'অনেকেই ছাত্রজীবনের কাজ সারা জীবন করে যাচ্ছেন'

>

সৈয়দ জাহাঙ্গীর (১ জানুয়ারি ১৯৩৫—২৯ ডিসেম্বর ২০১৮)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
সৈয়দ জাহাঙ্গীর (১ জানুয়ারি ১৯৩৫—২৯ ডিসেম্বর ২০১৮)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

২৯ ডিসেম্বর মারা গেছেন বাংলাদেশের অগ্রজ চিত্রকর সৈয়দ জাহাঙ্গীর। পঞ্চাশের দশকের যে শিল্পীরা এ দেশের চিত্রকলাচর্চার ভিত্তিভূমি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। তাঁর এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর। এখানে তিনি সবিস্তার তুলে ধরেছেন নিজের শিল্পচিন্তা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাসির আলী মামুন

নাসির আলী মামুন: আমাদের দেশের অগ্রজ চিত্রকরদের মধ্যে আপনি অগ্রগণ্য। প্রথমে আপনার কাছে জানতে চাই শিল্পের ভাষার পরিবর্তনটা কীভাবে ঘটে?

সৈয়দ জাহাঙ্গীর: শিল্পের নিজস্ব ভাষা আছে। রং লেখার আঁচড়ে যাঁরা শিল্পকলার চর্চা করেন, তাঁরাই তৈরি করেন আর সময় এই ভাষা পরিবর্তন শিল্পীকে উসকে দেয়। সময় বা কাল কিন্তু শিল্পীর জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। সময়ের আবদারকে অবশ্যই আমলে নিতে হয়।

মামুন: শিল্পীরা কি সময়ের কাছে অনেক সময় অসহায় হয়ে যান না?

জাহাঙ্গীর: হ্যাঁ, হতেও পারেন। কিন্তু যিনি নিজেকে তৈরি করে দীর্ঘকাল শিল্পসাধনায় সক্রিয়, তিনি অসহায় হতে পারেন না। দেখবে যে শিল্পকলায় শিক্ষালাভ করেও অনেকেই ছাত্রজীবনের কাজ সারা জীবন করে যাচ্ছেন। তাঁরা কিন্তু বুঝতে পারেন না যে সব সময় ছাত্র হয়ে থাকতে নেই। শিক্ষাজীবনের পাঠ্যক্রম থেকে তিনি যেন আর বের হয়েই আসতে পারছেন না। এর কারণ কী? কারণ তাঁদের মেধা নেই। যা কিছু সেই ছাত্রজীবনে শিখেছিলেন, বার্ধক্যে এসেও তা-ই করে যাচ্ছেন। আমাদের দেশের এ ধরনের শিল্পীর সংখ্যা বেশি। কেবল দু-চারজনই নিজের কাজের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেয়েছেন।

আমি দেখেছি কয়েক বছর আগেও চারুকলার পঠনপদ্ধতি আধুনিক ছিল না, সেই ষাট-সত্তর দশকের পাঠদান চালু ছিল। একদম হাল আমলের কথা আমি জানি না। তবে আমার মনে হয়, খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এটা বোঝা যায়। আমাদের জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের ছবি ছাত্রাবস্থায় যেমনটা দেখেছি, এখনো একই রকম। এঁদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া সবাই-ই পুরোনো ধাঁচে ক্যানভাসে যেন কিছু রঙের খেলা করে যাচ্ছেন। শিক্ষক বা জ্যেষ্ঠ শিল্পীরা যদি পরিবর্তন না আনতে পারেন তাহলে ছাত্ররা শিখবে কোত্থেকে!

মামুন: জয়নুল, কামরুল এবং আরও অনেক খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী আপনাদের শিক্ষক ছিলেন...।

জাহাঙ্গীর: তাঁদের সরাসরি ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আবেদিন স্যার কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র এবং পরে শিক্ষক হয়েছিলেন। তিনি আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছিলেন তা ছিল তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে আধুনিক শিক্ষা। কলকাতা আর্ট স্কুলের কারিকুলাম তিনি ব্যবহার করেছিলেন এবং তাঁর নিজস্ব কিছু চিন্তা আমাদের মধ্যে সংক্রমিত করতে পেরেছিলেন। আমাদের আদি সংস্কৃতি বা এই যে লোকশিল্প, এটা শিল্পাচার্যের হাত ধরে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জয়নুল-কামরুল দুজনেই লোকশিল্পের শিক্ষা দিয়ে গেছেন আমাদের। এখন কথা হলো, তাঁরা আমাদের লোকসংস্কৃতির যে স্টাইলটি শিখিয়ে গেছেন, আমরা কি ঠিক তাঁদের মতোই ছবি আঁকতে চেষ্টা করব? আমি তো সেটা মনে করি না। আবেদিন স্যার বলতেন লোকসম্পদ আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণ, এই ধারা যেন টিকে থাকে। তবে এ-ও বলতেন এই শিল্পকে মূল রেখে এটাকে আরও আধুনিক ঢঙে সাজাতে। কোন শিল্প-প্রকরণের একই জায়গায় দীর্ঘকাল আবদ্ধ থাকা তিনি পছন্দ করতেন না।

মামুন: আপনারা কি শিল্পাচার্যের সব কথা মেনে চলতেন?

