ঠিক দুপুরবেলা

গোরস্থানে বসে ভেজি বার্গার খাইতেছি। আচ্ছা, আমি তো সেমেটারি বলতে পারতাম অথবা কবরস্থান...গোরস্থান কেন বললাম? এর মধ্যে একটা গা ছমছম করা ভয় ভয়–টাইপ ভাব আছে, না? এই জায়গাটা অন্য রকম। বহু আগে এই এলাকার কবরস্থান ছিল এইখানে, ছড়ানো–ছিটানো কবরগুলি আছে। মাঝে মাঝে গাছ, দুই–একটা বেঞ্চ। এই অক্টোবরের শুরুতে মেলবোর্ন শীত থেকে ঝাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করছে, অফিশিয়ালি যদিও বসন্ত শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে। গাছগুলিতে নতুন পাতা, এলোমেলোভাবে মৌসুমি ফুলের বীজ ছিটানো হইছিল, এখন রং–বেরঙের ফুল ফুটে আছে শেওলা ধরা প্রাচীন কবরগুলিকে ঘিরে, দেখলেই ফররুখ আহমদের কবিতার লাইন মনে পড়ে ‘কাফনের পাশ দিয়ে বেজে চলে দৃঢ় পাখোয়াজ...’।

রাস্তার কাছাকাছি ঠিক ঢোকার মুখে বাচ্চাদের পার্কমতন, বিকালের দিকে আসে ওরা। দুপুরবেলায় কেউ আসে না। এটা বলতেছি গত তিন সপ্তাহের অভিজ্ঞতা থেকে। চাকরিটা ছাড়ার পরে বাসার কাউকেই বলি নাই, হুদাই অনেকগুলি কথা বলতে হবে, ভাল্লাগে না। তাই রোজ রোজ ঠিকঠাক তৈরি হয়ে বাসা থেকে বের হই। উল্টাপাল্টা চক্কর দিতে থাকি। কিন্তু দুপুরবেলায় আমার বর্তমান স্থায়ী ঠিকানা এইখানে। হাংরি জ্যাকস থেকে একটা ভেজি বার্গার আর এক কাপ কফি নিয়ে এইখানে এসে বসি, গাছের কচি সবুজ পাতার ফোকর থেকে দুপুরের রোদ ছেঁকে আসে আর কবরের চিড় ধরা সিমেন্টের ওপরে গড়াগড়ি খায়, পাতার ছায়া পড়ে, ঘাসের ওপর দিয়ে বাতাস সরতে থাকে, পাখিরা ঘোরেফেরে, ওড়ে, দোল খায়। এই সবই ভালো লাগে। মাটির ওপরের মানুষ থেকে মাটির নিচের মানুষেরা অনেক আরামদায়ক।

বোঝা বয়ে তিন মণ ওজনের একটা বই নিয়ে আসছি যদিও, কিছুই পড়ি নাই। ঘাসের ওপরে বই, তার ওপরে কফির টেক অ্যাওয়ে কাপ। টুং টাং করে মেসেজ আসতেছে ফেসবুক মেসেঞ্জারে। আমার অল্প পুরান প্রেমিক বেড়াতে গেছে অতি পুরান প্রেমিকের বাড়িতে—নিউইয়র্ক থেকে নিউ জার্সি। এরা দুইজনেই কবি। অতি পুরান এত দিনে বিয়ে করে সংসারি এবং এক বাচ্চার বাপ। অল্প পুরানও সেই পথে পা বাড়াইছে, আংটিবদল হয়ে গেছে। দেখলাম আমার প্রেমের এই একটা আছর আছে। প্রেম ছোটার সাথে সাথেই এরা একনিশ্বাসে বিয়ে করে ফেলে। আমি তাই নিজের পরিচয় দিতে পারি সমাজসেবী হিসেবে। যাদেরই বিবাহযোগ্য ছেলেরা বিয়ের বিষয়ে গাঁইগুঁই করতেছে, অথবা বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইতেছে, তাদের আমার হাতে ছেড়ে দিলেই ঠিক করে দেব একদম।

