ওদের গল্পই রক্ত-মাংসের মতো আমার লেখায় স্থান পায় : মহাশ্বেতা দেবী

কদিন আগে চলে গেলেন কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। ছবি তুলতে নাসির আলী মামুন তাঁর কলকাতার বাসায় গিয়েছিলেন ২০১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর। ছবি তোলার পর বিচিত্র বিষয়ে কথা বলেছিলেন এ লেখিয়ে। লেখালেখি, জীবনযাপন, নিজস্ব বিশ্বাস, ঋত্বিক ঘটক—অপ্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে চিরচেনা মহাশ্বেতার অনন্য আদল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাসির আলী মামুন
মহাশ্বেতা দেবী (১৪ জানুয়ারি ১৯২৬-২৮ জুলাই ২০১৬)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম, কলকাতা ১৯৯৯
মহাশ্বেতা দেবী (১৪ জানুয়ারি ১৯২৬-২৮ জুলাই ২০১৬)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম, কলকাতা ১৯৯৯

নাসির আলী মামুন: আপনার ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, জানেন, তাঁরা বলে থাকেন, আপনি বিচিত্র ও দুর্বোধ্য চরিত্রের অধিকারী—কী বলবেন এ বিষয়ে?
মহাশ্বেতা দেবী: আমি বিশেষ কোনো ব্লকে আটকে থাকিনি। চাকরিবাকরি করেছি, আবার সেসব ছাড়তে হয়েছে, ছেড়েছি; বিতাড়িতও হয়েছি। পুরুষ, কাপুরুষ, নারী—লিঙ্গভেদে সব ধরনের মানুষের সঙ্গে মিশেছি। খেয়াল করেছি, সব শ্রেণির নারী-পুরুষের সুবিধার জায়গাটা একই রকম। নিচু জাত বা দরিদ্রদের ব্যাপারে কেউ নমনীয় নয়। সবাই যেকোনোভাবে প্রান্তিক জনমানুষকে শোষণ করতে চায়, তাদের শরীরের রক্ত শুষে নিয়ে যেতে চায়। ভাগ্যাহত মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে, প্রতিবাদ করার ভাষা হয়তো তারা ভুলে যাচ্ছে।মৌলিক অধিকারগুলো যেখানে প্রতিনিয়ত পদদলিত, সেখানে শুধু কোনো রকমে বেঁচে থাকাটাই তাদের কাছে মুখ্য। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে সাহস পায় না। চাকরিচ্যুত বা উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার ভয়ে বিভোর থাকে তারা। ভয় তাদের সাহসকে নির্বাসনে পাঠায়।
এসব অবস্থা দেখে আমি বসে থাকিনি, দারিদ্র্যকে প্রণাম করে তার কাছে বন্দী হয়ে থাকিনি। কীভাবে ওই জায়গা থেকে সমাজের নিপীড়িত ব্যক্তিদের মুক্ত করা যায়, সেই প্রস্তুতি নিয়েছি, লিখেছি। আমি কোনো স্বাভাবিক মানুষ নই। ভারতে স্বাভাবিক নারীরা কি এক জীবনে আট-দশটা পেশা বদলায়? তারা কি আমার মতো জীবনযাপন করে? আমাদের স্বভাবটা হচ্ছে সুবিধার জায়গাটাকে চেনা। ভালো থাকব, অর্থ থাকবে প্রচুর, ভালো খাব, আবার প্রতিবাদও করব। এসব একসঙ্গে হয় না। আমার ক্ষেত্রে সব একসঙ্গে হয়নি বলেই আমি বিচিত্র...। আর কী যেন বললে?
মামুন: দুর্বোধ্য...।
মহাশ্বেতা: তুমি বলো কোথায় আমাকে তোমরা বুঝতে পারোনি? দুর্বোধ্যতা বা রহস্যময়তা তো আমার কোথাও নেই! এমন কথা তো কেউ আমাকে বলেনি।
মামুন: ‘স৶ষ্টা যদি ধর্মচ্যুত হন, তাঁর সাহিত্য কী করে অঙ্গীকার পালনের প্রয়াস হয়?’ এটা আপনার কথা। আপনি মানুষের ধর্মের কথা বলেছেন নাকি সাহিত্যের?