জাহাঙ্গীর: অবশ্যই। তিনি না হলে আমরা কেউ শিল্পী হতে পারতাম কি না যথেষ্ট সন্দেহ হয়। তাঁর আঁকা চল্লিশের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা তৎকালীন সময়েই বিশ্বমানের। তিনি যখন আমাদের ক্লাস করাতেন, তখন আমরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনতাম। তাঁর জীবনের শিল্পী হওয়ার যে অভিজ্ঞতা এমনটা আর কারও ছিল না। তিনি নিজে আমাদের প্রত্যেককে হাতে ধরে ধরে ড্রইং শিখিয়েছেন। আমরা যেন এক জায়গায় আটকে না থাকি সেটাও স্মরণ করিয়ে দিতেন। তাঁর কথা শুনেছি বলে আজকে আমরা ছবি আঁকার চেষ্টা করতে পারছি। তবে এর মধ্যে মাত্র দু-একজন আছেন, যাঁরা তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলেন, কিন্তু তাঁদের কোনো পরিবর্তন আসেনি। পুরোনো ধাঁচেই ছবি আঁকেন তাঁরা। এঁদের কাছ থেকে ছাত্ররা কীই-বা আশা করতে পারে।

মামুন: তাহলে হাল আমলে ছাত্ররা চারুকলায় কীভাবে বিকশিত হবে?

জাহাঙ্গীর: ছাত্ররা এখন সব জানে। তারা অনেক বুদ্ধিমান। নতুন প্রজন্ম যখন চারুকলায় বা আর্টের কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে আসে, তারা আগেই অনেক কিছু জেনে আসে। প্রত্যেকের বাড়িতে ইন্টারনেট আছে, ওটা বুদ্ধির দরজা খুলে দেয়। তারা জানে কী করতে হবে এবং কোথায় তাদের যেতে হবে। কিন্তু আমার কিছুটা দুঃখও হয় এ কারণে যে এখন এত সুযোগ থাকার পরও অনেক তরুণ তাদের তৈরি করার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করতে চায় না। আমরা প্রায় সবাই চারুকলা পাঠের প্রাথমিক সময়গুলোতে গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলাম। আমাদের না ছিল কোনো আর্টের শিক্ষা, না ছিল কোনো থাকা-খাওয়ার জায়গা। আমাদের মধ্যে মুর্তজা বশীর ও হামিদুর রহমান বনেদি পরিবার থেকে এসেছিলেন। বশীর কিন্তু এখনো সক্রিয়।

মামুন: এস এম সুলতানের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল পুরান ঢাকায় হামিদুর রহমানের বাড়িতে।

জাহাঙ্গীর: আগে একটু বলে নিই, এখনকার তরুণেরা যে ধরনের ছবি আঁকে তাতে কয়েকজনের ছবি দেখে আমি বিস্মিত হয়ে যাই। আমি নিয়মিত তরুণদের প্রদর্শনীতে যেতাম। এখন শরীর ভালো থাকে না, শ্বাসকষ্ট, তাই যাওয়া হয়ে ওঠে না। তাদের ছবির ফর্ম ও টেকনিক দুর্দান্ত। আলাপ করে জেনেছি ওরা নিজেরাই পাস করার পর নতুন পথ ও চিন্তা ছবিতে যুক্ত করেছে। এখন রঙের ব্যবহারটা এমনভাবে করে অনেক সময় ওয়াটার কালারটা বোঝা যায় না। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ওরা নিজেরাই করে। তরুণেরা আমার কাছে যখন আসে, তাদের সঙ্গে কথা বলে অনেক কিছু শিখি আমি। ছাত্রাবস্থায় আমাদের যে রকম মেধা ছিল তার চেয়ে অনেক জ্ঞান তাদের আছে।

মামুন: নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা আপনার শিল্পকর্ম বোঝে?

