'শুরু যেভাবে করলাম, সেভাবে তো শেষ করতে পারলাম না'

>
শহীদ কাদরী (১৪ আগস্ট ১৯৪২—২৮ আগস্ট ২০১৬। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের স্যালেম-এ আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে কবি, ২০০৯। ছবি নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
শহীদ কাদরী (১৪ আগস্ট ১৯৪২—২৮ আগস্ট ২০১৬। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের স্যালেম-এ আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে কবি, ২০০৯। ছবি নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

বাংলা ভাষার প্রধান কবিদের একজন শহীদ কাদরী মারা গেলেন সম্প্রতি। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে এক ঘরোয়া পরিবেশে এই সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন কবি। গল্পছলে বলেছিলেন সমসাময়িক কবিদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের কথা, দূরত্বের কথা, কবিতা লেখার কাহিনি এবং কবি হয়ে ওঠার কথা। বলেছিলেন দেশ ছেড়ে যাওয়ার অভিমানের কথাও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন  সুমনা শারমীন

সুমনা শারমীন: শুনেছি, আপনারা লেখক-শিল্পীরা বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা দিতেন। বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডার কথা দিয়েই আলাপ শুরু করি।
শহীদ কাদরী
: আমাদের বাসা ছিল বিউটি বোর্ডিংয়ের কাছে, বাংলা বাজারের ভেতরের দিকে। সামনে একটা মন্দির ছিল, মন্দিরের পেছনেই আমাদের বাসা। আমরা প্রথমে ওই বিউটি বোর্ডিংয়ে বসতাম। তখন অবশ্য আমার সঙ্গে শামসুর রাহমানের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। শামসুর রাহমান প্রতি সন্ধ্যায় বিউটি বোর্ডিংয়ে আসতেন। শামসুর রাহমানের টানে অনেকেই আসতেন। আমার তখন একটা-দুটো লেখা ছাপা হয়েছে কি হয়নি। শামসুর রাহমানের সে সময় অনেক নামডাক। আমি যখন কলকাতা থেকে এলাম, আমার কলকাতার বন্ধু খোকনকে আমার ভাই বলল, শহীদ তো কবিতা লেখে। তখনো  আমার লেখাটেখা ছাপা হয়নি। খোকনকে দেখালাম আমার খাতা। ও পড়ল। বলল, তুই শামসুর রাহমানের নাম শুনেছিস? বললাম, না তো।  সে বলল, শামসুর রাহমানের নাম শুনিস নাই? বললাম, না। ও বলে, শামসুর রাহমানের কবিতা মাঝেমধ্যেই ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয়। আমি বলি, ‘দেশ’ আবার কী? হা হা হা।

সুমনা: এটা কোন সময়ের কথা?

শহীদ: ১৯৫৪-৫৫। আমার বয়স তখন কত? ১০-১২ হবে। খোকনের বোনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে শামসুর রাহমানের বেস্ট ফ্রেন্ড মুশতাকের। সেই সূত্রে সে শামসুর রাহমানকে চেনে। খোকন আবার শামসুর রাহমানকে বলেছে আমার কথা। শামসুর রাহমান বলেছে, একদিন আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যাও। খোকন বলল, শামসুর রাহমানকে নিয়ে আসব একদিন। শামসুর রাহমান আর আসে নাই।

একদিন দুপুর বেলায় ভাত খাচ্ছি। এ সময় ‘কবিতা’ পত্রিকা আসল। খুলেই দেখি শামসুর রাহমানের কবিতা। ‘মনে মনে’ আর ‘তার শয্যার পাশে’। আমি মাইনাসে মাইনাসে প্লাস করলাম, এই সেই শামসুর রাহমান। তখন আমার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। এর মধ্যে আমার লেখাও কিছুটা বদলে গেছে। প্রথমে পদ্য লিখতাম, বাংলা বই পড়তে হতো না স্কুলে? সে রকম কবিতা। বাসায় ছিল বিপ্লবী কবিতা। ওগুলো পড়তাম। এর মধ্যে একবার কুমিল্লা বেড়াতে গেলাম, এক বাসায়। সেখানে দেখি ‘বন্দীর বন্দনা’ আর ‘কঙ্কাবতী’, বুদ্ধদেব বসুর। আমি ও দুটো নিয়ে এলাম। বেশ পড়ছি কবিতা। দাদা গেল কলকাতায়। নিয়ে এল ‘বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ‘বিমল দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’—অনেক বই। সে–ও পড়ত। আসলে সে-ই আমাদের ঘরে সাহিত্য আমদানি করে।