মহাশ্বেতা: আমার বইগুলো পড়েছ? ওখানে কী আছে। আমি কি কোনো সনাতন ব্যবস্থার বা রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে থেকেছি? চিরকালের কোন কোন বিশ্বাসের সঙ্গে আমার দূরত্ব হয়েছে? সভ্য মানুষ হিসেবে আমার একটা নিজস্ব বিশ্বাস আছে। সেটা আমার দেখা বৈষম্য, নির্যাতন, যুদ্ধ, ধনীদের তৈরি দুর্ভিক্ষ, নিচু বর্গের মানুষকে উচ্ছেদ এবং অবর্ণনীয় অত্যাচার—এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া আমার কাছে ধর্মবিশ্বাসের মতো। একজন লেখক হয়ে কী করে বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আমি উপেক্ষা করব, এ আমার চরিত্রে নেই। প্রকৃত সৃষ্টিশীল লেখকের কোনো ধর্ম থাকে না। মানবমুক্তিই তার ধর্ম। যারা রাষ্ট্রের দ্বারা বা উচ্চশ্রেণির মাধ্যমে ক্রমাগত নানা নির্যাতনের মধ্যে পড়ে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না, তাদের কথাই আমি লিখতে চেয়েছি। আমি দেখেছি, আসলে রাজনীতিতেও তাদের কোনো প্রতিনিধি নেই, আছে বিশ্বাস ভেঙে খাওয়া ঠকবাজ। এদের বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকা আমার আরাধনার অংশ।

মামুন: আপনি কর্মী না লেখক, কোনটা আগে?

মহাশ্বেতা: একসঙ্গে দুটোই। লিখেছি বলেই আমার কিছু পাঠক আছে। লেখাটা চলে যায় অন্তত কিছু পাঠকের কাছে। যাদের নিয়ে আমি লিখি, তারা মনে করে আমি তাদেরই একজন। এটা আমার সামান্য প্রাপ্তি।

মামুন: লিখে এ পর্যন্ত কেমন আয় করেছেন, এর কোনো হিসাব আছে আপনার কাছে?

মহাশ্বেতা: ছেলেটা কী বলে রে!

মামুন: ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীএবং নিম্নবর্গের মানুষকে নিয়ে আপনার লেখা ও কাজ শ্রদ্ধা জাগায়। ভারতবর্ষে যেসব লেখক বা সাহিত্যিক লিখে মোটা অঙ্কের আয় করেছেন, তাঁরা গরিবদের জন্য নিয়মিত অর্থ ব্যয় বা সম্পত্তি দান করেছেন, এমন নজির সম্ভবত নেই। এ বিষয়ে আপনার অবস্থানটি জানতে পারি?

মহাশ্বেতা: তোমাকে আমার অ্যাকাউন্ট্যান্ট করলে ভালোই হতো।

মামুন: যারা এই সময়ে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে, তারা সাধারণত কেন আসে?

মহাশ্বেতা: ভালোবেসে দেখা করতে আসে। আমার পাঠকেরা আসে। সপ্তাহে এক দিন আমি সবাইকে সাক্ষাৎ দিই।

মামুন: বাকি ছয় দিন কী করেন?

মহাশ্বেতা: না বলে-কয়েও কেউ কেউ চলে আসে। আমি সময় দিই। সারা দিন লিখে-পড়ে কেটে যায়। ওই যে ওরা আছে (পরিচারকদের কয়েকজনকে দেখিয়ে), আমাকে দেখে। যখন অসুস্থ হই, ওরাই তো আমার সেবা করে। আমি নিঃসঙ্গ, তবে আমার বাড়িটি সরব থাকে। একটা মেয়ে, অচেনা মেয়ে, প্রতিদিন সকালে আমাকে ফুল দিয়ে যেত। ও আর নেই। অনেক মানুষ আসে, যাদের সঙ্গে গল্প করে আনন্দ পাই। আরও লিখতে ইচ্ছে হয়।

মামুন: বাইরে যান?

মহাশ্বেতা: এখন যেতে পারি না। যাদের আমি দেখতে চাই, তারা আমার কাছে আসে। তুমি তো আমার লেখা নিয়ে কিছু বললে না?

