দুই কবির দুই শহর

সম্প্রতিক কালে পিয়াস মজিদের সম্পাদনায় দুটি চমৎকার বই বেরিয়েছে প্রথমা প্রকাশন থেকে। একটি শামসুর রাহমানের আমার ঢাকা, অন্যটি বেলাল চৌধুরীর আমার কলকাতা। বই দুটি বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা বড় স্মার্টফোনের মতন—সুমুদ্রিত, পরিপাটি এবং বলা ভালো, দুটি বইয়েরই নান্দনিক প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী রফিকুন নবী।

প্রথমটি—আমার ঢাকা বইয়ে স্থান পেয়েছে কবি শামসুর রাহমানের ঢাকা-আসক্তি নিয়ে কিছু সুসংগৃহীত নিবন্ধ ও কবিতা। আর দ্বিতীয়টি—আমার কলকাতা শিরোনামের বইয়ে রয়েছে আমাদেরই আরেক ‘বোহেমিয়ান’ কবি বেলাল চৌধুরীর কলকাতা-প্রেমের গদ্য ও কবিতার সংগ্রহ।

প্রথমটি পড়লে মনে হবে ঢাকা শহর না থাকলে শামসুর রাহমানের কবি-জন্ম হতো না, ঢাকা শহরের মাটি থেকেই তিনি গড়ে উঠেছেন ধীরে ধীরে। আর দ্বিতীয়টিতে বেলাল চৌধুরী দিশেহারা যৌবনে অনেকটা ভাগ্যান্বেষণে ভিন্ন রাষ্ট্রের এক শহরে গিয়ে তাঁর পুরো প্রেম উগরে দিচ্ছেন। রাষ্ট্র ভিন্ন হলেও শহর কলকাতা তো বাংলা ভাষার নাড়ির সঙ্গে যুক্ত।

ঢাকা শামসুর রাহমানের জন্য ‘ভালোবাসার শহর। এ শহর ছেড়ে পৃথিবীর অন্য কোনো শহরে বেশি দিন থাকতে পারব না।’ আমার ঢাকার ‘আমার জন্মশহর, স্মৃতির শহর’ নিবন্ধে রাহমান যেমন জানাচ্ছেন: ‘পুরানো ঢাকায় আমি পুরানো ইতিহাসের নিশ্বাস ও দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাই।’ এই বইয়ের পনেরোটি নিবন্ধের মধ্যে পাওয়া যাবে কবির গড়ে ওঠার একটা ধারাবাহিক চিত্র। তিনি এই শহরেই মানুষ হয়েছেন বলে আমরা তাতে পাই নগুরে বৈদগ্ধ, ইট–সুরকির গন্ধ, পাই ‘বিউটি বোর্ডিং’-এর কথা, পাই ‘শরৎ চক্কোত্তি রোডে, মাহুতটুলীর খোলা ছাদে’ চলে যাওয়ার আহ্বান (‘দুঃসময়ে মুখোমুখি’)। চক্রবর্তীর প্রাকৃত-তদ্ভব ‘চক্কোত্তি’র ব্যবহার মনে রাখার মতো। আর ‘বিউটি বোর্ডিং’ জানাচ্ছে ‘চায়ের পেয়ালা সামনে রেখে/উঠতাম মেতে/পাউন্ড, স্পেংলার, টোয়েনবি, মার্ক্স, উত্তর-রৈবিক/কবিতার দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে প্রত্যাগত/নাবিকের ধরনে।’ এ রকম কাব্যিক বর্ণনায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘সংবর্তে’র কথা মনে পড়বে কারও কারও।

