এই সময়ের কবিতা

অনুভব

আবিষ্ট করে রাখে যে হৃদয়খানি

শান্তিতে কভু সে কাজ হয় না সাধা,

কিছুই আমার হয় না সহজে জানি;

নিয়ত শ্রমেই আমার নিয়তি বাঁধা।

অন্যেরা তবু মাতে উল্লাস নিয়ে

শান্তিতে কাজ সাঙ্গ হয়েছে ব’লে

মুক্ত করে সে নিজেকে বাহবা দিয়ে,

প্রার্থনা শেষে ধন্যবাদের ছলে।

আমি তো দ্বন্দ্বে জড়ানো অহর্নিশ,

উত্তেজনায়, স্বপ্ন অনিঃশেষে

জীবনের সাথে আমার হয় না মিশ

যায় না ইচ্ছা গড্ডলিকায় ভেসে।

স্বর্গকে ভাবি হৃদয়ভুক্ত হেন

বিশ্বকে আমি টানি আপনার মাঝে;

ভালোবাসা আর ঘৃণা দিয়ে চাই যেন

ভাগ্য আমাতে জ্বলুক দীপ্ত সাজে।

আমি চাই সব জয় করে নিতে, তাই

ঈশ্বরঢালা সকল আশিস দল,

সুপ্ত সকল জ্ঞান লভিতে চাই,

খুঁজে পেতে চাই সুর শিল্পের তল।

চিরতরে আমি চূর্ণ করেছি ধরা,

যেহেতু নিজের বিশ্ব পারিনি বানাতে,

মোর আহ্বান কখনো শোনেনি ওরা,

ব্যস্ত জাদুর মন্ত্রে বধির হানাতে।

মৃত ও বধির পালায় পলকে দূরে

অবজ্ঞা ছুড়ে আমাদের কৃতি দ’লে;

মোদের মতোই মোদের কর্ম পোড়ে—

বেপরোয়া ওরা ওদের পথেই চলে।

ওদের ভাগ্যে বখরা নিইনি তবু—

কখনো তেমন জোয়ার-ভাটায় ভেসে,

নিরর্থতায় ধাবিত হয়নি কভু,

ঘটাও যবে গিয়েছি মুচকি হেসে।

পতন ঘটেছে, ধ্বংস হয়েছে ঢের

পালাক্রমে কত কক্ষ দুর্গদ্বার;

শূন্যে মিলিয়ে যেতে না যেতেই ফের,

জন্ম নিয়েছে নবীন রাজ্য আর।

এমনি চলেছে বর্ষ বর্ষ ধরে,

শূন্য হইতে সর্বস্বের পানে,

দোলনা হইতে শববাহী খাট ’পরে,

শত উত্থান শত পতনের বানে।

আত্মাও তাই নিজের পথেই চলে

যতক্ষণ না সে সরাসরি পায় ক্ষয়,

ঈশ্বর আর মানব দম্ভ দ’লে

যদি না তাদের নির্মূল করা হয়।

তাহলে এসো না দুঃসাহসীর মতো

ছিঁড়ে ফেলি সেই ঈশ্বর আঁকা বৃত্ত,

ভাগ করে নিই সুখ ও দুঃখ যত

ভাগ্যমাপনী যেহেতু দোলায় মত্ত।

অতএব এসো ঝুঁকি নিই সমুদয়,

বিশ্রামহীন, বিরক্তিহীন চিতে;

নিরানন্দে নীরব বিষাদে নয়,

নয় কর্ম ও কামনার বিপরীতে।

আপন গহনে গুম হয়ে বসে নয়

দুখের জোয়ালে বশ্যতা মানা চুপে,

ইচ্ছা স্বপ্ন কর্ম সমুদয়

থেকে গেল বলে অসম্পূর্ণরূপে।

জ্ঞানসূত্র

ওয়ান্স ইজ ফর এভার—হেগেল

[যাহা দেখিতেছ, তাহা পূর্বের দেখা ও শোনা বিষয়, অথবা পূর্বের দেখা ও শোনা বিষয়ের সদৃশ]

যাজ্ঞবল্ক্য দার্শনিক তত্ত্বে

কত জ্ঞান, কত আলো,

তারও পরে প্রশ্ন থেকে যায়, পরম মেলে না।

এই পরম

কোথায় মেলে, কেউ বলতে পারে না;

আমি তাই জিজ্ঞাসার দ্বার খুলে রাখি,

স্মৃতিতে যা আসে তা নতুন জ্ঞান

নয়, পুরাতন বিজ্ঞানেরই পুনরাবির্ভাব

এত তত্ত্ব, এত জ্ঞান, মন তবুও ভরে না;

যাজ্ঞবল্ক্য,

উদ্দালকের কাছে যাই,

কী বলেন সনৎকুমার?