মামুন: হাজার চুরাশির মা-এর কথা সবাই জিজ্ঞেস করে।

মহাশ্বেতা: ভালোবেসেই জিজ্ঞেস করে। তবে, হাজার চুরাশির মা নিয়ে কথা বলতে বলতে এখন ক্লান্তই হয়ে যাই। একই কথা তো! এরপরও ওই মানের অনেক লিখেছি। সেগুলো বোধ হয় দেখোনি।

মামুন: পড়েছি, কিছু পড়েছি। আপনি অনেক ন্যারেটিভ, বর্ণনাবহুল আঙ্গিকে লেখেন। আপনার দেখা জীবন ও চরিত্রগুলোর গল্প পাঠকেরা পড়তে চায়।

মহাশ্বেতা: গল্প তারা পড়তে চায়। তবে নিজেদের স্বপ্ন ও ব্যর্থতার গল্প, প্রেম-পরিণয়ের পর পরিবার বড় হয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্য এসে ওদের জীবনে ঢুকে পড়ছে, সব গ্রাস করতে চাইছে। রাষ্ট্র ও জোতদার ধনীদের অত্যাচারের গল্প এবং প্রতিবাদ-প্রতিহতের ও লড়াইয়ের গল্প শুনতে চায় তারা। ওদের সর্বস্ব লুট হয়ে যাওয়া—শূন্য থেকে উঠে আসার যে দ্রোহ, সেই গল্পগুলোই তো আমি বলি।

মামুন: অনেক লেখক আবার শুধু গল্পই বলেন, গল্পের রাজ্যে ফেলে দেন পাঠককে। কিন্তু লেখায় জীবনজিজ্ঞাসা, সংঘাত, জীবনের তৃতীয় মত এবং বিদ্রোহ প্রতিফলিত হয় না স্পষ্টভাবে। প্রেম, ভালোবাসায় আপ্লুত থাকেন।

মহাশ্বেতা: সমাজের বিচিত্র চরিত্রগুলোকে আবিষ্কার করা এবং তার মধ্যে অনুপ্রবেশ করা লেখকের কাজ। প্রেমের গল্প বা উপন্যাস লিখে কেউ যদি পাঠকের মন জয় করতে পারে, তাতেও মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করা যায়। আমি মনে করি, আমার কাজটা লেখালেখি হলেও সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদের হাতে যারা নিপীড়নের শিকার হয়, তাদের সাহস দেওয়া এবং স্বপ্ন দেখানোও আমার কাজ, যাতে তারা নিজেদের পরাজিত মনে না করে।

মামুন: আপনি যখন লেখেন, সেই সময় কাদের জন্য লিখছেন, সেটি কি জেনে তবে লেখেন?

মহাশ্বেতা: আমি নিবিড়ভাবে জেনেই লিখি। কল্পনার ওপর ভর করে কোনো লেখা আমার হয় না।আমি যা করি তা জীবনের বাস্তব চরিত্রদের নিয়েই, ওদের গল্পই রক্ত-মাংসের মতো আমার লেখায় স্থান পায়। আর বলতে পারব না। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।

মামুন: আরেকটু সময় পেলে সাক্ষাৎকারটি পূর্ণতা পেতে পারে।

মহাশ্বেতা: অনেকক্ষণ বসে আছি।

নিজের লেখার টেবিলে মগ্ন মহাশ্বেতা দেবী, কলকাতা, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৩। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
নিজের লেখার টেবিলে মগ্ন মহাশ্বেতা দেবী, কলকাতা, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৩। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

মামুন: গত শতকের সত্তরের দশক পর্যন্ত আপনি অন্য লেখকদের মতো প্রেম-ভালোবাসার কথা লিখেছেন। হাজার চুরাশির মা বাদ দিলে আজকের এই অবস্থানে আসার ক্ষেত্রে আপনার চমকটি কোথায়?
মহাশ্বেতা: আমি কোনো চমক-টমক দিইনি। এসব কোত্থেকে পেলে?
মামুন: আপনার প্রথম প্রায় দুই দশকের সাহিত্য অন্যদের মতো। আমি বলতে চাইছি, গতানুগতিক গণ্ডি থেকে তখনো বেরিয়ে আসতে পারেননি আপনি। সত্তরের মাঝামাঝি মনে হলো, আপনি নিজস্ব ঘরানা খুঁজে পেয়েছেন।
মহাশ্বেতা: ঘরানা কি না বলতে পারব না। তখন আমার বাবা চলে গেলেন। আমি সমাজের দলিত ব্যক্তিদের সঙ্গে যুক্ত হলাম। তাদের জীবনকে আবেগের বশে নয়, দেখতে থাকলাম কাছে থেকে। সেটা ১৯৭৯ হবে। আমার বাবা লিখতেন। তাঁর বই আছে। নাম জানো?
মামুন: মণীশ ঘটক। ঢাকার মানুষ। আপনিও ঢাকায় ছিলেন।
মহাশ্বেতা: বড় বড় পাগল, বিরাট প্রতিভাবান আমার বংশের ওঁরা। ঢাকায় গিয়েছিলাম তিন-চার বছর আগে শহীদুলের (শহীদুল আলম) দৃক গ্যালারিতে। আমার পেছনের এই যে ছবিটা, এটা ওদের দেওয়া।
মামুন: এটা একটা পোস্টার, ফটোগ্রাফ।
মহাশ্বেতা: সুন্দর সময় কাটল ঢাকায়, আড্ডা হলো, অনেকে আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। ওদের ছবির প্রদর্শনী হঠাৎ পুলিশ এসে আটকে দিল। আমরা ভেতরে ঢুকতে পারলাম না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছবির প্রদর্শনীর উদ্বোধন হলো। আমি প্রতিবাদ করলাম। সেদিন অনেককে ছবি (আলোকচিত্র) দেখতে এসে ফিরে যেতে হয়েছিল।