অল্প পুরানের সাথে আমার যোগাযোগ মোটামুটি অব্যাহত, অবশ্য ফর্ম বদলাইছে। এখন বেশির ভাগ সময় তার বিয়ে নিয়ে আলাপ হয়, ফিঁয়াসের ছবি দেখি, বিবাহিত জীবন সম্পর্কে অভয় দিই; যেহেতু সে জীবনও আমি কাটাইছি কয়েক বছর। অতি পুরানের সাথে সরাসরি কথা না হইলেও একে অপরের ফেসবুক পোস্টে মাঝে মাঝে লাইক দিই।

অল্প পুরান লিখছে, অতি পুরান ঘরে ঢুকল।

লিখলাম, ওরে একটা চুমা দাও।

একটা হাসিমুখের ইমো দিলাম, আসলে হাসলাম না। ফোনটা নামায়ে রাখলাম, এর সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেমনে কথা বলতাম? এখন তো নাম দেখলেই হাই আসে! কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উঠতেছে। সাধারণত হাংরি জ্যাকসের কফি হয় কুসুম গরম। আমি অর্ডার দেওয়ার সময় বলি এক্সট্রা হট দিতে, সেটাও অনেকেই পারে না। কফিতে চুমুক দিলাম, খুবই ভালো বানাইছে। তারপরে মুখের সামনে কাপ নিয়ে দেখলাম ধোঁয়ার আড়ালে দুনিয়া কেমন কাঁপতে থাকে, যেন তরল, বাষ্প হয়ে মিলাইতে চাইতেছে।

হঠাৎ দেখি একটু দূরে, চার–পাঁচটা কবরের ওই পাশে ঝোপের আড়াল থেকে একটা অবয়ব নড়তে নড়তে বড় হইতেছে, তখনো কফির ধোঁয়ার আড়াল থেকে দেখতেছিলাম বলে মনে হচ্ছিল চেরাগের দৈত্য বের হয়ে নিজের সাথেই ডিবেট করতেছে যে রূপ বদলায়ে কঠিন হবে, নাকি বায়বীয়ই থাকবে। কাপ নামায়ে খেয়াল করলাম একজন হেঁটে আসতেছে, মাঝে মাঝেই লম্বা গাছের আড়ালে চলে যাইতেছে, সূর্যের দিক থেকে আসতেছিল বলে চেহারা স্পষ্ট হচ্ছিল না। আরেকটু কাছে আসলে বুঝলাম গায়ের চামড়া বাদামি, তবে পোশাক রীতিমতো পশ্চিমা ফর্মাল অ্যাটায়ার—সাদা শার্ট আর কালো রঙের থ্রিপিস স্যুট, একটা বো টাইও আছে। এত সেজেগুজে এই দুপুরবেলায় কই থেকে আসতেছে সে? এ রকম কাপড় তো লোকে বিয়েতে পরে, নয়তো ফিউনেরালে। কাছেই অবশ্য একটা চার্চ আছে। তার চলাফেরায় একটা হারায়ে যাওয়া ভাব। একটু দুলে দুলে আলতো হাঁটতেছে, যেন সে একটা পাখি, যেন মাত্র হাঁটতে শিখছে।

হাঁটার ভঙ্গিতে জামিকে মনে পড়ল। একবার, তখনো তার সাথে প্রেম হয় নাই। ওর লেটেস্ট প্রেমিকার সাথে বেড়াতে গেছিল। গাড়ির ভেতরে সিগারেট ধরাইছে, প্রেমিকা তাকে আলটিমেটাম দিল, ‘আমি, না সিগারেট?’, জামি যথারীতি জবাব দিল, ‘সিগারেট।’ তত দিনে ওর এই সব কীর্তিকলাপে মেয়েটা যথেষ্টই অতিষ্ঠ। ওরে গাড়ি থেকে নামায়ে দিল সেই জিলংয়ের কাছে। শহর থেকে গাড়িতে এক ঘণ্টার রাস্তা, আমাদের বাসা থেকে দেড় ঘণ্টা। শীতের রাত্রি আর ততক্ষণে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ হয়ে গেছে। জামি এদিক–সেদিক কয়েক ঘণ্টা চক্কর দিয়েও বের হওয়ার পথ না পেয়ে রাত দুইটার দিকে ফোন করে বলে, ‘জেবা, আমি তো হারায়ে গেছি, আমার বাসা কোথায়?’ তখন ওরেই ঠিকমতন চিনি না, ওর বাসা চিনব কেমনে?

