মোহিত কামালের সমাজমনস্ক শিল্পীসত্তা

>

মোহিত কামাল। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
মোহিত কামাল। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

২ জানুয়ারি ছিল কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের ৬০তম জন্মদিন

আমাদের সাহিত্যভুবনের সাম্প্রতিক এক নাম মোহিত কামাল। পেশাগত জীবনে তিনি যেমন খ্যাতির শিখরে অবস্থান করছেন, কথাসাহিত্যেও এক প্রণিধানযোগ্য ধারার প্রবর্তক। আমরা জানি, সমাজের অন্তরে যে ক্ষত মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে, তার বিরুদ্ধে তিনি তাঁর শানিত কলম হাতে নিরলস যোদ্ধা হিসেবে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।

মোহিত কামাল তাঁর চরিত্রদের আমাদের বাস্তব সমাজজীবন থেকেই হাজির করছেন কথাসাহিত্যে। এ বছরেই প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস চোরাগলি, যেখানে আমরা লক্ষ করব আমাদের সমাজে কী ঘটে চলেছে। চারপাশে ফাঁদ, চোরাগলি। না-বুঝে অনেক তরুণ-তরুণী আটকে পড়ছে মরণফাঁদে। বিপন্ন হয়ে পড়ছে তাদের জীবন। প্রায় অনতিক্রম্য এ ফাঁদকে রাষ্ট্র-কর্তৃপক্ষ, সমাজ ও পরিবারের পক্ষেও উৎখাত করা যেখানে কঠিন চ্যালেঞ্জ, সেখানে সাহসী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তরুণী ইথা এগিয়ে আসে। বলতে গেলে ইথা সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হয়। এই প্রতিজ্ঞা-প্রজ্বালিত ইথা মোহিত কামালের সৃষ্ট চরিত্র। জিনাত আরা ইথার মা। এই মা এমন এক ‘মা’, যিনি মোহিত কামালের তুলিতে মায়ের অধিক এক মা হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন। পাঠকেরা ইথার সাফল্যে অন্ধগহ্বরে ডুবতে থাকা সমাজকে সংস্কারের দিশা পায়।

অল্প কথায় উল্লেখ করা যায়, মোহিত কামালের আরও আরও সমধর্মী উপন্যাসের কথা—সুস্মিতার বাড়ি ফেরা, বিষাদনদী, উড়ালমন, না, মন ইত্যাদি। পাঠক পেয়ে যায় ঊর্মি, সুস্মিতা, রুবা, মিথিলাদের। তাদের জীবন থেকে সমাজের, ব্যক্তির ও সমাজ-গবেষকের পাঠ নিতে হবে। চিরকালের হিংসা, অভিলাষ, জিঘাংসা ও পাশববৃত্তির সঙ্গে মিশে গেছে সতর্ক সাইবার ক্রাইম। সমাজ বদলে যায়, চিরকালের চরিত্রও বদলে যায়, আধুনিক কালের প্রযুক্তিঋদ্ধ আত্মবিধ্বংসী চরিত্ররা উঠে আসে সাহিত্যে। শিল্পরূপ সফল না হলে যা সাহিত্য পদবাচ্য না-ও হতে পারে, যে শিল্পরূপ কথাশিল্পীর আরাধ্য, মোহিত কামালের চরিত্ররা মানবিক গুণাবলি পরিস্ফুটনের সফল বাহন হয়েছে। এ কথাকারের সৃষ্টিসম্ভার কম নয়, তাঁর অপরিসীম শ্রমের ফসল আমাদের পথ দেখায়।

মরুঝড়: তিনি কেবলই স্বদেশ-স্বসমাজের মানুষের মনোজাগতিক ক্ষতাক্রান্ত চরিত্রাবলিরই লিপিকার নন, তাঁর মরুঝড় উপন্যাসটিতে তা লক্ষ করা যায়। এই মরুঝড় কেবল মরুভূমির দেশের বৃত্তেই সীমাবদ্ধ নয়, এর বিস্তার ঘটেছে সজল বাংলাদেশের মানুষের মনোভূমিতেও। সংকট আর সন্দেহের ঝড় বয়ে চলেছে মনের গহন প্রান্তেও। প্রাকৃতিক জলোচ্ছ্বাসের মতোই ঘরে ঘরে, পরিবারে তথা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে এই ঝড় লন্ডভন্ড করে দেয় সজল দেশের জীবন্ত চরিত্রের মন-প্রকৃতি ও মনোভুবন। স্বদেশে রেখে যাওয়া স্বজনদের জন্য মরু-শ্রমিকের বুকের প্রান্তরে জীবন্ত-বাস্তব মরুঝড় যেন-বা বিরহিনী কিশোরী বধূ নামক প্রদীপ শিখাটি নিভে যায়-যায়। স্বামীর অনুপস্থিতিতে শাশুড়ির সঙ্গে দ্বন্দ্ব একালের এ ‘গৃহদাহ’-এই পরিবর্তমান নতুন সমাজের নতুন দ্বন্দ্ব, নতুন বৈশ্বিক বাস্তবতা আজকের কথাসাহিত্যেরও নতুন প্রপঞ্চ।

প্রথমা প্রকাশন থেেক প্রকাশিত মোহিত কামালের দুটি বই
প্রথমা প্রকাশন থেেক প্রকাশিত মোহিত কামালের দুটি বই

