দুধওয়ালা

যেদিন কেউ একজন আমার বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে আমাকে বিড়াল বলে ডাকল আর গুলি করার হুমকি দিল, সেই দিনই মারা গিয়েছিল দুধওয়ালা। রাষ্ট্রীয় অস্ত্রধারীদের মধ্যে কেউ তাকে মেরেছিল আর আমি এই লোকের মরা নিয়ে মোটেই বিচলিত হইনি। অনেকে যদিও হচ্ছিল—এমন অনেকে, যারা আমাকে ‘দেখে চেনে কিন্তু কথা বলে না’, তারাই নানা কথা বলছিল আমাকে নিয়েও; কেননা, একটা গুজব চালু ছিল, মূলত বড় দুলাভাই গুজবটি চালু করেছিল যে আমার একটা প্রেম চলছে লোকটার সঙ্গে আর আমার বয়স আঠারো আর তার একচল্লিশ। আমি তার বয়স জানতাম, এ জন্য না যে তার খুন হওয়ার খবর মিডিয়ায় এসেছে, বরং এ জন্য যে ঘটনার বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই এই কথাবার্তাগুলো চলছিল, এই আঠারো আর একচল্লিশের—তেইশ বছরের ফারাকের জঘন্য কথাগুলো, লোকটা যে বিবাহিত আর আমি যে নীরব দর্শকদের বোকা বানাতে পারছি না, এসব। মনে হয় আমারও দোষ ছিল এই প্রেমের ব্যাপারটায়। আমার কিন্তু দুধওয়ালার সঙ্গে কোনো প্রেম চলছিল না। আমি তাকে পছন্দও করতাম না, বরং খুব দ্বিধা আর ভয়ে ছিলাম তার দিক থেকে এই প্রেমের চেষ্টা আর পীড়াপীড়িতে।

আমি বড় দুলাভাইকেও পছন্দ করতাম না। সে অবধারিতভাবে অন্যের যৌনজীবন সম্বন্ধে গল্প বানাত—আমারটা সম্বন্ধেও। যখন আমি ছোট ছিলাম—বারো বছরের—সে প্রথম এল বড় আপার বহুদিনের প্রেমিকের ধোঁকাবাজির কারণে এবং বিচ্ছেদ-পরবর্তী সান্ত্বনা হিসেবে, এসেই তাকে গর্ভবতী করল আর দুজনে তক্ষুনি সেরে ফেলল বিয়েটাও। প্রথম দিন থেকেই সে আমার সম্বন্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করতে শুরু করল। সে যেসব যৌনগন্ধি শব্দ ব্যবহার করত, সেগুলো আমি বুঝতাম না। এটা সে জানত, এ-ও জানত যে আমি অন্তত এটুকু বুঝি যে ওগুলো রগরগে। এ ব্যাপারটাই তাকে সুখ দিত। তার তখন পঁয়তিরিশ চলছে আর আমার বারো। বয়সের ফারাক সেই তেইশ বছরের।

তো সে নানা মন্তব্য করত আর আমি কিছুই বলতাম না। কারণ, আমি বুঝতে পারতাম না ওর সঙ্গে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখনো উচিত। আপা ঘরে থাকলে সে কখনো এসব বলত না। সব সময়—যেই আপা বাইরে গেল, একটা সুইচ যেন চালু হয়ে যেত তার মধ্যে। একটাই ভালো ব্যাপার যে তার দিক থেকে শারীরিক কোনো ক্ষতির ভয় ছিল না। ওই সময়ে, ওই জায়গায়, লোকজনকে মূল্যায়নের প্রধান মাপকাঠিই ছিল কে কতটা আক্রমণাত্মক সেটা। আর আমি প্রথমেই বুঝেছিলাম সে তেমন নয়। তারপরও, তার এই রাক্ষুসে স্বভাবে আমি শক্ত হয়ে যেতাম। সে ছিল একটা নোংরা বস্তু আর আমার বোন ছিল বিচ্ছিরি অবস্থায়—গর্ভিণী, দীর্ঘমেয়াদি পূর্ব প্রেমিকের বিরহে কাতর, বিশ্বাস করতেও পারছিল না সেই প্রেমিক কী করেছে। আর এই বয়স্ক লোকটা, যাকে সে বিয়ে করেছে, তাকে মেনে নিতেও পারছিল না, সে তার তুলনায় অনেক কমবয়সী আর প্রচণ্ড অসুখী, ভীষণ রকম প্রেমকাতর—কেবল এই লোকের সঙ্গে নয়। আমি আপাকে দেখতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম, যদিও খুব বিমর্ষ হয়ে থাকত ও, যেতাম না, কারণ, আমি দুলাভাইয়ের কথা আর মুখভঙ্গি সহ্য করতেই পারছিলাম না আর। ছয় বছরের মধ্যে—যখন সে এগুলো আমার আর আমার বাকি বড় বোনদের সঙ্গে চেষ্টা করেই যাচ্ছিল—সরাসরি, ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে, ভদ্রভাবে, কুৎসিতভাবে—আমরা তিনজনও তাকে এড়িয়ে চলছিলাম, এমন সময় আরও ভীতিকর আরও বিপজ্জনক এবং অযাচিতভাবে কোত্থেকে যেন হাজির হলো দুধওয়ালা।