আমি,

মীমাংসা জানি না, বলি জ্ঞান শ্রেষ্ঠ, তৃষ্ণা মেটে না।

বাইরে যাব

আমরি বাংলা ভাষা

তোমাকে পাওয়ার আশায়

আকাশে চিৎকারিব

আমাদের গানের গলা

গোঙানির ধ্বনির মতো

গড়ায়ে পড়ল হেসে

কে যেন ডাকল মা গো

আমি কি বাইরে যাব

সাদেকের রক্ত খাব

এ রকম নোনতা দিনে

জানালায় গড়গড়াব

খোদা অই পাশের ঘরে

মায়েদের বাচ্চা মরে

আমি মূক স্বামীর মতো

অসীমের অন্ধকারে

আমরি বাংলা ভাষা

ভাষাহীন ভূমণ্ডলে

আমাকে উপড়ে ফেলে

কেটে দে শিকড়-বাকড়

কবিতা লেখব না আর

মা, আমি বাইরে যাব

পাহাড়ি অনুচর ও আমাদের ভালোবাসা

মানুষ পাহাড়ে যায়, পাহাড় আসে না।

যে কথা অপ্রকাশিত, লেখাও হবে না, শুনবে না কেউ, সেই কথা কুড়িয়ে নিতে শীত আসে অঘ্রানের শেষে। কথার পালক নিয়ে চলে যায় শীত, পাহাড়ের দিকে। মানুষের গোপন কথা জমিয়ে পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকে, অনড়। তার বহুদিন পর আমাদের হারানো নিশ্চুপ কথার কথা মনে পড়ে গেলে আমরা হইহই করতে করতে দল বেঁধে পাহাড়ে বেড়াতে যাই। আমরা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকি, বুঝতে চেষ্টা করি, উপত্যকার কোন ভাঁজে আমাদের সেই কথা লুকিয়ে আছে, যা আমরা কাউকে বলিনি বলেই একদিন শীত এসে নিয়ে গেছে সংগোপন শ্বাসপ্রশ্বাস!

যাকে বলি বিহ্বলতা, নির্ঝর নৈকট্য কামনা, যাকে বলি ভালোবাসা, অন্তরঙ্গতা, তাকে আমরা হারিয়ে ফেলি একদিন। তারপর হারানোকে খুঁজে পেতে পাহাড়ে গিয়ে দেখি, পাহাড় রহস্য করছে, থমকে থাকা কুয়াশার সঙ্গে জমিয়ে গপ্পো করছে। পাহাড় ভ্রুক্ষেপই করছে না, কে আমরা, কোথা থেকে এসেছি, কী আমাদের চাওয়া, আমাদের কী হারানো গেছে?

আবারও শীত আসছে, পাহাড়ের অনুচর হয়ে। এবং পাহাড় আসবে না, হারানো কথার সন্ধানে আমাদেরই রহস্য-বাঁকের পাহাড়ে যেতে হবে।

মুয়িন পারভেজ

আকিরা কুরোসাওয়ার প্রতি

আজও দস্যু আসে পউষ মাসে, ফসল কাটার দিনে

ধানসবজি সবই যে নেয় ন্যায্যদামে কিনে

ওরা জোর করে না

ওরা জোর করে না, বেচাকেনা খুবই পরিপাটি

ওজনে নেই কারচুপি, ভাই, মানুষ ওরা খাঁটি

নেই ছলচাতুরী

নেই ছলচাতুরী, বাহাদুরি, কেবল নেশার ঘোরে

একটু গালিগালাজ বা কান ম’লে দেওয়া জোরে

তাই পলে পলে

তাই পলে পলে আজ সকলে ওদের আশায় ঘামে

নইলে ভালো কাপড়-খাবার জোটে না গেরামে

বলি আসল কথা

বলি আসল কথা, এমন প্রথা-দস্যুতা চায় চাষি

বউ-ঝিরাও ভালোবাসে দস্যুরাজের বাঁশি

তবু কয়েকজনে

তবু কয়েকজনে সংগোপনে শহরপথে যাই

দেখেশুনে খুঁজে আনি সপ্ত সামুরাই

ওদের চুল পেকেছে

ওদের চুল পেকেছে, বেড়ে গেছে বয়েস যেন শীতে

দিনে ওরা থাকে মাঠে, রাত্তিরে ছাউনিতে

ওরা ঢাল-তলোয়ার

ওরা ঢাল-তলোয়ার ফেলে এবার কাস্তে হাতে নিয়ে

কালি মেখে ভূত সাজবে শিশুর দলে গিয়ে

ওদের নেই অপমান

ওদের নেই অপমান, নেই পিছুটান; হয়তোবা চুপ মেরে

খড়ের গাদায় শুয়ে শুয়ে শুনবে, ‘হা রে রে রে’

এ আয়োজনে দুটি অলংকরণ করেছেন: সব্যসাচী মিস্ত্রী