অথচ মাত্র ঘুম ভেঙে ওর কণ্ঠস্বর শুনেই মনে মনে দেখতেছিলাম ও সেই পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে হয়রান হয়ে রাস্তার মাঝখানে বসে পড়তেছে। ড্রাইভার হিসেবে আমি বেশ খারাপ, কোনোমতে চোখেমুখে পানি ছিটায়ে বের হলাম তারে উদ্ধার করতে। তখন তো আর জিপিএস ছিল না, আমি ম্যাপও দেখতে জানতাম না। এক শবার হারায়ে যখন ওরে খুঁজে পেলাম, তখন প্রায় ভোর, মহা আরামে একটা বাসস্টপের বেঞ্চে শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। ডাক দিতেই চরম বিরক্ত মুখে চোখমুখ কুঁচকায়ে বলল, ‘ব্যাক্কল নাকি তুই? কাঁচা ঘুম থেকে এমনে উঠাইতে হয়? যাহ্​ চা নিয়া আয়!’ আমি টাশকি খেয়ে কতক্ষণ ওর দিকে তাকায়ে থেকে যখন সত্যিই চায়ের খোঁজ করতে রওনা দিছি, সে হাসতে হাসতে আমার হাত ধরে টেনে পাশে বসায়ে এক হাতে বেড় দিয়ে জড়ায়ে ধরল। মনে হচ্ছিল ওর কাঁধ আর গলার মাঝের খালি জায়গাটুকুতে আমার মাথাটা জিগ-স পাজলের মতন ক্লিক করে বসে গেছে। আমার পিঠে আলতো হাত বোলাচ্ছিল আর কপালে ওর খোঁচা খোঁচা দাড়ির ঘষা লেগে একটা গা শিরশির ভাব। শীতের সকালের শিশির আর ধুলা মেশানো অদ্ভুত একটা গন্ধ থাকে, যেন বহু আগের কোনো সময় বয়ে নিয়ে আসতেছে, সেই সাথে ওর গায়ের গন্ধ মিলে বেহুঁশ–বেহুঁশ লাগতেছিল। আত্মা কাঁপতেছিল আর তা সারা শরীরে ছড়ায়ে যাচ্ছিল...। মনে মনে ভাবলাম, এরে আমি সারা জীবন দেখেশুনে রাখব, হাঁটার সময় ধরে রাখব। অনেক পরে বুঝতে পারছি, আমার ভাবনাগুলি আমারই ছিল, যার যার হাঁটা সে নিজেই হাঁটে।

এতক্ষণে আমার একদম সামনে এসে দাঁড়াইছে লোকটা। দেখলাম ওয়েস্ট কোটে চেইন লাগানো একটা পকেটঘড়ি। এ রকম ঘড়ি শুধু সাদা–কালো ইংরেজি সিনেমায় দেখেছি। খুব বিনীত ভঙ্গিতে একদম পুরোনো দিনের ইংলিশে বলল, ‘আমি কি কিছুক্ষণ আপনার পাশে বসে আপনার সঙ্গলাভের আনন্দ পেতে পারি।’ আমি হেসে দিয়ে বললাম, ‘পেতে পারেন।’ বসতে বসতে তার নজর গেল আমার পাশে রাখা বইয়ের মলাটে, স্পষ্ট বাংলায় পড়ল মধ্যরাতের অশ্বারোহী। একটু চমকায়ে তাকাইলাম, ‘আপনি বাঙালি নাকি?’