আমি জানতাম না সে কাদের দুধওয়ালা। আমাদের তো নয়। আমার মনে হয় কারোরই নয়। সে দুধের অর্ডার নিত না। দুধের সঙ্গে তার কোনো সম্বন্ধ ছিল না। এমনকি সে দুধ পৌঁছে দিত না, দুধের ট্রাকও চালাত না। সে চালাত গাড়ি, অনেকগুলো ঝাঁ-চকচকে গাড়ি, যদিও তার নিজের মধ্যে তেমন চাকচিক্য ছিল না। আমি প্রথম তাকে লক্ষ করি, যখন সে তার গাড়িগুলো নিয়ে আমার সামনে আসতে শুরু করল।

একদিন সে হাজির হলো তার একটা গাড়িতে। আমি তখন হাঁটতে হাঁটতে আইভানহো পড়ছি। আমি প্রায়ই হাঁটতে হাঁটতে বই পড়ি। আমার কাছে এটা কোনো সমস্যা মনে হয় না। তবে আমার বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে এই হাঁটতে হাঁটতে পড়ার ব্যাপারটা উল্লেখ করা হতো প্রায়ই।

‘তুমি অমুক মেয়েদের একজন না? তমুক তোমার বাবা না? তোমার ভাই এই–সেই হ্যানো-ত্যানো দলে খেলত না? গাড়িতে ওঠো, লিফট দিই তোমাকে।’

কথাটা এমনি এমনিই বলা, প্যাসেঞ্জার-দরজা তখন প্রায় খুলে গেছে। আমি পড়তে থাকা অবস্থায় চমকে গেলাম। গাড়িটা আসার শব্দ পাইনি, আগে কখনো দেখিওনি এর চালককে। সে ঝুঁকে বেরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, সহৃদয় হাসি আর বেশ একটা বাধিত হওয়ার ভঙ্গি নিয়ে। কিন্তু এখন, এই আঠারো বছরে, ‘সহৃদয় হাসি আর বাধিত ভাব’ আমাকে খুব সতর্ক করে দেয়।

আমি অবশ্যই লিফট নিতে চাইছিলাম না। এমনিতেই হাঁটতে ভালোবাসি আমি—হাঁটতে হাঁটতে পড়া, হাঁটতে হাঁটতে ভাবা, আর বিশেষ কোনো কথা বলা। আমি চাইছিলামই না এই লোকের সঙ্গে গাড়িতে উঠতে, যদিও বুঝতে পারছিলাম না কী করে এটা বলা যায়; যেহেতু সে অভদ্র ও রূঢ় আচরণ করেনি, আর আমার পরিবারের অনেককেই চেনে, পুরুষ সদস্যদের ঠিকুজিও বলে ফেলল, আমি রূঢ় হতে পারছিলাম না। তাই আমি ইতস্তত করলাম, আড়ষ্ট হয়ে গেলাম, যেটা খানিক অভদ্র দেখাল।

আমি হাঁটছি। বললাম আমি।

পড়ছি। বলে বইটা তুলে ধরলাম, যেন আইভানহো বুঝিয়ে দেবে হাঁটাটা, হাঁটার দরকারটা।

তুমি গাড়িতেও পড়তে পারবে। আমার মনে নেই এ কথার জবাবে কী বলেছিলাম। শেষতক সে হেসে বলল, ঠিক আছে, সমস্যা নেই, পড়ো। আর গাড়ির দরজা আটকে চলে গেল।

প্রথমবারের ঘটনা এটুকুই। গুজব তখনই শুরু হয়ে গেল। বড় আপা দেখা করতে এল। কারণ, আমার বর্তমানে একচল্লিশ বছর বয়সী দুলাভাই তাকে পাঠিয়েছে। সে আমাকে বকা দেবে আর সাবধান করবে। সে বলল, আমাকে নাকি এই লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে।

ধ্যাত্তেরি, আমি বললাম, ‘দেখা গেছে’ মানে কী? কে দেখেছে? তোমার জামাই?