মামুন: আপনার রাজনৈতিক চরিত্রগুলো কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের নয়। নির্দিষ্ট কোনো মতবাদেও বিভোর থাকেনি তারা। এমন দ্বান্দ্বিক চরিত্র সৃষ্টি করলেন কীভাবে? এর নেপথ্যে আপনার নিজস্ব মত ও পথ প্রভাব কতটা ফেলেছিল?

হাজার চুরাশির মা–এর প্রচ্ছদ
হাজার চুরাশির মা–এর প্রচ্ছদ

মহাশ্বেতা: আমাকেই তো ওইভাবে গড়ে তুলতে হয়েছে। রাতারাতি সমাজের অসংগতিগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা যায় না। প্রথমে আমাকে জানতে হয়েছে, ওরা কারা, কেন বারে বারে ওদের পরাজিত করা হচ্ছে। অন্যায়-অত্যাচার করে নিম্নবর্গের মানুষজনকে কেন ভূমিছাড়া করা হচ্ছে। আমার প্রস্তুতিপর্বের সাহিত্য ছিল অন্য ধরনের। আর তুমি যা বলছ, কোনো মতবাদে বিশ্বাসী থাকে না আমার চরিত্ররা। এটা আমি এ রকম বলেই নয়; সত্যি কথাটা হলো, ক্রমাগত অপশাসন আর অনাচারে ওরাও কিন্তু আমার মতন হয়ে গেছে। এগুলো ওদেরও অভিজ্ঞতা। তাদের কাছ থেকে আমি এগুলো শুনেছি, দেখেছি। যদি বলো আমার ব্যক্তিগত মত, তাতে দ্বিমত করব না। তবে যাদের নিয়ে আমার এই লেখার জীবন, তারা যেসব ঘাত-প্রতিঘাত ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পরিপক্ব হয়েছে, সেটা আমি অনুধাবন করেছি ওদের বাস্তব জীবন থেকেই। লিখেছি সেভাবেই, এখানে কোনো অনাত্মীয় চরিত্র নেই, যাকে আমি জানি না।
মামুন: কোনো দিকে ঝুঁকে থাকে না আপনার এমন চরিত্ররা—এটা কি স্বাভাবিক?
মহাশ্বেতা: কী বলছ সব! আমি অস্বাভাবিক বা কাল্পনিক কোনো চরিত্র নিয়ে লিখি না।
মামুন: রাজনীতি যখন যুগের নিয়তি, তখন এ ধরনের চরিত্ররা কতখানি বাস্তব, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়।
মহাশ্বেতা: এটা তোমার মনে হতে পারে। আমার পাঠকেরা কখনো এমনটা বলেনি। আমার গল্প-উপন্যাসের ওপর যারা কাজ করেছে, তারাও এমন প্রশ্ন করেনি।
মামুন: এই যে আপনি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি ও নিম্নবর্গের মানুষের জীবন নিয়ে লিখছেন। এর মাধ্যমে ওই শ্রেণির মানুষকে মুমূর্ষু জীবন থেকে কি কিছুটা স্বস্তি দিতে পেরেছেন?
মহাশ্বেতা: তোমার প্রশ্নের ধরন শুনে আমার মাথা বেশ টনটন করছে। লেখার কারণে অনেক ঘটনা ঘটেছে। এগুলো তোমাকে বলে কী লাভ! একটা অভিজ্ঞতা বলি: একবার এক ঝাড়ুদার এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন, তাঁর মেয়ের বিয়েতে কলকাতা পৌর করপোরেশনের মেয়র এসেছিলেন—তিনি সে কথা বলতে এসেছিলেন। মেয়র তাঁকে বলেছেন, মহাশ্বেতা দেবীর বই পড়ে তিনি তাঁর মেয়ের বিয়েতে এসেছেন। এখন থেকে তিনি নিয়মিত তাঁদের অনুষ্ঠানাদিতে উপস্থিত থাকবেন।
মামুন: ঋত্বিক ঘটক মাত্র পঞ্চাশ বছর জীবিত ছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রের এমন প্রতিভাকে আপনি কোন উচ্চতায় রাখবেন, যেখানে সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেনও উপস্থিত?

