অখণ্ড প্রেমের খণ্ড খণ্ড গল্প

বাংলাদেশি লেখক তাহমিমা আনামের সর্বশেষ উপন্যাস দ্য বোনস্ অব গ্রেস প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। বইটি নিয়ে গত ২৯ মে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি পর্যবেক্ষণধর্মী নিবন্ধ লিখেছেন অ্যান্থনি কামিনস
তাহমিমা আনাম। ছবি: প্রথম আলো
তাহমিমা আনাম। ছবি: প্রথম আলো

তাহমিমা আনামের নতুন উপন্যাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ও হৃদয়গ্রাহী পর্বটি প্রথম আত্মপ্রকাশ করে সাহিত্য সাময়িকী গ্রানাটার ২০১৩ সালের এপ্রিল সংখ্যায়। এ সংখ্যাটিতে এক দশকের যুক্তরাজ্যের সেরা তরুণ ঔপন্যাসিকদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে তাহমিমার নাম। এই সংখ্যায় তাহমিমার বোনস্ অব গ্রেস উপন্যাসের একটি অংশ ‘আনোয়ার গেটস এভরিথিং’ (আনোয়ার সব পেয়েছে) শিরোনামে ছাপা হয়। পাঠকমনে ঝড় তোলা সেই অংশে দুবাইয়ের একটি আকাশচুম্বী ভবনে কর্মরত বাঙালি শ্রমিক আনোয়ারের নিদারুণ কষ্টের ছবি পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যায়, পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই ওই বহুতল ভবনের জানালার কাচ পরিষ্কারের আদেশ দেওয়া হয়। এই অংশটুকু পড়ে যে কারও মনে হবে এটি আমিরাতের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার আড়ালে থাকা নিষ্পেষিত শ্রমিকের রক্ত-ঘামের চিত্রনাট্যের একটি প্রতিবাদী আখ্যান। কিন্তু পুরো উপন্যাস পড়ার পর এই পাঠকেরা চমকে যাবেন। কারণ পাহাড় টপকানো বাঘা বাঘা তারকাখচিত আইভি লিগ অ্যাকাডেমিকদের সুবিশাল বিজয়গাথার নিচে চাপা পড়ে যাওয়া আনোয়ারের এই বহুতল ভবনে কাজ করার গল্প উপন্যাসটির মূল কাহিনির একটি খণ্ডচিত্র মাত্র।

যুক্তরাষ্ট্রের দ্য গার্ডিয়ান–এ ২৯ মে প্রকাশিত তাহমিমা আনামের বইয়ের আলোচনা
যুক্তরাষ্ট্রের দ্য গার্ডিয়ান–এ ২৯ মে প্রকাশিত তাহমিমা আনামের বইয়ের আলোচনা

উপন্যাসটির কাহিনির সিংহভাগই বর্ণিত হয়েছে যুবায়দা নামের এক সামুদ্রিক জীবাশ্মবিদের জবানিতে। তাঁর নিজের বর্ণনায়ই জানা যায়, ঢাকার মেয়ে যুবায়দা পাকিস্তানে যখন তাঁর কর্মস্থলে একটি প্রাগৈতিহাসিক যুগের তিমির কঙ্কাল নিয়ে গবেষণা করছিলেন, তখনই সেখানে গোষ্ঠীগত দাঙ্গা বেধে যায়। যুবায়দা ওই দাঙ্গার মধ্যে পড়ে যান। আমরা জানতে পারি, হার্ভার্ডে গ্র্যাজুয়েশন করার সময় নীল চোখের পশ্চিমা তরুণ দার্শনিক এলিজাহ স্ট্রংয়ের প্রেমে পড়েন তিনি। দেশের বাড়িতে যুবায়দার শৈশবে রশিদ নামের একজনের সঙ্গে বাগদান হয়েছিল। এলিজাহর আশা, যুবায়দা দেশের বাড়ির সেই বাগদানের মায়া ছিন্ন করতে পারবেন। কিন্তু সেই ‘দেশের বাড়ি’ই একসময় যুবায়দার কাছে একটা বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়: সারাক্ষণ একটি চিন্তা তাঁকে তাড়া করে ফেরে। সেটি হলো, শিশু অবস্থায় ঢাকার একটি পরিবার তাঁকে দত্তক নিয়েছিল। সেই পরিবারে তিনি বড় হয়ে উঠলেও তাঁর সত্যিকারের মা-বাবার সন্ধান তিনি জানেন না।
দেশে ফিরে যুবায়দা কল্পনায় এলিজাহকে উদ্দেশ করে এক সুদীর্ঘ চিঠি লেখেন। সেখানে যুবায়দার জবানিতে আমরা জানতে পারি কীভাবে তাঁদের দেখা হয়েছিল; বাংলাদেশে ফিরতে যুবায়দাকে কী অবর্ণনীয় কষ্টে পড়তে হয়েছিল। উপন্যাসটির ছেঁড়া ছেঁড়া গল্পের তন্তু জুড়লে যা দাঁড়াবে সেটি হলো একটি নিরন্তর প্রশ্নবোধক উপাখ্যান। যার কোনো উত্তর নেই। ১২৫ পৃষ্ঠায় যুবায়দার জবানিতে এমনই একটি আভাস: ‘আনোয়ার তার গোপন কথা গোপনে বয়ে বেড়াচ্ছে, তার সেই গোপন বিষয়গুলো আসলে আমারই।’ কিন্তু এর ৫০ পৃষ্ঠা পরে গিয়ে আমরা জানতে পারি, যুবায়দা তাঁর সেই গোপন কথা আর গোপন রাখতে পারেননি। এলিজাহকে তিনি লিখছেন: ‘আমার গল্পের ঝুলি থেকে গল্পগুলো খুব ধীরে বের করছি বলে আমায় দোষ দিয়ো না এলিজাহ। সব কথা বলতে একটু সময় তো লাগবেই।’

