বুদ্ধিমতী তিতিয়া
শীতের সকালবেলা। ঝাঁক ধরে গাঙশালিক নদীর পাড়ে বসে আছে। শালিকদের মন খারাপ।
নদীর ওপর দিয়ে শীতের বাতাস বয়ে যাচ্ছে। নদীতে তিরতিরে ঢেউ। ঝলমলে রোদ উঠেছে। রোদের আলোয় নদীর তিরতিরে ঢেউ ঝিকমিক করছে। শালিকের কয়েকটা ছানা বালুর ভেতর ডানা নাড়িয়ে বালু-স্নান করছে। তিতিয়া গিয়েছিল পাশের মাঠে। সেখানে লম্বা সবুজ ঘাসে জমে আছে শিশির। তিতিয়া শিশিরে ডানা ঝাপটে মজা করে শিশির-স্নান করে এসেছে।
তিতিয়া এক ছোট গাঙশালিক। তার গায়ের রং নীলচে ধূসর। ডানার ধার ঘেঁষে কালো দাগ আর সাদাভাব। লেজের আগা কালো। লেজের মাথায় গোলাপি-সাদা ছোপ। গোলাপি-হলুদ পা। ঘন-কমলা রঙের চোখের পাশে কমলা ঠোঁটটা যে কী সুন্দর দেখায়! ঠোঁটের গোড়ায় আবার কপালমুখো ঝুঁটি।
স্নান সেরে এসে তিতিয়া দেখে সবাই মন খারাপ করে আছে। কেউ কথা বলছে না। তিতিয়া বলল, ‘কী হয়েছে তোমাদের, মন খারাপ কেন?’
তিতিয়ার গলার স্বর ভীষণ মিষ্টি আর মোলায়েম। কথা বললে মনে হয় যেন গলার ভেতর জলতরঙ্গ বাজছে। তিতিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে ডান-বামে তাকাল। এক মা-শালিক কেঁদে কেঁদে বলল, ‘দাঁড়াশ সাপ আমার দুটো ছানা ধরে খেয়ে ফেলেছে।’
বুড়ো শালিক ঘাড় কাত করে বলল, ‘সাপ আমাদের কচি ছানা খেয়ে ফেলে। শিয়াল, খাটাশ, বনবিড়ালরা ওত পেতে থাকে। আমাদের ধরে খায়। বাজপাখি আর ইগলের চোখ থেকে ডিম আর ছানাপোনাকে বাঁচাই কেমন করে?’
তিতিয়া বলল, ‘কেঁদেকেটে কিছু হবে না। মন শক্ত করো। বিপদে মন শক্ত করতে হয়। সাহস রাখতে হয় মনে। কখনো হতাশ হবে না।’
তিতিয়াকে সবাই বুদ্ধিমতী গাঙশালিক বলে জানে। খাওয়ার জন্য কোথায় পোকামাকড় বেশি পাওয়া যায়, কোন ফল কখন পাকে সব জানে তিতিয়া। সে সবাইকে শিখিয়ে দিয়েছে। তিতিয়া বলল, ‘বুদ্ধি পাওয়া গেছে।’
বুড়ো শালিক বলল, ‘কী বুদ্ধি?’
মা শালিক বলল, ‘কী বুদ্ধি?’
বাবা শালিক বলল, ‘কী বুদ্ধি?’