উত্তরাধিকার ১৯৬৭, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা ১৯৭৪, কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই ১৯৭৮ ও আমার চুম্বনগুলো পেঁৗছে দাও ২০০৯
উত্তরাধিকার ১৯৬৭, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা ১৯৭৪, কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই ১৯৭৮ ও আমার চুম্বনগুলো পেঁৗছে দাও ২০০৯

সুমনা: আপনার দাদার নাম?
শহীদ: শাহেদ কাদরী। তার পরে আমি একটা কবিতা লিখলাম। ‘স্পন্দন’ পত্রিকায় ছাপা হলো। নাম ‘জলকন্যার জন্যে’। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। তখন ম্যাগাজিনের জন্য একমাত্র বিখ্যাত দোকান ছিল খান মজলিশের ম্যাগাজিনের দোকান। সদরঘাটে যাওয়ার পথে ডানদিকে পড়ত। ‘চতুরঙ্গ’, ‘পূর্বাশা’, ‘চতুষ্কোণ’—এসব আসত। আমি ওগুলো কিনতাম সেখান থেকে। ‘স্পন্দন’ বের হলো। আমি স্টলে খুলে দেখি আমার কবিতা। বাহ! তা আমি আবার দেখি, কেউ আমার কবিতা পড়ছে কি না। এ রকমই মুহূর্তে একদিন শামসুর রাহমানের সঙ্গে দেখা। দেখি, ফরসা–মতো একটা লোক ‘স্পন্দন’খুলে আমার কবিতা পড়ছে।

সুমনা: ওই দিনই, না পরে?

শহীদ: পরে। বেশ কিছুদিন পর। ওই দিন আমি দুপুরে গিয়েছি। দেখি, কিছু বইটই কেনা যায় কি না। দেখি, শামসুর রাহমান কবিতাটা পড়ছে। আমি বললাম, কেমন লাগল কবিতা? শামসুর রাহমান বলল, কেন, আপনি লিখেছেন নাকি? বললাম, হ্যাঁ। বলল, ও, আপনার কথা তো আমাকে খোকন বলেছে। আমি বললাম, আপনার সঙ্গে দেখা হলো, ভালোই হলো। চলুন, চা খাই। সদরঘাটে তখন রিভার ভিউ নামে ক্যাফে ছিল। ঢাকার ওয়ান অব দ্য বেস্ট ক্যাফে। ওখানে বসলাম। ওদের একটা বিস্কুট ছিল, মধ্যখানে চকলেট বসানো। বিস্কুট দিয়ে চা খেলাম। আমার পকেটে আবার একটা কবিতা। শামসুর রাহমান পড়ল। তারপর বলল, আপনার ‘ভূল’ বানানটা ভুল হয়েছে।

সুমনা: দীর্ঘ ঊ?

শহীদ: হ্যাঁ। তো, একটু লাল-টাল হয়ে গেলাম আমি। আমি বাংলা শিখেছি একটু বড় বয়সে। যেভাবে ছেলেরা অ–আ–ক–খ শেখে, সেভাবে শিখিনি। একটু জাম্প করতে হয়েছে। কারণ আমাদের বাসায় বাংলার চর্চা ছিল না। বাবা উর্দু বলতেন, মা বাংলা বলতেন। আমরাও একই সঙ্গে বাবার সঙ্গে উর্দু আর মায়ের সঙ্গে বাংলা বলতাম। আব্বা বলত, বাংলা শিখে কী করবি তোরা? ইসলামিয়াতের জন্য উর্দু শিখবি, চাকরিবাকরির জন্য ইংরেজি শিখবি। আমার মা শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়ত। এক ট্রাংক ভরা শরৎচন্দ্রের উপন্যাস। বলত, বড় হলে পড়বি, এখন না। আমি চুরি করে পড়তাম। মার কাছ থেকেই বাংলা শিখলাম আর কি। তাই, যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় ছেলেরা, বাংলা রপ্ত করে, সেটা আমার হয়নি। তাই বানান ভুল হতো। পরে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে বানান ঠিক করার জন্য।