সুস্মিতার বাড়ি ফেরা: চলমান সামাজিক সমস্যাকে লেখক আলোকপাত করেছেন এ উপন্যাসে। নিকট অতীতের অ্যাসিড-সন্ত্রাস যেমন সমাজ মেনে নেয়নি। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তার লাগাম টেনে ধরতে পেরেছে। অথচ এখন চলছে সাইবার ক্রাইম। এ ক্ষেত্রে এই প্রজন্মের তরুণেরাই সিদ্ধহস্ত। তরুণদের একটি ক্ষুদ্রাংশ এই প্রযুক্তির অপব্যবহারে তৎপর হওয়ায় সামাজিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। ধ্বংসের মুখে পড়ছে আক্রান্ত পরিবার। এই অনতিক্রম্য সামাজিক সংকট থেকে মুক্তির নিশানা এঁকেছেন মোহিত কামাল। সাহিত্য সর্বদাই অগ্রগামী চেতনার স্রষ্টা, অপরাধীকে শনাক্ত করার বিশ্লেষণী মাধ্যম। সমাজের মানবিক উত্তরণের পথিকৃৎ মোহিত তাঁর শিল্পচেতনাকে ক্ষুণ্ন করে সাহিত্যকর্ম করেননি, হয়তোবা শিল্পরূপ সৃষ্টির সাধনাকে ছাড়িয়ে সামাজিক সংকট উত্তরণের মাধ্যমও হয়ে উঠতে চেয়েছে তাঁর সাহিত্য। নিশ্চয়ই আমরা তাঁর এই সৃষ্টিপ্রবণতাকে স্বাগত জানাই। লেখক নিজেই আমাদের জানিয়েছেন ‘এ বইটি সমসাময়িক, সাইকোসোশ্যাল প্যাথলজি, মাদক, সন্ত্রাস, সাইবার ক্রাইম, এখনকার ছেলেরা যেসব ফেস করছে, এসব নিয়ে লেখা।...আমি সব সময় কিন্তু সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে লিখছি।’ এ উপন্যাসের কাহিনিতে রাজিব ও সুস্মিতার বাগদান সম্পন্ন হয়েছিল। হবু স্বামী কৌশলে সুস্মিতার কিছু স্থির ছবি ধারণ করে। ফটোশপের মাধ্যমে সুস্মিতার ছবিগুলোকে অশ্লীল পর্নোস্টারের ছবির মতো তৈরি করে পরিবারকে ব্ল্যাকমেল করে। এ রকম এক ঘটনা একটি সমাজকেই ব্ল্যাকমেল করার শামিল। তবে এ উপন্যাসে লেখক একজন সুস্মিতার স্রষ্টা—বাস্তব সমাজজীবনের একজন সুস্মিতাই মানবিক-উত্তরণের নেতৃত্ব দিতে পারে।

পথভ্রষ্ট ঘূর্ণির কৃষ্ণগহ্বর উপন্যাসের প্রেক্ষাপট বিস্তৃত হয়েছে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত। এ কয়টা উপন্যাস নিশ্চয় ব্যতিক্রমধর্মী এক প্রণিধানযোগ্য আর্থসামাজিক আন্তর্জাতিক পটভূমে প্রণীত উপন্যাসের পাঠ; যা বিদ্বৎসমাজের নজর কেড়েছে। এই বিস্তীর্ণ নীলজলধির মাঝে দ্বীপ-দীপান্তরের বৃক্ষশোভিত নদ–নদী-সমুদ্রবেষ্টিত ভূমিগুলোতে বসবাসরত বিপুলসংখ্যক মানব-মানবীর ভেতর থেকে লেখক তাঁর কলমে এঁকেছেন ঈপ্সিত চরিত্রটি। ‘ব্ল্যাকহোল’-এর মতো ব্যক্তি ও সমাজজীবনকে গ্রাস করে, সমাজজীবনেও মানুষের এমনতর মানবেতর অবস্থা লেখক মোহিত কামালকে গভীরভাবে বেদনায়িত করেছে, যে বেদনা-উৎসব থেকেই রচিত হয়েছে এই দীর্ঘ পটভূমির উপন্যাস। লেখক এভাবে দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে এক আন্তর্জাতিক সাহিত্যভুবন রচনা করেন।

আমরা লক্ষ করতে পারি, চেনা বন্ধু অচেনা পথ (২০১১)-এর প্রেক্ষাপট ভার্চ্যুয়াল ওয়ার্ল্ড-ফেসবুক। ঘর (২০১১), অহনা (২০১২), পাথর পরান (২০১৩) আবর্তিত হয়েছে পারিবারিক, সামাজিক ও দাম্পত্য সম্পর্ককেন্দ্রিক কাহিনিমালায়। এসব উপন্যাসের প্রাণরসায়নের উপাদান মনস্তত্ত্ব। সব মিলিয়ে বলা যায়, মনস্ত্বাত্তিক উপাদানের মিশেলে প্রতিনিয়ত এক নতুন ধরনের উপন্যাসের রচয়িতা মোহিত কামাল। ২ জানুয়ারি ছিল এই লেখকের ৬০তম জন্মদিন। তাঁর মঙ্গল কামনা করি।