ধাবমান: জয়নুল আবেদিন ও আলতামিরা-পিকাসো

জয়নুল আবেদিন (২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪—২৮ মে ১৯৭৬), প্রতিকৃতি: আরাফাত করিম
জয়নুল আবেদিন (২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪—২৮ মে ১৯৭৬), প্রতিকৃতি: আরাফাত করিম
>

২৯ ডিসেম্বর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আয়োজন

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৪তম জন্মজয়ন্তীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মনে হলো আরও কতভাবেই না তাঁকে দেখা যেতে পারে। দড়ি ছেঁড়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় বিরুদ্ধ শক্তির বন্ধনকে ছিন্ন করার চেষ্টারত গাভিটির কথা মনে এল, যার পোশাকি নাম ‘বিদ্রোহ’। তিনি নিজে রাখেননি, রেখেছেন অন্য কেউ। গাভি? হ্যাঁ, বড় ওলানের দুগ্ধবতি গাভি, যদিও অনেকে একে ষাঁড় মনে করে প্রচুর প্রশস্তি লিখেছেন। মনে করার চেষ্টা করলাম গাভিকে এভাবে শক্তিমান ও বিদ্রোহী ভঙ্গিতে আর কোনো চিত্রশিল্পী বা ভাস্কর উপস্থাপন করার কথা চিন্তায় এনেছেন কি না। ইতিহাসের পাতা উল্টে তেমন কিছু নজরে এল না। তবে কাছাকাছি ভঙ্গিমার তেড়ে আসা ষাঁড়ের ছবি বা ভাস্কর্য প্রচুর না হলেও খুঁজে পেতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। এসবের মধ্য থেকে আলতামিরা গুহার প্রবল গতিতে ধেয়ে আসা বাইসনটির চিত্র তার ছন্দে বাঁধা গতিময়তায় মুগ্ধ করে। বুলফাইটের প্রতি পিকাসোর আগ্রহ আমাদের অজানা নয়, তাঁর নানা ভঙ্গির আর রূপের সরলীকরণে বা অতিশায়নে চিত্রিত ষাঁড়ের অসংখ্য রেখাচিত্রে বা তুলির ভরাট আদলে ধরা আছে পিকাসোর রূপনির্মার্ণের জাদুকরি ক্ষমতা। এগুলোর মধ্য থেকে একটিকে বেছে নিয়ে ভাবলাম তিনটি চিত্রকর্ম নিয়ে একটি সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রয়াস নেওয়া যেতে পারে। অবশ্য কেউ কেউ নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের ‘চার্জিং বুল’ ভাস্কর্যটির উল্লেখ করতে চাইবেন, যেটি ২০১১ সালের অকাপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনে পুঁজিবাদের আগ্রাসী রূপের প্রতীক হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছিল। অবশ্য এ বিতর্কিত ভাস্কর্যটিকে আমরা এ আলোচনার বাইরেই রাখতে চাই।

