সাহিত্যিকের রাজনীতি, রাজনীতিকের সাহিত্য

>

জন এফ কেনেডির প্রোফাইলস ইন কারেজ বইয়ের প্রচ্ছদ
জন এফ কেনেডির প্রোফাইলস ইন কারেজ বইয়ের প্রচ্ছদ

ভোট নিয়ে বাইরের দেশের লেখকদেরও উৎকণ্ঠা কম নয়, কারণ তাঁদের অনেকেই রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ও রাজনীতি সচেতন, একজন দাঁড়িয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও।

অ্যারিস্টটলের ভাষ্যে, যেকোনো মানুষ চরিত্রগতভাবে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রাণীমাত্র। ব্রেটল্ট ব্রেখট বলেছিলেন, ‘অশিক্ষিতের ভেতর নিকৃষ্ট হচ্ছে সে, যে রাজনৈতিকভাবে অশিক্ষিত। সে শোনে না, বলে না, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে না। জীবনের মূল্য সে জানে না...।’

রাজনীতি যেহেতু জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং জীবন নিয়েই সাহিত্যিকের কারবার, রাজনীতিসম্পৃক্তি সাহিত্যিকের স্বাভাবিক প্রবণতাই হয়ে দাঁড়ায়। সেই প্লেটো-অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে রুশো-ব্লেক-মার্ক্স-সার্ত্রে-অরওয়েল-চমস্কি হয়েমারিও ভার্গাস য়োসা-অ্যাঞ্জেলা ডেভিস-মায়া অ্যাঞ্জেলো-মার্গারিট অ্যাটউড...রাজনীতিচিন্তক এবং কর্মী হিসেবে সাহিত্যিকদের নাম বিশ্বসাহিত্যে প্রতুল। মানুষকে পর্যবেক্ষণের তীক্ষ্ণতর চোখ যার আছে, যার আছে সেই মানুষের গন্তব্য বিশ্লেষণের ক্ষমতা, তার চোখে বিদ্যমান রাজনীতির গতি এবং দুর্গতি ধরা পড়বেই, প্রাঞ্জলভাবে ধরা পড়বে মানবমুক্তির পথে যারা বাধা, তাদের স্বরূপ।

হ্যারি ব্রাউন দুবার যুক্তরাষ্ট্রের  প্রেসিডেনশিয়াল নমিনি হয়েছিলেন
হ্যারি ব্রাউন দুবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল নমিনি হয়েছিলেন

কিন্তু এরপর সাহিত্যিকেরা কি শুধুই মুক্তির, প্রগতির জয়গান গেয়েছেন? অতটা সরলরেখায় এগোয়নি সাহিত্যিকদের রাজনীতিচিন্তা। ন্যুট হ্যামসুন দুই বিশ্বযুদ্ধের সময়েই জার্মানির পক্ষে তাঁর মতামত প্রকাশ করেছিলেন; সার্ত্রে গণহত্যার সাফাই গেয়েছিলেন, নাৎসিদের সঙ্গে ওঠাবসা করেছেন; এজরা পাউন্ড ফ্যাসিবাদকে সমাজসংস্কারের মূলমন্ত্র হিসেবে দেখেছেন; উল্টোদিকে আলবেয়ার কামু জীবনবাজি রেখেছেন বিপ্লবের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে, শোনা যায় কেজিবির হাতে তিনি মারা পড়তে পারতেন; লোরকাকে মেরে ফেলার পর মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল অনামা কোনো গণকবরে।

আদতে দৃষ্টিবান সাহিত্যিকেরা অন্ধ আনুগত্য দান করতে পারেন না, তাঁর বুদ্ধিমত্তার অবাধ্যতাই তাঁকে সেটা করতে দেয় না (সারামাগো একরকমের অন্ধত্ব মহামারি আকারে ছেয়ে যাওয়ার কথা লিখেছেন তাঁর উপন্যাসে), এ তো বুদ্ধিবৃত্তিক সততার প্রশ্ন।

মারিও ভার্গাস য়োসা লড়েছিলেন পেরুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে
মারিও ভার্গাস য়োসা লড়েছিলেন পেরুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে

