ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে যত কথা

স্মৃতিতে ওয়ালীউল্লাহ
স্মৃতিতে ওয়ালীউল্লাহ

স্মৃতিতে ওয়ালীউল্লাহ
সৈয়দ আবুল মকসুদ
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
প্রথমা প্রকাশন
১৩৬ পৃষ্ঠা
দাম ২০০ টাকা
বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। মাত্র ৪৯ বছরের এক জীবন তাঁর—সাহিত্যজীবন আরও ছোট। লিখেছেন কম, দেশে থেকেছেন স্বল্প সময়, কর্মজীবনের প্রায় সবটাই কাটিয়েছেন বিদেশে। নিজেকে সব সময় আড়াল করে রাখতে ভালোবাসতেন। এড়িয়ে চলতেন প্রচার-উৎস। এসব কারণে লেখকদের লেখক হিসেবে পরিচিত ওয়ালীউল্লাহকে নিবিড়ভাবে জানার সুযোগ হয়নি বাঙালি পাঠকের। এত দিন তাঁর জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় প্রায় অজ্ঞাতই ছিল আমাদের। তবে কয়েকজন গবেষকের নিরন্তর প্রচেষ্টায় ওয়ালীউল্লাহর নানা প্রান্ত পাঠকের সামনে এসেছে। সৈয়দ আবুল মকসুদ এমনই একজন গবেষক, যিনি ওয়ালীউল্লাহকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পালন করেছেন পথিকৃতের ভূমিকা।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদের সাম্প্রতিক গ্রন্থ স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, যা প্রকাশিত হয়েছে ২০১৪-এর একুশের বইমেলায়। বইটিকে ঠিক স্মৃতিকথা বলা যাবে না, বলা যাবে না নিটোল কোনো গবেষণাগ্রন্থ; বরং স্মৃতিকথা আর গবেষণার মিশ্রণ হিসেবেই এটি বিবেচ্য। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায়, গ্রন্থটির ফরম বা রূপকল্প সম্পর্কে লেখকের এই ভাষ্য: ‘প্রাকরণিক দিক থেকে এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী বই। গবেষণামূলকও বটে, স্মৃতিকথাও বটে। সে স্মৃতিকথা এই বইয়ের লেখকের নয়, যাঁর সম্পর্কে লেখা তাঁরও নয়—অন্যদের, ঘনিষ্ঠদের।’
নিষ্ঠ গবেষক হিসেবে সৈয়দ আবুল মকসুদের যে খ্যাতি, সেটা বর্তমান গ্রন্থেও সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। ওয়ালীউল্লাহকে চিনতেন কি জানতেন—এমন অনেক গুণী ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি সংগ্রহ করেছেন নানা উপাদান, গ্রহণ করেছেন তাঁদের সাক্ষাৎকার, তথ্য সংগ্রহের জন্য ছুটে গেছেন প্যারিসে অবস্থিত ইউনেসকোর সদর দপ্তরে, গিয়েছেন পাকিস্তানে। আবুল মকসুদ নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে যেসব তথ্য পরিবেশন করেছেন, তাতে এখন এই কথাশিল্পীর একটি পরিশীলিত ও পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখা সম্ভব। তবে এ বই কেবল ওয়ালীউল্লাহকে জানতেই আমাদের কাছে সহযোগ বিস্তার করে না, একই সঙ্গে তা সমকাল ও তাঁর পারিপার্শ্বিক লোকজনের চিনতেও সহায়তা করে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে আবিষ্কার করার জন্য এ গ্রন্থের লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ ওয়ালীউল্লাহর সমসাময়িক লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিকথা ও আলোচনার ওপর নির্ভর করেছেন। মকসুদ বিশ্বাস করেন, ‘কোনো লেখকের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করতে গেলে শুধু কাগজপত্রের ওপর নির্ভর করা নয়, যদি সম্ভব হয় তাঁর সমসাময়িক ও ঘনিষ্ঠদের সঙ্গেও কথা বলতে হয়।’ এ উদ্দেশ্যেই তিনি ওয়ালীউল্লাহ্র পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, ঘনিষ্ঠজন কিংবা সমসাময়িক অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেসব কথার নির্বাচিত অংশ নিয়েই প্রথমা প্রকাশনের বই স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ।
ওয়ালীউল্লাহর জীবনের অজানা তথ্য আবিষ্কার করতে সৈয়দ আবুল মকসুদ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন ওয়ালীউল্লাহর অগ্রজ সৈয়দ নসরুল্লাহ্, ওয়ালীউল্লাহর বিমাতা এ কে নাজমুল করিম, মোহাম্মদ তোয়াহা, কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, গোলাম কুদ্দুস, শওকত ওসমান, আবু সাঈদ চৌধুরী, আবদুল মতিন, ওয়ালীউল্লাহর সহধর্মিণী আন-মারী প্রমুখ। নানাজনের মুখে ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে অজানা নানা কথা তুলে এনেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। যেমন ওয়ালীউল্লাহর বিমাতা জানাচ্ছেন এই কথা: ‘স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ওয়ালীর ছবি আঁকার ঝোঁকটা একটু বেশিই ছিল। কখনো সারা দিন রং-তুলি নিয়ে বসে বসে ছবি আঁকত। একবার মনে আছে, ম্যাট্রিক পরীক্ষার টেস্ট বা প্রি-টেস্ট পরীক্ষার আগে। দুপুরের পর থেকে বসে বসে ছবি আঁকছিল। সন্ধ্যার পর অফিস থেকে ফিরে ওর আব্বা ওর ঘরে উঁকি দেন। দ্যাখেন, ছবি আঁকছে। সেদিন বোধ হয় তাঁর মেজাজ কোনো কারণে ভালো ছিল না। খুব রাগ করেন। ছেলেদের কখনো বকাঝকা করতেন না। সেদিন ওর আঁকা ছবিগুলোর কাগজ ছিঁড়ে দলা করে ফেলে দেন। ওয়ালী খুব ভয় পেয়ে যায়। বেশ কিছুদিন আর ছবি আঁকেনি।’ এমনই নানা কৌতূহলোদ্দীপক কথায় ভরপুর এই বই।
আগেই বলা হয়েছে, এ বই একই সঙ্গে স্মৃতিকথা এবং গবেষণা। গবেষণা, তবে পাদটীকা-কণ্টকিত নীরস কোনো সন্দর্ভ নয় স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য বিষয়ে কৌতূহলী পাঠক ও গবেষকদের কাছে এ বই সঞ্চার করবে নতুন অভিজ্ঞতার উত্তাপ।