ধরে নিই যে আলতামিরা গুহা আমাদের কাছে বেশ পরিচিত কিছু, কারণ দোকানপাট বা ব্র্যান্ড পণ্যের নামেও এর ব্যবহার দেখতে পাই। তবু বলে নেওয়া ভালো, আলতামিরা স্পেন-ফ্রান্স সীমান্তের পিরেনিজ পর্বতমালার স্পেনীয় অংশে অবস্থিত প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহামানবের ব্যবহৃত চিত্রশোভিত একটি গুহা, যাতে মানুষের অঙ্কিত আদিতম চিত্রকলার কিছু শ্রেষ্ঠ নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। এ রকম গুহা পর্বতশ্রেণির স্পেন ও ফ্রান্স উভয় অংশেই রয়েছে, যার মধ্যে লাসকৌ বা ফঁ-দ্য-গম গুহাও কম বিখ্যাত নয়। ধারণা করা হয়, আলতামিরার প্রাচীনতম গুহাচিত্রটি আঁকা হয়েছে আজ থেকে অন্তত ৩৬ হাজার বছর আগে, যাকে প্যালিওলিথিক বা পুরাতন প্রস্তরযুগ বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। আলতামিরা আবিষ্কার হয় মাত্র ১৮৬৮ সালে। গুহার অনেক অভ্যন্তরে অন্ধকার এলাকার দেয়াল ও ছাদে পাওয়া গেছে ওই সময়কার প্রাণির অসংখ্য একক বা দলবদ্ধ ছবি। কী কারণে, কী উপায়ে বা উদ্দেশ্যে এসব ছবি আঁকা হয়েছে সে আলোচনা এ পরিসরে করা সম্ভব নয়, তবে নির্বাচিত চিত্রটির নান্দনিক তাৎপর্য নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে। এখানে আমরা আলতামিরা গুহার যে চিত্রকর্মটির কথা বলতে চাইছি, সেটি একটি তেড়ে আসা বাইসনের ছবি। ছন্দিত অথচ শক্তিমান রেখার নিশ্চিত প্রয়োগ, ভঙ্গিমায় আক্রমণের গতিময় প্রকাশ আর বর্ণের ছায়ে আলোছায়ার আভাস মিলে এ ছবিটি গতি, শক্তি ও ছন্দের এমন একটি প্রবল দ্যোতনা সৃষ্টি করে যে আমরা সহজে চোখ ফেরাতে পারি না। গুহার যে স্থানে ছবিগুলো আঁকা হয়েছে সেখানে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পরিসর নেই। সেখানে প্রশিক্ষণহীন গুহাবাসী মানুষ—যার হাতে কঞ্চির থ্যাৎলানো তুলি, প্রাকৃতিক রং আর মশালের ধোঁয়াটে আলো ছাড়া আর কিছু নেই—এঁকেছে এসব অসামান্য চিত্রাবলি। তাদের মধ্যে হাজারো ছবির ভেতরে এ চিত্রটি আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে তার আপন মহিমায়। যে গুহাবাসী শিল্পীর হাতে আঁকা একটি প্রাণি তার শৈল্পিক সুষমায় হয়ে উঠেছে মানবজাতির শিল্প–ঐতিহ্যের অন্যতম সেরা একটি সম্পদ, সে অজানা শিল্পীর উদ্দেশে আমরা শুধু অভিবাদনই জানাতে পারি।

বিদ্রোহী গাভির শক্তি ও গতিছন্দে জয়নুল আবেদিনের ‘বিদ্রোহ’ চিত্রটিই সেরা
বিদ্রোহী গাভির শক্তি ও গতিছন্দে জয়নুল আবেদিনের ‘বিদ্রোহ’ চিত্রটিই সেরা

সর্বকালের অন্যতম সেরা শিল্পী হিসেবে নন্দিত পাবলো পিকাসোর শিল্পকর্মে তাঁর স্পেনীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো বিশেষভাবে প্রতিভাত। এর অন্যতম ষাঁড়কে শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা এবং ঐতিহ্যবাহী বুলফাইটের প্রতি তাঁর আকর্ষণ। পিকাসোর চিত্রমালায় ও অসংখ্য রেখাচিত্রে ষাঁড় মূলত নিপীড়নকারী শক্তির প্রতীক, বিখ্যাত ‘গুয়ের্নিকা’ চিত্র এর সেরা উদাহরণ। তবে তাঁর অফুরন্ত কল্পনাশক্তি ষাঁড়কে আরও নানা রূপবন্ধে চিত্রিত করেছে। বুলফাইটের অসংখ্য রেখাচিত্রে ষাঁড় কখনো আক্রমণোদ্যত ও দুর্বার, আবার কোথাও অন্যায় সমরে বর্শাবিদ্ধ। এখানে আমরা বেছে নিয়েছি কালো কালিতে তুলির ভরাট টানে আঁকা কাপড়-দোলানো ম্যাটাডোরের দিকে তেড়ে আসা প্রতিপক্ষ ষাঁড়ের একটি চিত্র। তুলির একেবারে তাৎক্ষণিক আলতো স্পর্শে আঁকা ষাঁড় ও ম্যাটাডোর সাদা ও কালোর বিপরীত সংঘাতে মুহূর্তটির এক শ্বাসরুদ্ধকর নাটকীয় পরিস্থিতি নির্মাণ করে। হয়তো একমাত্র পিকাসোর পক্ষেই সম্ভব এমন হেলায়ফেলায় আঁকা ছবিতেও ঘটনার নির্যাসকে ধরে ফেলা। এখানে ষাঁড়টি তেমন বলিষ্ঠ নয়, পেশির আভাসও নেই, তবু ওর তেজিয়ান যুদ্ধংদেহী ভাবটি ফুটে ওঠে নির্বিকার ম্যাটাডোরের বিপরীতে।