আমার কথাটা তো আগে শোন। সে বলল। কিন্তু আমি শুনলাম না, দুলাভাই আর তার দুমুখো চেহারা এবং আপার জামাইয়ের সঙ্গে তাল মেলানোর কারণে।

নিজের অজান্তেই আমি আপাকে দোষারোপ করতে থাকলাম। দুলাভাইয়ের এত দিন ধরে করা বাজে মন্তব্যের জন্য, আর অজান্তেই দোষ দিতে থাকলাম এই লোকটাকে বিয়ে করার জন্য, যাকে সে ভালোবাসেনি এবং সম্ভবত কখনোই শ্রদ্ধা করতেও পারবে না। কারণ, লোকটার এই সব চালবাজির কথা সে নিশ্চয়ই জানে, জানবে নাই-বা কেন।

আপা আমাকে বুঝিয়ে থামানোর চেষ্টা করেই গেল। বলতে থাকল যে সব ব্যাটাছেলের সঙ্গে এভাবে মেশা আমার নিজের জন্যই ভালো হচ্ছে না। রাগে আমার পিত্তি জ্বলে গেল আর আমি শাপশাপান্ত করতে লাগলাম। কারণ, তাকে ঘর থেকে বের করার উপায় ওই একটাই। আমি এরপর জানালা দিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকলাম ওই ভিতুটার যদি কিছু বলারই থাকে, তাহলে ও যেন নিজে আমার সামনে এসে বলে। কাজটা ভুল হয়েছে, এই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়াটা, আবেগ প্রকাশ করে ফেলাটা, জানালা দিয়ে চেঁচানো, রাস্তায় রাগ দেখিয়ে ফেলা আর কাণ্ডজ্ঞান হারানো। সাধারণত আমি অমন করি না। কিন্তু আমি রেগে গিয়েছিলাম, প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল, আপার এই পুতুপুতু বউগিরি আর জামাইয়ের কথায় ওঠ-বস দেখে; আর রাগ হচ্ছিল দুলাভাইয়ের ওপরও—তার নিজের নোংরামি আমার ওপর চাপানোর চেষ্টা দেখে।

নিজের জেদও টের পাচ্ছিলাম আমি, ‘নিজের চরকায় তেল দাও’ ধরনের চিন্তা আসছিল শুধু। দুর্ভাগ্যজনক হলো, যখনই এমন কিছু হয়, আমি উল্টোটা করি, আগের অভিজ্ঞতা থেকে আর কিছু শিখতে পারি না। তাই দুধওয়ালা আর আমাকে নিয়ে ছড়ানো গুজব আমি একেবারে আমলে না নিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। পরের ব্যাপারে নাক গলানো এই এলাকার লোকজনের বরাবরের অভ্যাস। কানাঘুষাগুলো আসে-যায়, ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তী শিকার খুঁজে বের করে। কাজেই আমি এই দুধওয়ালার সঙ্গে প্রেমের গুজবটাকে একদম পাত্তা দিইনি। তখন সে আবার উদয় হলো—এবার আমার পার্কে দৌড়ানোর সময়।

আমি ছিলাম একা, আর এবার পড়ছিলাম না, দৌড়ানোর সময় আমি পড়ি না। এমন সময় সে হাজির, কে জানে কোত্থেকে, আর আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে থাকল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল আমরা দুজন একসঙ্গে দৌড়াচ্ছি আর আমরা যেন সব সময়ই একসঙ্গে দৌড়াই; আমি আবার চমকে গেলাম, শুধু শেষবার বাদে এই লোকের সঙ্গে প্রতি সাক্ষাতেই যেমন চমকে গেছি। প্রথমে সে কোনো কথা বলল না, আর আমি পারলাম না কিছু বলতে। তারপর সে মাঝখান থেকে এমনভাবে আলাপ শুরু করল যেন আমরা আলাপের মধ্যেই ছিলাম। আমার দৌড়ের গতির কারণে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে আমার কাজের ব্যাপারে সংক্ষেপে কিছু বলছিল সে। সে জানত আমি কী করি—কোথায়, আমার কাজটা কী, কখন যাই, কোনো কোনো বারে, আর ছিনতাই হওয়ার আগে যে আটটা বিশের বাস ধরে সকালবেলা যেতাম—এই সবকিছু। সে এ-ও ঘোষণা দিল যে বাড়ি ফেরার পথে আমি কখনো বাস ধরতাম না। কথাটা সত্যি। প্রতি সপ্তাহ শেষে, রোদ থাকুক বা বৃষ্টি, বোমাবাজি হোক বা বন্দুকযুদ্ধ, হরতাল হোক বা দাঙ্গা, আমি হেঁটেই বাড়ি ফিরতাম, বই পড়তে পড়তে। বইটা অবশ্যই উনিশ শতকের কোনো বই। কারণ, আমি বিশ শতকের বই পছন্দ করি না, আর বিশ শতকটাকেও না। এখন ফিরে দেখতে গেলে মনে হচ্ছে, দুধওয়ালা মনে হয় এর সবই জানত।