তিতিয়া বলল, ‘নদীর খাড়া পাড়ে গর্ত খুঁড়ে বাসা বানাব আমরা। সেখানে শিয়াল-খাটাশ-বনবিড়াল যেতে পারবে না। যেতে গেলেই পিছলে পড়বে। বাজ-ইগলরা আমাদের ডিম-ছানার নাগাল পাবে না। বর্ষার দিনে বৃষ্টির পানি খাড়া পাড় বেয়ে নামার সময় গর্তের ভেতর ঢুকতে পারবে না।’
তিতিয়ার বুদ্ধি সবার পছন্দ হয়েছে। নদীর খাড়া পাড়ে তারা মাটি দেখে বুঝে মাপজোখ করতে লাগল। বাসা বানাবে।
কয়েক দিন পর দেখা গেল অদ্ভুত ঘটনা। নদীর খাড়া পাড়ের দেয়ালে পাশাপাশি কয়েকটি গাঙশালিকের বাসা। নিজেরাই গর্ত খুঁড়ে সুড়ঙ্গ-বাসা বানিয়ে ফেলেছে।
নিজের বানানো বাসায় ডিম পেড়েছিল গাঙশালিক। সেই ডিম ফুটে ছানা বেরিয়েছে।
দাঁড়াশ সাপ এসেছে গাঙশালিকের ছানা খেতে। সে কয়েক দিন এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে গাঙশালিকের বাসা খুঁজে পায়নি। আজ খুঁজে পেয়েছে। ইয়া বড় সাপ। সাত ফুট লম্বা।
দাঁড়াশ সাপ নদীপাড়ের কিনারা ধরে এগিয়ে এসেছে। সে গাঙশালিকের বাসার নিচে শুয়ে আছে। কয়েকবার খাড়া পাড়-দেয়াল বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করেছে। পারেনি। বারবার গড়িয়ে পড়ে গেছে। আবার উঠবে। তার মনে হচ্ছে একবার বাসার ভেতরে মাথা ঢোকাতে পারলেই ব্যাস! সেখানে শালিকের নরম তুলতুলে ছানা। গাপুস করে খেয়ে নেবে।
সহজে গাঙশালিকের ছানা ধরা যায় না। খাড়া দেয়াল। বাসার মুখ ছোট। ভেতরে অনেকখানি গর্ত। একটু ডানে নাহয় বামে ছানাপোনার ঘর। বিশেষ বুদ্ধি করে বানানো হয়েছে বাসা।
দাঁড়াশ সাপ খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করেছে। সে এবার পড়ে যায়নি। ওপরে উঠে পড়েছে। চোখের সামনে গাঙশালিকের বাসার ছোট মুখটা চকচক করছে। সাপ অতি ধীরে বাসার ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দিল। বাসায় শালিকের ছয়টি ছোট ছানা আছে। তাদের একটা বা দুটোকে ধরতে পারলেই হবে।
তিতিয়া উড়ে এসেছে। সে নদীর ওপর উড়ে উড়ে খেলা করছিল। ঘটনা দেখে চমকে উঠেছে তিতিয়া। মাথাসহ দাঁড়াশ সাপ শরীর ঢুকিয়ে দিয়েছে শালিকের বাসায়। আশপাশে কোনো শালিক নেই। মা-বাবারা গেছে দলবেঁধে ছানাদের জন্য খাবার খুঁজতে। একটা চিল উড়ছে আকাশে।
তিতিয়া ডানা দিয়ে বাতাস কেটে দ্রুত ছুটে এল। গর্ত থেকে নিচের দিকে ঝুলে আছে সাপের লম্বা শরীর। ছানাদের জন্য খাবার নিয়ে ফিরে এসেছে শালিকেরা। তারা দেখল দাঁড়াশ সাপ গর্তে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে। কী করবে বুঝতে পারল না। হতভম্ব হয়ে গেছে সকলে। শালিকেরা শোরগোল আরম্ভ করল।
দেরি করল না তিতিয়া। সে জানে কী করতে হবে। উড়ে গেল দাঁড়াশ সাপের কাছে। ঠোকর মারল সাপের গায়ে। নখ দিয়ে খামচে ধরে আঁচড়ে দিল সাপের পিঠ।
ঘাবড়ে গেছে সাপ। গর্ত থেকে মাথা বের করতেই ঝপাৎ করে পড়ে গেল নিচে। সবগুলো শালিক তখন একসঙ্গে ঘিরে ধরল দাঁড়াশ সাপকে। ঠুকরে-আঁচড়ে তাকে কাহিল করে দিল।
শাঁ-শাঁ করে নেমে এল চিল। খামচে ধরল সাপের শরীর। ছোবল দিয়ে নিয়ে উড়ে গেল দূরে।
গাঙশালিকেরা এখন নদীর খাড়া পাড়ের দেয়ালে বাসা বানায়। তারা অঙ্ক জানে, জ্যামিতি জানে আবার মাটিও চেনে। মা পাখি আর বাবা পাখি পালা করে ডিমে তা দেয়, খাবার খুঁজতে যায়। দলবেঁধে থাকে তারা।
নদীর পাড়ে গিয়ে ‘তিতিয়া’ বলে ডাকলে উড়ে আসে একঝাঁক গাঙশালিক।