মহাশ্বেতা: ঋত্বিক ঘটক অন্য কারও মতো নন। তিনি বাঙালিকে যেমন দেখেছেন, তা-ই সেলুলয়েডে তুলে এনেছেন। তাঁর চলচ্চিত্র যত না দেখার, তার চাইতে অধিক চিন্তার। ওঁর ছবি দেখার পরও দর্শকদের ভাবতে হয় মেকিং এবং সার্বিক অর্থময়তা নিয়ে। দেখার পর সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। ওঁকে কেউ সহ্য করতে পারত না।

মামুন: কারণগুলো জানতে পারি?

অরণ্যের অধিকার–এর প্রচ্ছদ
অরণ্যের অধিকার–এর প্রচ্ছদ

মহাশ্বেতা: এই তো...। আমাকে এখন অনেক কথা বলিয়ে নিতে চাইছ। তোমরা তো সবই জানো। আমি আর নতুন করে কী বলব। মৃণাল আর সত্যজিৎ বাবুরা একটা বিশেষ শ্রেণির কথা ভেবে সিনেমা বানিয়েছেন। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইতিহাসটা কী। সংগ্রাম আর নিপীড়ন। সত্যজিৎ বিভূতিভূষণের গল্প এত পছন্দ করলেন কেন, এগুলো বুঝতে হবে। বাস্তবতা-বিবর্জিত এবং বিপুল জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে কোনো শিল্পসাহিত্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে—এটা আমি বিশ্বাস করি না। ভারতে নিচু জাতের ওপর এত অত্যাচার, সেসব কাহিনি কোথায় তাঁর ছবিতে। তিনি উঁচুতলার কথা ভেবে ছবি বানিয়েছেন। মৃণাল সেন সেদিক থেকে ভালো কাজ করেছেন।
মামুন: ঋত্বিক ঘটক বেসামাল জীবনযাপন করতেন কেন?
মহাশ্বেতা: কারও কারও লেখায় আমি দেখেছি, তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন শেষের দিকে। মিথ্যে কথা এসব। তারা কেউ ওঁকে বুঝতেই পারেনি। একজন লিখেছে, ছবি করবার সময় তিনি পান করে ফ্লোরে ঘুমন্ত অবস্থায় কাপড়ে মলমূত্র ত্যাগ করেছেন। এসব কথা কেউ লেখে? তাঁর মতো এত বড় প্রতিভা বাংলা চলচ্চিত্রে আছে?
মামুন: তিনি এসব করতেন কেন?
মহাশ্বেতা: ঋত্বিক ঘটক আজীবন লড়াকু ছিলেন। কারও কথা ভেবে তিনি ছবি করেননি। পরিকল্পনা করে, ছক করে কিছু করেননি। এসব গল্প শক্তির (শক্তি চট্টোপাধ্যায়) বানানো। ওঁর মৃত্যুর পর শক্তি অনেক গল্প করেছে। সেগুলো তোমরা মনে রাখো কেন!

মহাশ্বেতা দেবী
ভারতীয় কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর জন্ম ঢাকায় ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি, বিখ্যাত এক সাহিত্যিক পরিবারে। তাঁর বাবা মণীশ ঘটক কল্লোল যুগের কবি এবং চাচা ঋত্বিক ঘটক ছিলেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক। লেখালেখি ও জীবনযাপন—সবখানেই প্রতিবাদী মহাশ্বেতা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও নিম্নবর্গের মানুষের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন আমৃত্যু। ছিলেন মানবাধিকার কর্মীও। প্রথম বই ঝাঁসির রানী হলেও আঁধার মানিক হাজার চুরাশির মা—এই উপন্যাসগুলো ভিন্ন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে তাঁকে। সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন রামোন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার (১৯৯৭), পদ্মবিভূষণ (২০০৬), সার্ক সাহিত্য পুরস্কার (২০০৭) প্রভৃতি। গত ২৮ জুলাই মারা যান তিনি।