দিকে টেনে নিল, পরক্ষণেই ছুড়ে ফেলল দোকানদারের গায়ে। সর্বনাশ! নিলয় বুঝল, এই হাতিটা ১০০ টাকায়ও সন্তুষ্ট নয়।

একটু পর যা দেখল তা কল্পনাতীত। হাতিটা নীলক্ষেতের বইয়ের দোকান ঘুরে ঘুরে বই উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। মাঝেমধ্যে এক-দুইটা বই শুঁড় দিয়ে ধরে ওপর দিকে চালান করে দিতে লাগল। ঠিক সেই মুহূর্তে নিলয় দেখল হাতির পিঠে ওরই সমবয়সী একটা ছেলে বসে আছে। সে হাতির কাছ থেকে বই নিয়ে দেখছে আর নিচে ফেলে দিচ্ছে।

নিলয় ছেলেটাকে ভালো করে দেখল। গায়ে নীল শার্ট। পরনে নীল প্যান্টও আছে। বইগুলো নিচে ফেলা দেখে মনে হলো, ছেলেটা বইগুলো পছন্দ করছে না। এরই মধ্যে একটা বই দেখে ছেলেটার চোখ চকচক করে উঠল। মুখ খুশিতে ভরে উঠল। নিলয় বইয়ের নামটা দেখার চেষ্টা করল। বইটাতে হাতির ছবি আঁকা। বইটার নাম, ‘হাতি দিল দৌড়’। আগ্রহ নিয়ে বইটা উল্টেপাল্টে দেখছিল ছেলেটা। ওর সঙ্গে কথা বলার খুব ইচ্ছা হলো নিলয়ের। চিৎকার করে সে বলল, ‘এই যে, তোমার নাম কী?’

ছেলেটা কোনো জবাব দিল না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। বইটা হাতির পিঠে কোনো এক জায়গায় রেখে, দুই হাত বুকের মধ্যে রেখে আবার দুই দিকে মেলে দিল। এবার একটা আঙুল মুখে ঠেকিয়ে থেমে গেল। নিলয় এই ইঙ্গিতের কিছুই বুঝল না। ছেলেটা মনে হয় বুঝতে পেরেছে যে নিলয় ওর কথা বুঝতে পারছে না। সে জন্য ঠিক যেখানে বইটা রেখেছিল, সেখান থেকে একটা সাদা কাগজ আর কলম বের করল। কলম দিয়ে ঘষ ঘষ করে কী যেন লিখল। লেখা শেষ হতেই কাগজ দেখাল। সেটাতে লেখা, ‘আমার নাম নীরব। আমি শুনতে পারি। লিখতে পারি। পড়তে পারি। কিন্তু বলতে পারি না।’

নিলয় কাগজটা পড়ে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি বই খুব পছন্দ করো?’

ছেলেটা লিখল, ‘হু। বই পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। আমার নীল হাতিটাও আমার কাছে গল্প শুনতে পছন্দ করে।’

নীল হাতি এবার আরেকটা বই তুলেছে। বইয়ের নাম হাতির লড়াই। বইটা পেয়ে ছেলেটা আবার বই উল্টাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। নিলয় বুঝল, হাতিবিষয়ক বই ছেলেটার খুব পছন্দ। সে অন্য একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে একটা হাতির বই কিনল। নাম ব্যায়ামবীর হাতি। বইটা নিয়ে নিলয় হাতির সামনে গেল। বইটা ধরল হাতির সামনে। নীল হাতি ওর শুঁড় দিয়ে বইটা পেঁচিয়ে নিয়ে ওপরে চালান করে দিল। ছেলেটা বইটা পেয়ে ভীষণ খুশি হলো।

থপ থপ শব্দ তুলে হাতিটা হারিয়ে গেল শাহবাগের দিকে। নিলয়ও পিছু পিছু হাঁটতে লাগল।