বোনস্ অব গ্রেস
বোনস্ অব গ্রেস

পরস্পরের অনুভূতি হৃদয়ঙ্গম করা উপন্যাসের চরিত্রগুলোর জন্য জরুরি না হলেও পাঠক হিসেবে আমাদের জন্য তা অনেক জরুরি। এই উপন্যাসের বর্ণনার প্রকৌশলগত মুনশিয়ানায় সে বিষয়টি খেয়াল রাখা হয়েছে। যুবায়দাকে এলিজাহর জন্য যেমন লিখতে হয়েছে, তেমনি পাঠক হিসেবে আমাদের জন্যও তাঁকে লিখতে হয়েছে। বাংলাদেশে যুবায়দা ফিরে আসার পর তাঁর সঙ্গে এলিজাহর শুধু বিভিন্ন গানের কলি দিয়ে টেক্সট মেসেজ চালাচালি হয়। এই সাংকেতিক ভাববিনিময় দেখে পাঠকের মনে হবে যেন লেখকের পারিপার্শ্বিক জগৎও তাঁর চরিত্রগুলোর জগতের মতো।
যুবায়দার বংশপরিচয় অথবা সেই পরিচয়সংকট যেন এক জগদ্দল পাথরের মতো ভারী হয়ে ধরা দেয়। এলিজাহকে লেখা চিঠিতেই বিষয়টি ধরা পড়ে: ‘আমি এমন একজন মানুষ, যার জীবন শুরু হয়েছিল শুধু নিজের জীবন নিয়ে। পূর্বপুরুষদের ইতিহাসসমৃদ্ধ পরিবারবৃক্ষের ছায়াতলে তুমি যেভাবে বড় হয়েছ, তেমন সৌভাগ্য আমার ছিল না। আমার এই তালগোল পাকানো ইতিহাস দিয়ে তুমি কী করবে এলিজাহ? তোমার ক্যামোমিল ফুলের সৌরভে ভরা ঘর, তোমার নাদুসনুদুস পোষা বিড়াল, ফ্রিজে লেমোনেড পানীয় আর আছে সেই পরিবারবৃক্ষ; সেখানে রক্তাক্ত আগস্ট নেই, নেই কোনো বিপ্লব...’

প্রায় পুরো বইজুড়ে এমন বেদনাক্লিষ্ট গম্ভীর লয়ে কাহিনি এগিয়েছে। উপন্যাসটিতে তাহমিমা আনাম তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতা ধরে রাখতে চেয়েছেন। যুবায়দার কথায় এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাঁর ধারণা, তলস্তয়ের লেখাগুলো পড়লে তাঁর হবু স্বামী তাঁকে আগের চেয়ে ভালো বুঝতে পারবে। একইভাবে তিমি শিকারের মতো বিষয়টিতেও আনামের এই প্রবণতা ধরা পড়ে।
তবে সবকিছুর পরও তাহমিমা এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, উপন্যাসের ছেঁড়া ছেঁড়া ঘটনা জোড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি তৃপ্ত হতে পারেননি। কাহিনির গতিশীল পর্যায়কে কেউ কেউ ‘বড্ড এলোপাতাড়ি’ বলে মন্তব্য করছেন; এমনকি প্রধান চরিত্র যুবায়দা তাঁর গল্পগুলোকে ‘অর্থহীন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।