‘হা হা, অর্ধেক, আমার মা ছিলেন কলকাতার আর বাবা পাঞ্জাবের। আমি বড় হইছি অমৃতসরে।’

একটু কোনাকোনিভাবে আমার পাশে বসছে। খুব পরিচ্ছন্ন দেখতে, ঘাসে হাত বুলাইতে থাকা আঙুলগুলি লম্বা লম্বা, সুন্দরভাবে নখ কাটা, কোথাও ময়লা নাই। গায়ের সাদা শার্টটা এতটাই ধবধব করতেছে যে মনে হয় লন্ড্রি ডিটারজেন্টের বিজ্ঞাপন। বসছে যেন ভাসতেছে, যেন তারে ভেদ করেই ওইপাশের গাছগাছালি নজরে আসবে। তার কাছ থেকে ঘাস, ফুল আর শেওলা মেশানো অদ্ভুত জলজ একটা গন্ধ পাইতেছিলাম।

‘তোমার নাম কী?’ লোকটা জানতে চাইল বাংলায়। কাছ থেকে দেখে বুঝলাম যত কম বয়সী মনে হইছিল ততটা না, অন্তত পঁয়তাল্লিশের ওপরেই হবে। চুলও পাকতে শুরু করছে, সল্ট অ্যান্ড পেপার। সে আমারে তুমি বলাতে বেশ ভালো লাগল।

‘জেবুন্নেসা, সবাই জেবা ডাকে।’

‘বাহ্, বাহ্শাহজাদী জেবুন্নেসা! কে ছিল জানো তো?’

‘আওরঙ্গজেবের মেয়ে।’

‘হ্যাঁ, আরেকটা পরিচয়ও ছিল তাঁর—কবি ছিলেন, সুফিয়ানা কবিতা লিখতেন।’

‘তাই নাকি? আপনি কবিতা পড়েন?’

‘পড়তাম তো, জেবুন্নেসার কবিতাও পড়েছি।’

‘বলেন তো...’

‘তাহলে একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি, এটা সেই মিড ১৬০০–এর কথা। তখনকার পারস্যদেশে কবিরা মুখে মুখে শায়েরি লিখত। মাঝে মাঝে একজনের শুরু করা মিসরা বা লাইন আরেকজন শেষ করতেন...’

‘হ্যাঁ এই রকম শুনছিলাম, মসজিদে কবিতার লাইন লিখে রেখে আসত, না?’

‘রাইট, তো একটা এ রকম লাইন ঘুরতে ঘুরতে জেবুন্নেসার কাছে চলে এল—দোররে আবলাক কিসি কাম দিদা মওজুদ...’

‘মানে?’

‘আবলাক একরকমের মুক্তা, বলা হচ্ছে, এত সুন্দর আর কী আছে পৃথিবীতে...। জেবুন্নেসাও মনে মনে লাইনটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছেন—এ রকম ভাবতে ভাবতেই একবার স্নান শেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে সুরমা পরছিলেন, এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল গালে, আর তিনি পরের লাইন লিখলেন—মাগার আশেক বোতানে সুরমা আলুত...।’

‘সুরমা তো বুঝলাম...মাগার মানে কিন্তু...আর?’

‘সুরমা মেশানো প্রেমিকার চোখের পানি তার চেয়েও সুন্দর...’

‘হা হা, নিজেই নিজেরে দেখে মুগ্ধ? এইটা কি সত্যি ঘটনা?’

‘হতেই পারে। তাঁর পেন নেম ছিল মাখফি, মানে যে লুকানো থাকে। একবার তাঁর সাথে দেখা করার জন্য একদল কবি আসলেন সম্রাটের দরবারে। জেবুন্নেসা ছিলেন পর্দানশিন, তাঁদের সাথে দেখা না করে লিখে পাঠালেন, ‘দার সাকুনে মাখফি মানাম/ চুঁ বুঁয়ে গুল দার বুর্গে গুল/হার কে খাহি দিদারে মান/হার সাকুন দিদা মোরা/

জেব ও জিনাত বাস হামি নাম/নামে মান জেবুন্নেসাস্ত...।’

‘অর্থ বলেন।’

‘যেভাবে গোলাপের খুশবু লুকিয়ে থাকে ফুলের ভেতর, আমিও আমার কবিতার ভেতর আছি, যে আমায় দেখতে চায়, সে আমার কবিতা দেখুক। রূপ ও যৌবন মানেই আমি, আমার নাম জেবুন্নেসা!’