তাহলে তখন তিনি (সাহিত্যিক) কী করেন? আমরা তাঁকে ঐতিহাসিকভাবে দেখি তিনটি ভূমিকায়। এক. তিনি তাঁর সাহিত্যে স্বীয় রাজনৈতিক চিন্তাকে তুলে ধরেন। (অরওয়েলের অ্যানিম্যাল ফার্ম এ বিষয়ে অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে। মার্গারিট অ্যাটউডের ‘ডিসটোপিয়া’ যেমন সামাজিক স্খলনের বাস্তবচিত্র, কাল্পনিক অথচ ভীষণভাবে বাস্তবের রাষ্ট্রে সংঘটিত বহু বিষয় হুবহু সেখানে উৎকলিত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘ছিনিয়ে খায়নি কেন’ কিংবা ‘ছোট-বকুলপুরের যাত্রী’ বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস লাল সালু অথবা মনে করে দেখুন বিভূতিবাবুর গল্প ‘তালনবমী’। আবার উল্টোদিকে সারামাগোর উপন্যাসগুলো রাজনৈতিক উপন্যাস না হয়েও কি প্রচ্ছন্নভাবে তুমুল রাজনৈতিক নয়? ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারি, স্টেইনব্যাকের দ্য গ্রেপস অব র‌্যাথ...কোনটি রাজনৈতিক নয়?)

দুই. তিনি অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন (মুলুক রাজ আনন্দ স্পেনের গৃহযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে স্পেন চলে গিয়েছিলেন।)

বারাক ওবামার দ্য অডাসিটি অব হোপ বইয়ের প্রচ্ছদ
বারাক ওবামার দ্য অডাসিটি অব হোপ বইয়ের প্রচ্ছদ

তিন. তিনি স্বয়ং রাজনীতিকে রূপান্তরিত হন (রূপান্তরিত হন বলাটা হয়তো ঠিক হলো না, এটি তাঁর দ্বিতীয় সত্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়)। রাজনৈতিক চিন্তা এবং মতাদর্শ সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতাকে খেয়ে নিয়েছিল বলে মন্তব্য করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, প্রায় একই রকম আশঙ্কা তাঁর কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়েও ছিল। কখনো সাহিত্যিক এই তিনের ভেতর প্রথম দুটি ভূমিকাতেই একসঙ্গে অবতীর্ণ হন, যেমন মহাশ্বেতা দেবী ও অরুন্ধতী রায়। আবার কখনো কখনো সাহিত্যিক এক এবং তিন নম্বর ভূমিকা গ্রহণ করেন।যেমন, নোবেলজয়ী ঔপনাসিক মারিও ভার্গাস য়োসা ১৯৯০ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন পেরুর প্রেসিডেন্ট পদে, আর লেখক হ্যারি ব্রাউন লিবার্টারিয়ান পার্টির হয়ে দুবার প্রেসিডেনশিয়াল নমিনি হয়েছিলেন নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে।

হিলারি ক্লিনটনের ইট টেকস আ ভিলেজ বইয়ের প্রচ্ছদ
হিলারি ক্লিনটনের ইট টেকস আ ভিলেজ বইয়ের প্রচ্ছদ