আল মাহমুদের সঙ্গেও এভাবেই একদিন দেখা। আমার তখন ১৪ বছর বয়স। আল মাহমুদ বয়সে বড় আমার চেয়ে। শামসুর রাহমান আমাকে বলল, পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের কবিতা পাঠের আসর আছে, আপনি আসেন। আমি গেলাম। ওখানে অনুষ্ঠান হলো। সবাই কবিতা-টবিতা পড়ল। আমি পড়ি নাই। বসে ছিলাম চুপচাপ। সেই সন্ধ্যায় আল মাহমুদ এল ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। আমি তো জানি না, এটাই আল মাহমুদ। তবে এর আগেই তার কবিতা আমরা পড়েছি। আল মাহমুদ একটা পত্রিকা দিল। খুলে দেখি, ওখানে আল মাহমুদের একটা কবিতা। কবিতায় একটা লাইন ছিল, ‘বিছানায় শরীর ঢেলে, জানালায় বৃষ্টির তীর মেরে’। আমি ওটা নিয়ে হাসাহাসি করলাম। কিছুক্ষণ হাসাহাসি করার পর টের পেলাম যে সে-ই আল মাহমুদ।

সুমনা: এত বছর পরেও মনে আছে আপনার? এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার?

শহীদ: সে বলল, আমিই আল মাহমুদ। অনুষ্ঠান শেষ হলো। আল মাহমুদ বলল, চলুন, আমার ওখানে। রাস্তায় বেরিয়ে বলল, আপনি তো আমার কবিতা পছন্দ করেন না। আমি বললাম, এটা আমার স্বভাব, আমি ঠাট্টা পছন্দ করি। ওর বাসায় গেলাম। থেকে গেলাম সে রাতে। তত দিন আমার বাবা মারা গেছেন। থাকি দুই ভাই। স্কুলে পড়ি। আমার ওপর তখন কোনো শাসন নাই। রাতে থাকলাম, ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

এর মধ্যে আমার লেখা ছাপা হলো ‘সওগাত’-এ। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তখন পত্রিকাটির সাহিত্য সম্পাদক। বলল, আমাকে একটা লেখা দাও। দিলাম। তখন কী করে যেন রটে গেছে যে, শহীদের বয়স কম, তবে সে বেশ ভালো ইংরেজি জানে। তখন  ‘স্টেটসম্যান’-এ পূর্ব বাংলার কবিতা নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী লীলা রায়ের একটা লেখা বেরিয়েছিল। সেখানে শামসুর রাহমানের ওপর অনেকটা লেখা ছিল। আমি অনুবাদ করলাম। সেটা ছাপা হলো। এরপর গাফ্ফার বলল, কবিতা দাও। আমি দিলাম, নাম ছিল ‘গোধূলির গান’। যখন ছাপা হলো, দেখি, আমি যেভাবে কবিতাটা লিখেছি, সেভাবে নাই। দুই–একটা লাইন যুক্ত করা হয়েছে। আমার একটা লাইন ছিল, ‘দেবতার মতো মন্ত্র ছড়ায় দেবদারুগাছ’। ছাপা হয়েছে, ‘দেবতার মতো মন্ত্র ছড়ায় দেবদারুগাছ বাতাসের ঢেউয়ে’। আমার মনে হলো, কবিতাটা তো নষ্ট হয়ে গেছে। শামসুর রাহমানকে বললাম। ও বলল, আপনি যেভাবে লিখেছেন, সেভাবেই আবার ‘পূর্বাশা’য় পাঠান, কলকাতায়। আমি পাঠালাম। তখনো আম্মা বেঁচে আছে। আম্মা যখন মারা যায়, সে সময় আমার ১৪ বছর বয়স। তার মানে, এই ঘটনার সময় আমার বয়স ১২ বা ১৩। তখন আমি খেলি। সকালেও খেলি, বিকেলেও খেলি—ছোট একটা ক্লাবে। সেদিন বিকেল বেলায় বাসায় এসেছি। আমার ভাই বাইরের কামরায় বসে ছিল। বলল, যাও, তোমার ‘পূর্বাশা’ এসেছে। বললাম, কোথায়? বলল, আম্মার কাছে। দৌড়ে গেলাম আম্মার কাছে। আম্মা ওটা বালিশের তলায় লুকিয়ে রেখেছে। আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ এই-ওই করে তারপর দিল। ‘পূর্বাশা’য় কবিতা ছাপা হওয়ায় আমার ভালো লাগল। শামসুর রাহমান বলল, ঢাকা-ঢুকা বাদ দেন।