জাহাঙ্গীর: তারা যখন আমার ছবির ধরন, রং ও বিষয়ের বর্ণনা দিতে থাকে, আমি অবাক হই এই ভেবে যে আমার মতো বিচ্ছিন্ন এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের কাজ ওরা যত্ন নিয়ে দেখে! একদল মেধাবী তরুণ শিল্পী আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, তারা আমাকে ফোন করে দেখা করতে চায়। তারা আমার ছবি পছন্দ করে, এটা আমি বুঝি। দেখবে, একই ধরনের বিষয় ধরে ছবি এঁকেছে আমার সমকালীন শিল্পীরা, কিন্তু আমার ছবির রং ব্যবহার, কম্পোজিশন এবং ফর্মটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। নদী ও নৌকার অনেক ছবি এঁকেছি আমি এবং আমারটায় কোনো মানুষ হয়তো নেই, তারপর আমার ছবি অন্যদের মতো নয়। ছাত্ররাই বলে, আমার ছবিতে একগুঁয়েমি নেই, নতুনত্ব আছে। আমার নীল ও হলুদ রঙের ব্যবহার আর সবুজের...ওদের ভাবায়, ওরা আমার ছবি দেখে। এই ছবিটা দেখো (একটি ছবি দেখিয়ে), ক্যানভাসটা শুধু সবুজ রঙের কিন্তু কত ধরনের সবুজ! সামনের শীতে একটা প্রদর্শনী করার জন্য এই ছবিগুলো আঁকছি। আমার স্টুডিওটা ছোট, বড় কাজ করতে পারি না।

মামুন: এস এম সুলতানের সঙ্গে ওই যে দেখা হয়েছিল, মনে আছে?

জাহাঙ্গীর: ১৯৫৬-এর দিকে হবে। আমার আত্মজীবনীতে এ ঘটনা লিখেছিও। হামিদুর রহমানের বাসায় সুলতান সাহেবের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল আমার। তিনি তখন গেরুরা রঙের শাড়ির মতো একটা কাপড় জড়িয়ে খালি গায়ে ছিলেন। ধীরে কথা বলতেন, বেশ সুন্দর করে আস্তে আস্তে কথা বলতেন। মনে আছে, হামিদ তখনই বলেছিল বিখ্যাত শিল্পী। আমার স্টুডিও আছে জেনে হামিদের সঙ্গে তিনি একদিন এলেন আমার বাড়িতে। কোমর থেকে একটা পোঁটলা বের করে কলকিতে ভরে গাঁজা খেতে শুরু করলেন আমাদের সামনেই। আমি বললাম, আমাকে একটু দেন, তিনি দিলেন। খেয়ে আমার কোনো রকম নেশা ধরছিল না। তাই বললাম, কই কিছু তো হয় না। বললেন ঘণ্টাখানেক পরে ধরবে, অপেক্ষা করেন। এই ঘটনারও অনেক পরে আমি যখন শিল্পকলায় ছিলাম, সে সময় নড়াইল থেকে ঢাকায় এলে তিনি মাঝেমধ্যেই আমার অফিসে চলে আসতেন। কখনো কিছু কথা বলতেন, আবার কখনো উদাস মনে কোনো কথা না বলে দু-এক ঘণ্টা বসে থেকে কাউকে না বলে চলে যেতেন। তাঁর এই ধরন সম্পর্কে আমি আগেই জানতাম বলে আশ্চর্য হতাম না। কয়েক দিন আগে সুলতান সাহেবের ওপর তোমার আলোকচিত্র প্রদর্শনী দেখে এসে আমি কয়েক পাতা লিখেছি। সাদা-কালো ছবিতে তাঁকে জীবন্ত করে রেখেছ তুমি। আমি বিশ্বাস করি, এস এম সুলতান একজন বিশ্বমানের খাঁটি শিল্পী। তাঁর ছবি দেখে আমরা বুঝতে পারি, তাঁর মেধাটা কত ওপরে ছিল। শিল্পীকলা একাডেমিতে তাঁকে আমরা ‘রেসিডেন্ট আর্টিস্ট’ করেছিলাম। এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী এবং সমগ্র বাংলাদেশে ভ্রাম্যমাণ চারুকলা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলাম আমি। মন্ত্রণালয় বাজেট বরাদ্দ দিতে চায়নি, তারপরও যুদ্ধ করে করেছি। এ ব্যাপারে ভালো কিছু মানুষের সহায়তা পেয়েছি। সুলতান সাহেব এসব ব্যাপারে বিশেষ করে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে প্রদর্শনী নিয়ে যাওয়ার জন্য আমার প্রশংসা করতেন। এ ছাড়া গ্রামের কৃষকদের জন্য যেন শিল্পীদের ছবি দেখার সুযোগ করা যায়, সে ব্যাপারে তিনি আমাকে বলতেন। কিন্তু সেই সুযোগ সৃষ্টি করতে পারিনি।

মামুন: জীবনের শেষ বাঁকে এসে কী করতে ইচ্ছে করে?

জাহাঙ্গীর: আর তো কিছু পারি না। শুধু যত দিন পারি ছবি আঁকতে চাই। কিন্তু যখন নিজের কাছে মনে হবে আমার সৃষ্টি করার ক্ষমতা শেষ হয়ে এসেছে, তখন আর ছবি আঁকার চেষ্টা করব না।

মামুন: কী করবেন তখন?

জাহাঙ্গীর: যদি পারি লিখব। শিল্পকলা নিয়ে কিছু লেখার চিন্তা আছে। যদি থাকে লিখব। আমাদের সময়ের শিল্পকর্ম এবং বর্তমান সময়ের তরুণদের শিল্পকর্ম নিয়ে লিখতে চাই।