বনিজুলকে মনে থাকবে

বনিজুল হক  (২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৮—২৫ জুলাই ২০১৮)
বনিজুল হক (২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৮—২৫ জুলাই ২০১৮)

চিত্রশিল্পী বনিজুল হক চলে গেল একেবারেই নীরবে, একেবারেই নিভৃতে। পত্রিকার পাতায় বা টেলিভিশনের খবরে কোথাও ছোট্ট কোনো মৃত্যুসংবাদও আমি অন্তত দেখিনি। বনিজ বছর দশেক আগেই দৃশ্যকলার জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। আমি ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা কলেজে পড়তে আসি চট্টগ্রাম থেকে। বিপরীত প্রান্তের গাইবান্ধা থেকে পরের বছর এল বনিজুল হক। পরের ক্লাসের অনেক ছাত্রের সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায়, কারণ তাদের মধ্যে ছিল এক দঙ্গল খুব প্রাণবন্ত, প্রতিশ্রুতিশীল ও উৎসাহী ছেলে। প্রয়াত হাসি চক্রবর্তী, প্রয়াত হাসান হাবিব, মনসুর-উল করিম, চন্দ্রশেখর দে, আসেম আনসারী আর বনিজুল হক ছিল এদের অন্যতম। এদের অনেকেই হোস্টেলে থাকার কারণে হয়ে পড়েছিল আমার নিত্যদিনের সাথি।

আর্ট কলেজের হোস্টেল ছিল নিত্য-আনন্দের এক কারখানা। আর নতুন নতুন দুষ্টুমির নিছক আনন্দের উদ্ভাবনে এর বাসিন্দারা ছিল সবচেয়ে পারদর্শী। শেষ বর্ষে আমি ছিলাম হোস্টেলের মনিটর, হোস্টেল সুপারের কাছে এদের নানান অকাজের জবাবদিহি করতে করতে নিয়মিত গলদঘর্ম হতাম আমি। পাস করার পর সদ্য প্রসূত বাংলাদেশে নানান স্বপ্ন নিয়ে আমি ঢাকায় থেকে গেলাম। এর আগেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চারুকলায় প্রথমœস্নাতকোত্তর ডিগ্রি কোর্স। ঢাকা থেকে অনেকেই এসে ভর্তি হয়েছে, বনিজরা দল ধরে (হাসান হাবিব ও আসেম আনসারী বাদে) চলে এল চট্টগ্রামে। এর পরে অলক রায়, কে এম এ কাইয়ূম, নাজলী লায়লা—এরা এল। চন্দ্রশেখর ছাড়া আর সবাই অন্য জেলার, থাকার জায়গা নেই, পকেটে কানাকড়ি নেই। আছে শুধু শিল্পী হওয়ার দুর্দম স্বপ্ন। ১৯৭৪-এ আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে আবার এদের সঙ্গে একত্র হলাম।

এর মধ্যে ১৯৭৩-এ চট্টগ্রাম শহরে বেসরকারিভাবে স্থাপিত হয়েছে চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ। এরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি কলেজটিতে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দিল। ব্যতিক্রমী বনিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কথা ভুলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কলেজটি গড়ে তোলার কাজে। বেতনের ঠিক নেই, কলেজের আসবাব নেই, ক্লাস নেওয়ার পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ সবিহ-উল আলম তাঁর সব শ্রম, অবসর ঢেলে দিয়েও পাহাড়প্রমাণ সমস্যা সমাধানে হিমশিম খাচ্ছেন। এই সময় বনিজ এসে তাঁর পাশে দাঁড়াল। সারা দিন কলেজে পড়ে থাকত, ছাত্রদের হাতে ধরে শেখাত, খাওয়া বা বিশ্রামের সময় তার নেই। আমিও কলেজে খণ্ডকালীন পড়াতাম, দেখতাম প্রখর রোদের মধ্যে বনিজ ছাত্রদের নিয়ে কঠিন মাটি কুপিয়ে বাগান তৈরি করছে, নিজেও হাত লাগাচ্ছে। দেখতে দেখতে ফুলে-পাতায় পল্লবিত হয়ে উঠল চারুকলা কলেজের বিরান প্রাঙ্গণ। বনিজের খাওয়ার পয়সা নেই, বাড়ি ভাড়া দিতে পারে না, কলেজই তার প্রাণ। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, অভাবের কথা নেই, দাড়ি-গোঁফের আড়ালে মৃদু হাসি আজও চোখে ভাসে। এসবের ভেতরেও ছবি আঁকার চেষ্টা চালাচ্ছে, একটা নিজস্ব চেহারাও দাঁড় করিয়েছে। কণ্টকশয্যায়ও প্রেম আসে, অসুস্থ বনিজের সেবায় এগিয়ে এল প্রতিবেশী এক মেয়ে। তারপর প্রেম ও বিবাহ। আমরা চাঁদাটাদা তুলে হই হই করতে করতে গেলাম সে বিয়েতে। এখানেও বনিজ স্বভাবসুলভ, কনেপক্ষের একজন আমাদের কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্য করাতে সে গর্জে উঠল, বরের আসন ছেড়ে উঠে গেল, যেখানে বন্ধুদের অপমান সেখানে সে বিয়ে করবে না। তাকে অনেক বুঝিয়ে আমরা সমাধা করলাম বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা।