তো সে কথাবার্তা বলতে থাকল, আমরা যখন সামনের বড় দিঘিটার ধার দিয়ে এগোচ্ছিলাম। বাচ্চাদের খেলার মাঠটার কাছে আরেকটা ছোট পুকুর আছে পেছন দিকে। সামনে তাকিয়ে কথা বলছিল লোকটা, একবারও আমার দিকে ফিরে দেখেনি। এই দ্বিতীয় সাক্ষাতে আমার ব্যাপারে একটাও প্রশ্ন করেনি সে। মনে হচ্ছিল না সে কিছুই জানতে চায়। চাইলেও আমি বলতাম এমন নয়। আমি তখনো ভাবছি, ‘এ আবার কোত্থেকে এল?’ আর কেনই-বা এমন ভাব করছে যে আমাকে চেনে বা আমরা পরস্পরকে চিনি? ধরেই নিচ্ছে যে আমার পাশে সে দৌড়ালে আমি কিছু মনে করব না, যখন আসলে আমি মনে করছি। আর আমিই-বা কেন দৌড়ানো থামিয়ে তাকে বলতে পারছি না আমাকে একা থাকতে দিন? ‘সে কোত্থেকে এল?’ এই প্রশ্ন ছাড়া বাদবাকি চিন্তাগুলো অবশ্য করেছি অনেক পরে, পরে বলতে এক ঘণ্টা পরে নয়—বিশ বছর পর। তখন, আঠারো বছর বয়সে, একটা গা-শিউরানো সমাজ, যেখানে মূল নিয়ম হলো, যদি কোনো শারীরিক আঘাত করা না হয়, আর ভীষণ রকমের গালিগালাজ করে অপমান কেউ না করে, আর কোনো রকম ক্রূর দৃষ্টিতে না তাকায়, তাহলে ঘটনা কিছুই না—এমন সমাজে বেড়ে ওঠে কেউ আর কীভাবে ভাববে তাকে আক্রমণ করা হচ্ছে, যা আদতে করা হয়নি? সেই আঠারো বছরে ব্যক্তিগত এলাকার সীমারেখা সম্বন্ধে খুব ভালো বুঝতামও না। শুধু অনুভব করতাম, অনুমান করতাম আর এক রকম বিতৃষ্ণা বোধ হতো কিছু লোকের প্রতি। আমি জানতামও না যে এই সব অনুমান করা বিতৃষ্ণা আসলে গণ্য করার মতো, জানতাম না এমনভাবে যে কেউ কাছে ঘেঁষতে চাইলে তাকে মানা করার অধিকার রয়েছে আমার। সে সময় আমি বড়জোর যা করতে পারতাম তা হলো, আশা করতাম যে ব্যক্তিটি খাতির দেখিয়ে যা বলতে চাইছে, সেটা তাড়াতাড়ি বলে বিদায় হোক, কিংবা নিজেই যত দ্রুত পারি ভদ্রভাবে চলে আসতাম।

দ্বিতীয় সাক্ষাতের পর বুঝতে পারছিলাম যে দুধওয়ালা আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে আর এগোতে চাইছে। এটাও বুঝতে পারছিলাম যে তাকে আমি পছন্দ করি না আর তার মতন একই অনুভূতি আমার দিক থেকে হচ্ছে না। কিন্তু সে সরাসরি এ ব্যাপারে কিছু বলেনি। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি, স্পর্শ করেনি; দ্বিতীয়বার দেখা হওয়ার সময় তাকায়নি পর্যন্ত। তার ওপর সে আমার থেকে বয়সে বড়—অনেক বড়। আমি শুধু ভাবছিলাম, তাহলে কি আমি যেটা ধরে নিচ্ছি তা ভুল?

(মিল্কম্যান উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম অংশের অনুবাদ)
অনুবাদ: উম্মে ফারহানা