সত্য অনুসন্ধানী ইতিহাসবিদ

সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু ও শেষ করেছেন কলকাতায়। প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি যখন ছাত্র, আমি তখনো কলেজ পর্যায়ে আসতে পারিনি। ওই কলেজে আমি যখন ছাত্র হিসেবে যোগ দিই, তিনি তত দিনে তাঁর উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ মিলল সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে আমরা দুজনই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যুক্ত হই, তখন। যে অল্প কটি বিভাগ নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তার কার্যক্রম শুরু করে, তার মধ্যে ছিল ইতিহাস ও ইংরেজি। অর্থাৎ ইতিহাস বিভাগে তিনি ও ইংরেজি বিভাগে আমি পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হলাম সহকর্মী হিসেবে। এই সম্পর্ক অটুট থাকল দীর্ঘকাল। এরপর আমরা দুজনেই কিছুকালের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। সেখান থেকে সালাহ্উদ্দীন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান, আমি থেকে যাই জাহাঙ্গীরনগরেই। আমাদের কর্মস্থল আর এক থাকেনি। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত একই—অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। সেদিক দিয়ে এ সম্পর্ক ৬০ বছরের অধিককাল বলতে পারি।
ইতিহাস আমার ‘বিষয়’ নয়। কিন্তু ইতিহাস আমাকে সহজেই টানে। বিএ পর্যন্ত আমি ইতিহাস পড়েছি। তবে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, আমি যে সাহিত্যের চর্চা করি, সেই চর্চায় ইতিহাস অল্পবিস্তর এক ভূমিকা পালন করে। আমার সাহিত্যপাঠ অত্যন্ত ইতিহাসনির্ভর। সাহিত্যকে আমি একেবারেই ইতিহাসবিচ্ছিন্ন ভাবতে পারি না। সে জন্য প্রয়োজনের বাইরেও ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমি সালাহ্উদ্দীন আহমদের সঙ্গ উপভোগ করি; কারণ তিনি আদ্যোপান্ত ইতিহাসের মানুষ। ইতিহাস তিনি শুধু পাঠ করেননি। ইতিহাস তাঁকে এক অনন্য সভ্য মানুষে পরিণত করেছে। এ-ই ইতিহাসের কাজ। ইতিহাস মানুষের ক্ষুদ্র পরিচয়কে মিথ্যা করে দেয়। তাকে ইতিহাসের মানুষে পরিণত করে। অর্থাৎ সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে যে মানুষ, সে-ই মানুষ।

গত শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ইতিহাস বড় বিপন্ন ছিল। বিশেষ করে ভারত উপমহাদেশে ও বাংলাদেশে, ইতিহাস ছিল রাজনীতির শত্রু বা প্রতিপক্ষ। রাজনীতি ইতিহাসকে পদদলিত করেছে; এবং ইতিহাসের জায়গায় এর এক বিবৃত রূপকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণ্যমান্য করেছে। উচ্চশিক্ষায় ইতিহাসের জায়গা কেড়ে নিয়েছে ইসলামের ইতিহাস। ছাত্র ইতিহাস পড়তে এসে পড়েছে ইসলামের ইতিহাস। শিক্ষাজগতে যাঁরা ওই সময় শিক্ষকতায় এসেছেন, তাঁরা কাজ করেছেন এক ধর্মীয় সংস্কার প্রভাবিত পরিবেশে, যেখানে সাহিত্য ও ইতিহাস নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের মুসলমান তার বাঙালি পরিচয় নিয়ে দীর্ঘকাল নানা সমস্যায় ছিল। এ পরিচয় প্রতিষ্ঠা করার ইতিহাস এত দিনে কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে। যদিও সেটাও একেবারে শঙ্কামুক্ত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে সালাহ্উদ্দীন আহমদ তাঁর বিশ্বাসে ও আচরণে দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন; মুক্তচিন্তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্রেও তিনি দৃষ্টান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি সভ্যতার বীজতলা বলেই জেনেছেন। ইতিহাসের অনেক অনাবিষ্কৃত অঞ্চলে তিনি তাঁর প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা নিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে দেশের অনেক গুণী ব্যক্তির মুখ থেকে ইতিহাসের অমূল্য উপাদান সংগ্রহ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়জগতের অনেক কালিমার মধ্যে তিনি তাঁর নির্লোভ ও নিঃস্বার্থ জীবন যাপন করছেন। জাতীয় অধ্যাপক পদ তাঁকে গৌরবান্বিত করেনি, বরং পদটির গৌরব বৃদ্ধি করেছেন তিনি। বয়স তাঁকে কাবু করেনি, এবং তাঁকে কোনোভাবেই অচল বা অশক্ত করেনি। তাঁকে কৌতুক ও কৌতূহল থেকে দূরে সরায়নি। তাঁর জন্মদিনে তাঁকে আমার অশেষ প্রীতি ও শ্রদ্ধা।