এই তিনের বাইরে আরেক দল সাহিত্যিক আছেন, যাঁরা রাজসভার সাহিত্যিক, যাঁদের কীর্তি মোটেই কম নয়, বরং বলা যায় সাহিত্যে বহুকালই রাজার পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজনীয়তা ছিল, পুঁজির যোগ না থাকলে সাহিত্যের অবকাশ ঘটে না, বাক্যস্ফূর্তি অবিরাম হয় না—এটি মধ্যযুগে যেমন সত্য ছিল, আজও সমান সত্য হয়ে আছে। আচ্ছা, রাজা বসন্তের অবসরে বিরলে বসে সাহিত্য রচনা করেন, নাকি সাহিত্যিকও কখনো রাজায় পরিণত হতে পারেন? ইতিহাস কী বলে? বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতি প্রার্থীদের অনেকেরই অবশ্য স্বরচিত পুস্তক রয়েছে, যে সাহিত্যের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ক্যান্ডিডেট লিট’। সিনেটর বারাক ওবামার দ্য অডাসিটি অব হোপ, হিলারি ক্লিনটনের ইট টেকস আ ভিলেজ, সিনেটর ক্রিস্টোফার ডডের লেটারস ফ্রম ন্যুরেমবার্গ, বিল রিচার্ডসনের বিটুইন ওয়ার্ল্ডস, ১৯৯২ সালে ক্লিনটন ও অ্যাল গোরের পুটিং পিপল ফার্স্ট—এসব বই দিয়ে যায় চেনা, কিংবা যায় প্রতিপক্ষকে দাগিয়ে দেওয়ার, রাঙিয়ে দেওয়ার অঢেল সুযোগ। জন এফ কেনেডি ১৯৫৭ সালে প্রকাশ করলেন প্রোফাইলস ইন কারেজ, পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিল সেই বই। স্বৈরাচারী শাসকদের রয়েছে পুস্তক লিখে দেওয়ার মতো বিকিয়ে যাওয়া সাহিত্যিক সংঘ (নাম বলব? দুষ্ট লোকেরা বলে, কেনেডির বইটিও সংঘ দিয়ে লেখা, জর্জ ডব্লিউ বুশের বইও তাই, সিনেটর জন ম্যাককেইনের বইও তাই)।

ক্লিনটন ও অ্যাল গোরের পুটিং পিপল ফার্স্ট বইয়ের প্রচ্ছদ
ক্লিনটন ও অ্যাল গোরের পুটিং পিপল ফার্স্ট বইয়ের প্রচ্ছদ

যা হোক, দেশে দেশে শাসকদের কনকপ্রদীপ জ্বালানোর অনেক ইতিহাস রয়েছে, সাহিত্যিকের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। প্রশ্ন হচ্ছে, যিনি অবাঙ্মানসগোচরকে তুলে আনেন অন্তিম থেকে কাগজে, তিনি তাঁর দৃষ্টির সূক্ষ্মতা দিয়ে এবং আন্তর সংবেদনশীলতা দিয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতির ভয়াল পটে (অরওয়েল বলছেন, যেখানে বাক্য আপাতসত্য, যেখানে হত্যা সম্মানিত, সেখানে বায়বীয়রও আকার আছে, এমনটা ভাবানো সম্ভব) কতটা টিকে থাকেন, কতটা দিগ্‌দর্শন দেন, কতটাই বা বদলে সক্ষম হন? রাজনীতিসচেতন, গণমানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে—এমন মানুষকে লেখক হিসেবে কিংবা মতাদর্শিক অবস্থান থেকে ধসে যেতেও দেখি আমরা। উদাহরণ হিসেবে প্রিয় সাহিত্যিকের নাম আসবে; ব্যক্তির স্খলন আর কীর্তির স্থায়ীত্ব-সর্বজনীনতা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সূচিত হবে, তাই নাম নেওয়া থেকে বিরত থাকলাম। ‘নির্বাচন আসন্ন মানে পৃথিবীময় শান্তি ঘোষিত হবে এবং সেই সব শিয়াল আন্তরিকভাবে কামনা করবে, মুরগিরা দীর্ঘজীবী হোক...’—এটি আমার কথা নয়, জর্জ এলিয়টের। এই নির্বাচনী প্ররোচনা এবং নির্বাচনপরবর্তী বায়বীয়তার মাঝখানে লেখক কেমন করে শ্বাস নেন? মার্ক টোয়েন অত্যন্ত টোয়েনিয়-ভাষায় জানিয়েছেন এর উত্তর, ‘প্রাক্‌নির্বাচনী মৌসুম ছাড়া এমনিতেও নীতি তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। নির্বাচনের পর নীতিকে বাতাসে শুকাতে দিতে হয়, রৌদ্রদগ্ধ হয়ে আগামী মৌসুমের স্বাদপরিগ্রহ করতে হয়।’

অ্যারিস্টটলের ‘রাজনৈতিক প্রাণী’র জগৎ বড় বিচিত্র।