ইতিহাসের নতুন পাঠ ও নির্দেশনা

জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি ১৯০৫-৪৭
জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি ১৯০৫-৪৭

জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি ১৯০৫-৪৭
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশক: সংহতি প্রকাশন ফেব্রুয়ারি ২০১৫
৮১৫ পৃষ্ঠা
দাম: ১০০০ টাকা।
বাঙালীর জাতীয়তাবাদ (২০০০)-এর পর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ইতিহাসকেন্দ্রিক গুরুত্বপূর্ণ বই জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি ১৯০৫-৪৭।
এই বইয়ে লেখক ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ থেকে ১৯৪৭-এর দেশভাগের মধ্যবর্তী বিয়াল্লিশ বছরের সময়প্রবাহে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ব্যক্তির ভূমিকাকে আলোচনায় এনেছেন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের অপরিসীম আত্মত্যাগের ইতিহাসকে বিবেচনায় রেখেছেন, তবে এসব অভিমুখের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও তাৎপর্যকে নতুনভাবে যাচাই করেও দেখেছেন। ইতিহাসের ব্যাখ্যাতা হিসেবে নিজেকে ‘নিরপেক্ষ’ নয়, বরং ‘জনমুক্তির সমর্থক’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, এই বই ইতিহাসের কৌতূহলী এক বাঙালি পাঠকের রচনা, তাই ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক থাকবেন, এমন আশা অসংগত। তবে আমরা তাঁর বইয়ের পাঠকেরা দেখি, ইতিহাসের আবরণে অতিকথন ও কিংবদন্তি নির্মাণের পথ প্রত্যাখ্যান করে উপনিবেশিত ভারতবর্ষের উত্তাল সময়ের রাজনৈতিক গতিবিধির প্রায় প্রতিটি ছোট-বড় পর্ব ও নেপথ্য প্রভাবককে বিশ্লেষণ সাপেক্ষে তিনি যথাসম্ভব নিরাসক্তভাবে তুলে ধরেছেন।
বাঙালির জাতিগঠন, দেশভাগ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের নানা প্রপঞ্চ—ভাষা, ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে লেখক ব্যাপ্ত পরিসরে আলোচনা করেছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে জাতিনির্মাণের প্রধান ভিত্তি ভাষা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনামলে জাতীয়তাবাদীদের নানা পক্ষ দ্বারাই ছিল উপেক্ষিত। ফলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণলড়াই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। আর এর ফাঁক গলে শাসকশ্রেণি ও জাতীয়তাবাদীদের বিভিন্ন অংশের উৎসাহে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের মিশ্রণে অত্যল্পকাল পরেই তৈরি হয়েছে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দূরত্ব ও বিভাজন।
চৌদ্দটি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত এ বইয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আলোচনা করেছেন বঙ্গভঙ্গের পূর্বাপর, জিন্নাহ-দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং সংখ্যালঘুর ভাগ্য, দেশ ভাঙার তৎপরতা ও দায়দায়িত্ব, স্বাধীনতা বনাম ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন, সুভাষ বসুর রাজনীতি এবং জাতীয়তাবাদের সীমা, দেশভাগের প্রক্রিয়া, ইতিহাসের কৌতুক এবং পরাজিতের স্বাধীনতা—এমন নানা প্রসঙ্গে। রাজনীতির প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনায় অনিবার্যভাবে এসেছে সমাজ-সংস্কৃতি ও সাহিত্যেরও বিস্তৃত আলোচনা-পর্যালোচনা। ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চের প্রধান ব্যক্তিদের বক্তব্য, বিবৃতি, চিঠিপত্র, সাক্ষাৎকার, রাজনৈতিক দলিল, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন ইত্যাদি যেমন লেখকের বক্তব্যভাগকে তথ্যসমর্থিত করেছে, তেমনি সাহিত্যিক উদাহরণের সমাবেশ জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের সার্বিক মুক্তি বিষয়ে সমাজের সৃজনশীল সাড়া অথবা পিছুটানকেও ধারণ করেছে। তাই এ বইয়ে ফিরে ফিরে এসেছে বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, প্রমথ চৌধুরী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুল কাদির, জসীমউদ্দীনন প্রমুখের রচনা-অনুষঙ্গ।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের প্রতিচ্ছবি পরিস্ফুটনের সমান্তরালে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারের বিশ্বস্ত বিবরণ দেবে এই বই; আর শ্রেণিগত মুক্তির অভীপ্সা কী করে ধর্মীয় বাতাবরণে হারিয়ে যায়—তুলে ধরবে তারও আনুপূর্ব খতিয়ান। এখানে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দেখাচ্ছেন, এক শতাব্দী শেষে আরেক শতাব্দী এসেছে কিন্তু বাংলার প্রান্তিক জনমানুষের মুক্তির ব্যাকরণে কোনো লক্ষ্যযোগ্য পরিবর্তন আসেনি।—এমন নানা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে
আলোচ্য বইয়ে পাঠক খুঁজে পাবেন ইতিহাসের নতুন পাঠ জনমুক্তির প্রয়োজনীয় নির্দেশনা।