‘পুরাই তো দেখি আমার মতন কথাবার্তা।’

‘নামের কিছু ইম্প্যাক্ট তো থাকেই!’ হাসতে হাসতে বলল লোকটা। ততক্ষণে প্রায় বিকাল, আমি হাঁ করে দেখতেছিলাম তার চোখ কী সুন্দর ঝিকমিক করে, লম্বা চোখের পাপড়ি!

‘আপনার নাম কী?’

‘মহেন্দ্র, তবে এই দেশে লোকে আমার মিডল নেম ধরে ডাকত, কুমার।’

‘কই থাকেন আপনি?’

‘এখানেই তো।’

‘এত ড্রেসড আপ যে?’

‘হা হা, তোমার সাথে দেখা হবে জানতাম তো!’

‘বলছে! কী করেন আপনি এমনিতে?’

‘কিছুই না!’

‘বাহ, আমিও তো! হাত মিলান!’ সে একটু হেসে আমার হাত ধরল, ধরেই থাকল। কী ঠান্ডা আর নরম হাত, তার স্পর্শ শান্তির মতন আমার রক্তের ভেতরে মিশতেছিল।

‘আপনার বউ নাই?’

‘ছিল তো...অন্য আরেক জীবনে। অমৃতসরে ছিলাম তখন। তোমার কথা বলো।’

‘আমারও, সে অনেক অনেক দিন আগের কথা।’

‘তখন মানুষ কাঁচা মাংস খেত?’

‘না না, তার চেয়ে আরেকটু পরে, এই ধরেন জেবুন্নেসা মানে আমাকে তো আমার বাবা আওরঙ্গজেব বন্দী করে রাখছিলেন, না? তো আমি লুকায়ে লুকায়ে চলে আসলাম মেলবোর্ন...।’

‘তারপরে?’

‘মহা প্রেমে পড়লাম, বিয়ে করলাম...আমরা খুব গরিব ছিলাম, মানুষের ফেলে দেওয়া জিনিসপাতি নিয়ে এসে ঘরে তুলতাম। একটা টিভি ছিল এমন ঘোলা, ওইটাতে কিছুই ঠিকমতন বোঝা যাইত না। একবার জামির মামার বাসায় নরমাল টিভি দেখে পুরা তাজ্জব হয়ে গেছিলাম, আরে টিভি এমন হয়?’

‘১৬০০ সালে টিভি কোথায় পেলে?’

‘আহ্​ হা, নেভার লেট ট্রুথ গেট ইন দ্য ওয়ে অব অয়া গুড স্টোরি। আপনার বউয়ের কথা বলেন।’

‘তাকে ঠিকঠাক চেনার সুযোগই পাই নাই। ধরো সময়টা ছিল ১৯৩০–এর এদিক–সেদিক। তখনো ভারতে ইংরেজদের রাজত্ব। আমি মাত্র ডাক্তারি পাস করেছি, মহুয়া ছিল বাঙালি, আমার মায়ের বাচপানের বন্ধুর মেয়ে। তোমার মতোই দেখতে ছিল, এইরকম আহ্লাদি গোলগাল চেহারা, বড় বড় চোখ...সুন্দর হাসি...।’

‘আপনি বউয়ের কথা বলতেছেন না আমার সাথে ফ্লার্ট করতেছেন?’