বেলাল চৌধুরীর কলকাতা-প্রেম বাংলা সাহিত্যের একটা অভূতপূর্ব ঘটনা। নানান কারণে দাউদ হায়দার বা তসলিমা নাসরীনের মতো যাঁরা দেশ ছেড়ে বিদেশবিভুঁইয়ে গেছেন, বেলাল চৌধুরী তাঁদের থেকে ভিন্ন। পঁচিশ বছর বয়সে জাপানি মাছ ধরার ট্রলারে কাজ নিয়ে পকেটে কাঁচা টাকা ভরে কলকাতায় নামেন তিনি। আর এক যুগ সেখানকার নগরজীবনের সঙ্গে, বিশেষ করে কবিকুলের সঙ্গে দারুণভাবে মিশে যান। বেলাল প্রসঙ্গে কলকাতার কবি কবিতা সিংহ বলেছেন, তাঁর জন্য ‘আমাদের সকলের ঘরেই চাল মাপা থাকত’। আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেলালকে ঠাউরিয়েছিলেন ‘ছদ্মবেশী রাজকুমার’ বলে।

আমার কলকাতা গ্রন্থে স্থান পেয়েছে ছয়টি নিবন্ধ আর সাতটি কবিতা। এর প্রথমটি ‘আমার কলকাতা’। তবে এ বইয়ের সবচেয়ে বড় লেখাটি ‘কলকাতার দিনরাত্রি’; আছে ‘কফি হাউস: চন্দ্রাহত এক রাতে’। তা ছাড়া কলকাতায় যেহেতু বেলাল চৌধুরী পুরো ১৯৭১ সাল কাটিয়েছেন, তাই ‘কলকাতায় একাত্তর’ তো প্রাসঙ্গিকভাবেই থাকবে।

‘কলকাতাকে’ কবিতায় বেলাল লিখেছেন: ‘প্রাচীন আর্য কিংবা দ্রাবিড় সভ্যতার দান নও/ফিরিঙ্গি বণিকের উদগ্র লালসায় লালিত তুমি/লাস্যময়ী নটীর মতো ডাগর হয়েছ দিনে দিনে/তুমি আমার বিনাশ ও বেদনা তুমি আমার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ—/তুমি আমার উত্থান-পতনের স্বর্গনরক’।

আমার ঢাকা ও আমার কলকাতার সুলিখিত ভূমিকাতেই পাওয়া যাবে বই দুটির সারবত্তা। দুই কবির কেউই ঢাকা কিংবা কলকাতা নিয়ে এ ধরনের বই লিখবেন, এটা ভাবা যায়নি। তবে দুজনই বিভিন্নভাবে এবং নানা সময়ে, ঢাকা ও কলকাতা সম্পর্কে তাঁদের হৃদয়ের ভাব ও ভাবনা প্রকাশ করে গেছেন। একজন ঢাকায়, বিশেষ করে পুরানো ঢাকায়, ‘ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাস’ শুনতে পান, অন্যজনের কাছে কলকাতা তাঁর ‘বিনাশ ও বেদনা’, ‘ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ’। সম্পাদক পিয়াস মজিদ দুজনের বিস্তৃত সাহিত্য থেকে সেসব সামগ্রী উদ্ধার করে দুটি বইয়ের আকৃতি দিয়ে একটা বিরাট দায়িত্ব সমাপন করলেন। আর প্রথমা প্রকাশনকেও ধন্যবাদ জানাতে হবে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে তা সুপাঠ্য হিসেবে পাঠকের কাছে উপস্থাপনের জন্য। এ–জাতীয় প্রকাশনা এ জন্যই প্রয়োজনীয় যে ভবিষ্যতের কোনো একদিন যদি বাংলাভাষীদের অসমাপ্ত রেনেসাঁ পরিপূর্ণতা পায়, তখন ঢাকা ও কলকাতাই তার প্রধান ঐতিহাসিক কেন্দ্র হিসেবে সমাদৃত হবে।

আমার ঢাকা

শামসুর রাহমান

প্রচ্ছদ: রফিকুন নবী, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০১৮, ১৩৬ পৃষ্ঠা, দাম: ২৮০ টাকা।

আমার কলকাতা

বেলাল চৌধুরী

প্রচ্ছদ: রফিকুন নবী, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০১৮, ১৪৫ পৃষ্ঠা, দাম: ২৮০ টাকা।