আলতামিরার ধাবমান বাইসন
আলতামিরার ধাবমান বাইসন

জয়নুল আবেদিনের ‘বিদ্রোহ’ বা ‘বিদ্রোহী’ নামে পরিচিত দড়ি ছেঁড়ার প্রয়াসরত গাভির ছবিটি আঁকা হয়েছে ১৯৫১ সালে। তুলি অথবা খাগের কলমে কালো কালিতে পরিলেখ (আউট লাইন) ও উচ্চাবচের আবহ আর স্বচ্ছ জলরঙের পরিমিত প্রয়োগে আঁকা হয়েছে গরুর দেহভঙ্গি ও গতিবেগের অপ্রতিরোধ্যতা। এ বছরেই জয়নুল প্রায় একই রীতিতে এঁকেছেন তাঁর জীবনের সেরা কিছু চিত্র। ‘সাঁওতাল দম্পতি’, ‘দুই নারী’, ‘অপেক্ষা’ ইত্যাদি ছবিতে কাগজের ওপর মোটা তুলির কালো রেখায় বিষয়ের অবয়ব প্রতিভাত করে সামান্য জলরঙের স্পর্শে খুব স্বল্প সময়ে সম্পন্ন হয়েছে এগুলোর নির্মাণ। এ চিত্রগুলোর অন্যতম গুণ রেখা ও রঙের সাবলীল ও ছন্দোময় ব্যঞ্জনা। জয়নুল একই পদ্ধতিতে পরবর্তীকালে আরও কিছু চিত্র রচনা করলেও বিদ্রোহী গাভির শক্তি ও গতিছন্দে এটিই এ শৈলীর শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ বলে মানতে হয়।

দিগন্তরেখাহীন হলুদ-বাদামি পটজুড়ে শুধু একটিমাত্র গরু, পরিলেখ রেখার স্পটতা ছাড়া বাকি পট প্রায় একরঙা। গাভিটির মাথা নিচু করে এগিয়ে যাওয়ার তীব্র প্রয়াস এবং দড়িটির টান–টান অবস্থা গতি বনাম স্থিতির একটি প্রবল টানাপোড়েন সৃষ্টি করে। এটিই এ চিত্রে বিপরীত গতির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কৌণিক রেখার নাটকীয়তা নিয়ে আসে। এ জয়-পরাজয়ের টেনশন দর্শককে আবিষ্ট করে ফেলে আর গাভিটির মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতি রচনা করে আমাদের সহমর্মিতা।

পাবলো পিকাসোর ‘ম্যাটাডোর’
পাবলো পিকাসোর ‘ম্যাটাডোর’

মনে রাখা যেতে পারে এ ছবিটি আঁকা হয়েছে ১৯৫১ সালে। ওই বছরই জয়নুল আবেদিন এক বছরের বৃত্তিতে লন্ডনের স্লেড স্কুল অব আর্টে যোগ দিয়ে বায়ান্নোর মাঝামাঝি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৪৮ সালেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাকিস্তানি শাসকদের আচরণে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি তাদের বৈষম্যমূলক মনোভাব প্রকাশ পায় এবং বাঙালিদের মনে এই অপশাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা দানা বাঁধতে শুরু করে, যার বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি। ওই সময় জয়নুল আবেদিন দেশে ছিলেন না। তবে তাঁর বিদেশ গমনের আগেই দেখা দেওয়া মুক্তির স্বপ্ন প্রতীকে কী তিনি বলতে চেয়েছেন? এ চিত্রটিকে কি ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার সার্বিক মুক্তি আন্দোলনের একটি প্রতীকী সূচনাভাষ্য হিসেবে দেখা যেতে পারে? যেটি স্বাভাবিকভাবে হওয়ার কথা ছিল ষাঁড়, সেটিকে গাভি হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে শিল্পী কি কোনো বার্তা দিতে চেয়েছেন, মাতৃ-প্রতীকে মাতৃভূমির বন্ধনমুক্তির আকাঙক্ষা? আমরা সঠিক জানি না। তবে এটুকু বলা যেতে পারে, একটি গাভির দড়ির বন্ধন ছিন্ন করার প্রয়াসের এ চিত্রকর্মটি বাঙালির মানসপটে স্থায়ী আসন অর্জন করেছে তার শক্তিশালী প্রকাশভঙ্গি ও রূপায়ণের প্রতীকী অর্থময়তায়।

এভাবেই আলতামিরার ছন্দোময় বাইসন, পিকাসোর উদ্যত ষাঁড় আর জয়নুল আবেদিনের মুক্তি-প্রত্যাশী গাভি গতিময় জীবনের এক ধাবমান শিল্পরূপের অনুপম প্রকাশময়তায় এক সারিতে এসে দাঁড়ায়।