ঢাকায় হে উৎসব

ঢাকায় হে উত্সবের উদ্বোধনী দিনে। ছবি: সাহাদাত পারভেজ
ঢাকায় হে উত্সবের উদ্বোধনী দিনে। ছবি: সাহাদাত পারভেজ

উপর্যুপরি হরতালে পথঘাটের নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি উপেক্ষা করে অসুস্থ শরীরেই দূর রাজশাহী থেকে এসেছিলেন হাসান আজিজুল হক। তিন বছর ধরে ঢাকায় ‘হে ফেস্টিভ্যাল’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, অথচ তিনি একবারও সেখানে থাকবেন না, তা কী করে হয়? গত বছরও আসতে পারেননি আকস্মিক অসুস্থতার কারণে। তাই এবার তাঁকে আসতেই হলো। আয়োজকদের অনুরোধ তো ছিলই, আরও ছিল নিজের ঔৎসুক্য—ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব কেমন হয় আসলে?
হে উৎসব প্রধানত একটি সাহিত্য উৎসবই বটে, তবে শুধু সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সংস্কৃতির আরও কিছু শাখা, বিশেষ করে লোকজ নৃত্যসংগীত আর অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমও এ উৎসবের অন্তর্ভুক্ত। তাই এখানে যশস্বী কবি-সাহিত্যিক-অনুবাদক-নাট্যকারদের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরও কিছু সমাগম ঘটে। গোড়াতে অবশ্য শুরু হয়েছিল শুধু সাহিত্য নিয়েই। আড়াই দশকেরও আগে যুক্তরাজ্যের ওয়েলসে উয়ি নদীর তীরবর্তী হে শহরে খুব ছোট্ট পরিসরে শুরু হয়েছিল হে উৎসব। দিনে দিনে তা পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক এক সাহিত্য উৎসবে, যেখানে শুধু ইংরেজি ভাষার লেখক-পাঠকদেরই সমাগম ঘটে না। যেমন এ বছর ঢাকায় এ উৎসবে যোগ দিতে ১১টি দেশ থেকে যে ৫০ জন কবি, লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক ও অভিনয়শিল্পী এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ইংরেজির পাশাপাশি ছিলেন জার্মান, ফরাসি, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, আরবি, উর্দু ও হিন্দি ভাষার লেখক-কবিরাও। তাঁদের মধ্যে বেশ খ্যাতিমানও ছিলেন কয়েকজন; যেমন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক-বুদ্ধিজীবী তারিক আলি, ভারতীয় ঔপন্যাসিক ও প্রবন্ধকার পঙ্কজ মিশ্র, ভারতীয় অভিনেতা রাহুল বোস, পাকিস্তানের কথাসাহিত্যিক আমের হুসেইন প্রমুখ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে এবারও এসেছিলেন বাংলা সাহিত্যের দুজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিক—অভিজিৎ সেন ও স্বপ্নময় চক্রবর্তী। বাংলাদেশের যেসব কবি-লেখক ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করেন, তাঁদের প্রায় সবাই এতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কায়সার হক, ফখরুল আলম, কাজি আনিস আহমেদ প্রমুখের উপস্থিতি ছিল বেশ লক্ষণীয়। লন্ডনবাসী বাংলাদেশি ঔপন্যাসিক তাহমিমা আনাম এবারও আয়োজকদের একজন হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, একাধিক সেশনে অংশও নিয়েছেন।

২০১১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিল প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছিল যে হে উৎসব, তা ছিল মাত্র এক দিনের। সেখানে বিপুল লোকসমাগম লক্ষ করে আয়োজকেরা সিদ্ধান্ত নেন, পরের বছর থেকে নিয়মিতভাবে ঢাকায় এ উৎসব হবে তিন দিন ধরে। ২০১২ সাল থেকে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে নিয়মিতভাবে শুরু হয়েছে এটি। এবার গত বৃহস্পতি থেকে শনিবার পর্যন্ত তিন দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উৎসবে মুখরিত ছিল ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। প্রথম ও দ্বিতীয় বছরের তুলনায় এবারের হে উৎসবে লোকসমাগম হয়েছিল অনেক বেশি। সাদাফ সায সিদ্দিকী, যিনি আয়োজকদের একজন, আমাকে জানান, এবারের হে উৎসবে প্রায় ১৩ হাজার মানুষের সমাগম ঘটেছিল। প্রথম বছর এই সংখ্যা ছিল ১০ হাজারের মতো। সাধারণ অভ্যাগত ছাড়াও বিপুল উপস্থিতি ছিল এ দেশের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের; বাংলাদেশে যাঁদের সহিত্যপাঠ মূলত ইংরেজি ভাষায়, তাঁদের উপস্থিতিও ছিল নজরে পড়ার মতো।