‘এক ঢিলে দুই পাখি, হা হা! মহুয়াকে আমার খুব ভালো লাগত, তবে প্রেম বলতে যা বোঝায়, সে রকম কিছু ছিল না। তত দিনে আমার বাবা গত হয়েছেন। মায়ের উৎসাহে বিয়ে হলো। এক মাস অনেক রকম পারিবারিক আচার পালন করতে করতেই কাটল। এত লোকের মধ্যে নিজেরা কাছে আসার সুযোগই হচ্ছিল না।’

‘তারপর?’

‘একবার গেলাম মানালিতে, ওইখানে গুরুদুয়ারা আছে, সেখানে প্রার্থনার জন্য। সেই প্রথম আমাদের একসাথে কোথাও যাওয়া। তিনটা দিন স্বপ্নের মতন ছিল, সারা দিন ঘুরতাম, সারারাত প্রেম করতাম। মানালিতে শেষ দিনটা ভীষণ ঘোরাঘুরি করে দুজনেই ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে শুয়ে পড়লাম। মহুয়ার মাথা আমার কাঁধে, আমি ওর চুলে বিলি কাটছিলাম, ওর গায়ে লেবুর গন্ধের মতন একটা গন্ধে আমাকে আচ্ছন্ন করছিলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়লাম, জানি না। সে–ই আমাদের একসাথে শেষ ঘুম...।’

‘মানে?’

‘মহুয়া আর উঠল না। ঘুমের ভেতর কখন চলে গেছে, আমি টের পাইনি, আমার ডাক্তারি বিদ্যা ওকে ধরে রাখতে পারল না...সেই সকালের প্রতিটা ঘটনা, প্রতিটা দৃশ্য এখনো আমি পরিষ্কার দেখতে পাই।

আমি তার মুখের দিকে তাকায়ে ছিলাম, কী রকম দুঃখী চেহারাটা, কিছুই বলতে পারলাম না আমি।’

‘বহু কষ্টে একটা গাড়ি জোগাড় করতে সারা দিন গেল। মানালি থেকে অমৃতসর বারো ঘণ্টার পথ গাড়ির পেছনের সিটে ওর মাথা কোলে নিয়ে আমি এসেছি। মনে হচ্ছিল ও ঘুমাচ্ছে আমার কোলে। চাঁদ ছিল, ওর মুখে আলো পড়ছিল...সব মনে আছে আমার।’

‘তারপরে?’

খুব অস্পষ্ট করে হাসল মহেন্দ্র, ‘এই তো, আমার মা বেঁচে ছিলেন আরও দশ বছর, আমিও তাঁর কাছে ছিলাম। তারপরে চলে আসলাম। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, আমি ডাক্তার, আমাকে এদের দরকার ছিল।’

এতক্ষণে মনে পড়ল আমরা তো গল্প গল্প খেলতেছিলাম। সত্যি সত্যি এ রকম হয় নাকি?

‘শোনেন, বিকাল কিন্তু হয়ে যাইতেছে, এখন দলে দলে বাচ্চারা আসবে। চলেন উঠি। কালকে আসবেন?’

‘চেষ্টা করব, এই সব তো আমার হাতে না।’

‘আপনার ফোন নম্বরটা লিখে দেন এইখানে।’

বইটা আগায়ে দিলাম কলমসহ, সে–ও লিখল।

তারপরে আমার হাত ধরে টেনে তুলল। একসাথে হেঁটে কিছুদূর গিয়েই মনে পড়ল ফোনটা আনতে ভুলে গেছি। ‘একটু দাঁড়াবেন, ফোনটা আনি।’ মাথা ঝাঁকায়ে হাসল। আমি দৌড়ায়ে ফোন তুলে নিয়ে ফিরে দেখি কেউ নাই। আরে কই গেল? এদিক–ওদিক খুঁজলাম। বই খুলে নম্বর নিতে গিয়ে দেখি লেখা, ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক...’। ওই দিক থেকে আসছিল না? হেঁটে গেলাম।

এইখানেও একটা কবর? এইটা তো দেখি নাই আগে! ঝোপঝাড়ে দূর থেকে দেখা যায় না। দেখি নামের ফলকে লেখা ‘এম কে সিং (১৮৯০—১৯৪৬)।