বনিজুল হকের চিত্রকর্ম ‘ভালোবাসা–১’
বনিজুল হকের চিত্রকর্ম ‘ভালোবাসা–১’


মাঝখানে আমি উচ্চতর পড়াশোনার জন্য দুই বছর ভারতে ছিলাম। ফিরে এসে জানলাম, বনিজ চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে গেছে রাজশাহীতে। সেখানে লেগে পড়েছে দেশের দ্বিতীয় বেসরকারি চারুকলা কলেজ স্থাপনের কাজে। চট্টগ্রামে সে ছিল অধ্যক্ষের সহযোগী, রাজশাহীতে সে-ই কান্ডারি—প্রকল্প পরিচালক এবং পরে অধ্যক্ষ। রাজশাহীতে গিয়ে দেখলাম এখানেও বনিজুল হক সব কাজের কাজি, তার শ্রম আর সময় দিয়ে গড়ে তুলল রাজশাহীর কলেজটিকে। এখানেও অভাবের সংসার, কিন্তু মুখে স্মিত হাসি আর নেই কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ বা অভিমান। তবে বনিজের ভেতরে বোধ হয় বাস করত কোনো চিরবিবাগি, স্বভাবের গভীরে ছিল বাউন্ডুলে ভাব। চট্টগ্রাম ও রাজশাহী, দুই জায়গাতেই তার বিরাট কীর্তি তাকে আটকে রাখতে পারল না। তার ভালোবাসার শিল্পের জগৎ ছেড়ে চলে গেল ব্যবসার জগতে। ঢাকায় দৃশ্যকলার কর্মকাণ্ডে তাকে আর দেখিনি। শুনেছি ঢাকা চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রথম দিকে, যখন তহবিলের সংকট ছিল প্রবল, একটি প্রস্তুতি সভায় উপস্থিত শিল্পীরা যখন এক শ থেকে পাঁচ শ টাকা চাঁদার অঙ্গীকার করছিলেন, তখন বনিজ পকেট থেকে চেকবই বের করে ১০ হাজার টাকার চেক লিখে দিয়েছিল যাতে প্রায় পুরো খরচেরই সুরাহা হয়ে যায়। হয়তো ব্যবসায় জড়িয়ে তখন তার হাতে কিছু পয়সা ছিল, তবে আমি নিশ্চিত, অ্যাকাউন্টের প্রায় পুরো টাকাটাই সে দিয়ে দিয়েছিল। এমনই ছিল বনিজুল। যখন ছবির জগৎ থেকে বিদায় নিল তখন একেবারেই নিজের নাম যেন মুছে দিয়ে গেল। অসুস্থতার খবর পেয়ে ফোন করে দেখেছি কথা বলতে অনাগ্রহী সে। তবে কোনো স্বীকৃতিই বনিজুল পায়নি এমন নয়। ১৯৭৯ সালে ভারতের নয়াদিল্লিতে দক্ষিণ এশীয় সাংস্কৃতিক উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে যায় বনিজুল আর শিল্পকলা একাডেমির তরুণ শিল্পীদের একক প্রদর্শনী কর্মসূচির অধীনে ২০০২ সালে বনিজুলের একক চিত্রপ্রদর্শনী হয়। জীবনের শেষের দিকে কিছু সম্মান বনিজুল পেয়েছিল। একেবারে সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগ থেকে সংবর্ধনা আর গাইবান্ধা শিল্পকলা একাডেমি ও বর্ষবরণ ও বৈশাখী মেলা উদ্‌যাপন কমিটি দিয়েছে সম্মাননা। নিশ্চয় খুশি হয়েছিল বনিজুল। তবে এসবের তোয়াক্কা সে কোনো দিন করেনি।

একটি মানুষ, সুদূর গাইবান্ধার একটি নিভৃত গ্রাম থেকে শুধু শিল্পকলার জগতে নিজেকে শামিল করার আকুল স্বপ্নে আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে একটির পর একটি অচেনা ভুবনে ঘুরে ঘুরে—বলতে গেলে শূন্য হাতে চলে গেল আরেক অচেনা জগতে। নিজের জন্য অর্থবিত্ত, আশ্রয়, পদক-পুরস্কার, প্রতিষ্ঠা কিছুই চায়নি বনিজুল, যখন যেমন তখন তেমনই সন্তুষ্ট থাকার অসীম ও দুর্লভ শক্তি ছিল তার ভেতরে। তার প্রয়াণে আমাদের দৃশ্যকলা জগতে কোনো দোলা লাগেনি। এই মোহমুক্ত মানসের মানুষটিও হয়তো এই বিস্মৃতিই চেয়েছিল। আমরা যারা তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, আজ দূর থেকে শুধু বলতে পারি, বনিজুল, তুমি আমাদের স্মৃতিপটে শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় বিরাজ করবে।