যদিও সাধারণভাবে মনে হতে পারে হে উৎসবটি ইংরেজি ভাষার কবি-লেখকদের উৎসব, কিন্তু তাহমিমা আনাম মনে করেন, আসলে তা নয়। বাংলাদেশের বাংলা ভাষার কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রবন্ধকারদের উপস্থিতি আর অংশগ্রহণই ছিল সবচেয়ে বেশি। সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, শাহীন আখতার, পারভেজ হোসেন, জাকির তালুকদার থেকে শুরু করে অভিনয়শিল্পী ইরেশ জাকের কিংবা হুমায়ূন আহমেদের ছেলে নুহাশ হুমায়ূন পর্যন্ত অনেককেই দেখা গেছে এই উৎসবে অংশ নিতে। উৎসবের স্থান হিসেবে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ বেছে নেওয়ারও কারণ উৎসবটিকে ইংরেজি-কেন্দ্রিকতার বাইরে নিয়ে আসা। তাহমিমা আনামের বক্তব্য অনুযায়ী, ঢাকায় এ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষার সাহিত্যিকদের বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে।

সৈয়দ শামসুল হক মনে করেন, বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবের আয়োজন অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক একটি বিষয়। তিনি জানান, বিভিন্ন দেশের লেখকদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও ভাবনাবিনিময়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বপটভূমিতে সাহিত্যের কাজ অনুভব করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের সাহিত্য বিশ্ব মানের, অনুবাদের মাধ্যমে এ সাহিত্য বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের পাঠকের কাছে পৌঁছানো প্রয়োজন। সে রকম সুযোগও এ উৎসব থেকে তৈরি হবে বলে তিনি আশা করেন।

হাসান আজিজুল হক মনে করেন, দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে আমাদের ইংরেজি ছাড়া অন্য ইউরোপীয় ভাষাগুলো শেখা হয়ে ওঠেনি, পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ মূলত ইংরেজির মাধ্যমেই। হে সাহিত্য উৎসবের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য ইংরেজিভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো শুরু হলে তা থেকে অন্যান্য ভাষায়ও আমাদের সাহিত্য অনূদিত হবে।

সেটা এবার শুরু হয়েছে, হাসান আজিজুল হকের তিনটি গল্পের ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছে বেঙ্গল লাইটস বুকস। হে উৎসব উপলক্ষেই সেটি প্রকাশ করা হয়েছে এবং উৎসবের প্রথম দিনেই একটি অধিবেশনে লেখক-অনুবাদকদের উপস্থিতিতে বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হলো। থ্রি স্টোরিজ নামে বইটি সম্পাদনা করেছেন কায়সার হক। একই অধিবেশনে তাঁর নিজেরও একটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে।

প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বাংলা একাডেমির নতুন মিলনায়তনের মঞ্চসহ একাধিক মঞ্চে সমান্তরালভাবে চলেছে বিভিন্ন অধিবেশন। একই সময়ে একাধিক অধিবেশন হওয়ায় অনেকেই আফসোস করেছেন এই বলে যে সবাই সব অধিবেশন উপভোগের সুযোগ পাননি। এমন ঘনবদ্ধ আয়োজনে ব্যস্ত থাকার কারণে বিদেশি কবি-লেখকদের সঙ্গে এ দেশের কবি-লেখকদের পরিচয় ও ভাববিনিময়েরও সুযোগ তেমন মেলেনি। এ বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন হাসান আজিজুল হক। এই উৎসবের সুবাদে বিদেশি সাহিত্যিক-অনুবাদকদের সঙ্গে যে মিথস্ক্রিয়া হবে বলে প্রত্যাশা জাগে, তাঁর মতে সেটা ঘটেনি।

বাংলাদেশের মূলধারার অনেক কবি-লেখকের অনুপস্থিতিও দৃষ্টিকটু ঠেকেছে—নির্মলেন্দু গুণ, মঞ্জু সরকার, মঈনুল আহসান সাবের, ওয়াসি আহমেদ, নাসরীন জাহান, ব্রাত্য রাইসু, কামরুজ্জামান কামু, অদিতি ফাল্গুনীসহ আরও অনেককেই হে উৎসবে দেখা যায়নি। সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে উৎসবটি নিশ্চয়ই আরও পূর্ণাঙ্গতা পেত।