একদিন সন্ধ্যায় আড্ডা মারতে গিয়েছি আল মাহমুদের বাসায়। তাকে জিজ্ঞোসা করলাম,  কী করছ? বলল, কবিতা পাঠাচ্ছি ‘কবিতা’ পত্রিকায়। আমি ভাবি, আরে, ওর কবিতা আমার আগে ছাপা হয়ে যাবে? তখন মাত্র দুজনের কবিতা ছাপা হয়েছে ‘কবিতা’ পত্রিকায়। একজন শামসুর রাহমান, অন্যজন শামসুল হক।

নাসির আলী মামুনের ক্যামেরায় শহীদ কাদরীর মুখ, ২০০৯
নাসির আলী মামুনের ক্যামেরায় শহীদ কাদরীর মুখ, ২০০৯

সুমনা: সৈয়দ শামসুল হক?
শহীদ: হ্যাঁ। কবিতায় ও লিখল, ‘ইজদানী মারা গেছে বিমানপতনে’। গোটা বাংলাদেশে এমন কবিতা লেখা হয় নাই। ওই কবিতাটা ছাপা হলো। ওকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। আমরা বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা মারতাম। আমরা কিন্তু খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। আমি আর সৈয়দ শামসুল হক করতাম কি জানো? শামসুর রাহমানরা হয়তো রাত ১০টা পর্যন্ত বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা মেরে চলে গেল। ১০টার পর আমি বাসায় এসে খেয়েদেয়ে সৈয়দ শামসুল হকের বাসায় চলে যেতাম। ও বলত, রাতে বাসায় চলে আসেন, ওস্তাদ। আমি বলতাম, ঠিক আছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে রাত একটা-দেড়টায় হয়তো বের হয়ে পড়তাম। টোকা দিতাম, দরজা খুলল। তিনটা-চারটা-পাঁচটা পর্যন্ত আড্ডা মেরে ফিরে আসতাম।
সুমনা: ওই–ই জীবন বোধ হয়...
 শহীদ: কবিতা, গল্প, উপন্যাস নিয়ে গল্প, সারা রাত। রাউন্ড দ্য ক্লক, ২৪ ঘণ্টা এই কাজই করেছি। যা বলছিলাম, পরদিন সকালে শামসুর রাহমান এল আমার বাসায়। বললাম, কাল রাতে আল মাহমুদের ওখানে গিয়েছিলাম, ও তো ‘কবিতা’ পত্রিকায় কবিতা পাঠাচ্ছে। সে বলল, আপনিও পাঠান। বললাম, কোন কবিতা পাঠাব? শামসুর রাহমান কবিতা বেছে দিল। আমার হাতের লেখা ছিল ক্লাস টু-থ্রির ছেলেদের মতো। বললাম, আমার হাতের লেখা এত খারাপ। শামসুর রাহমান বলল, দেন, কপি করে দিই। চিঠিটা দুই লাইনে কীভাবে লিখতে হবে, তা–ও বলে দিল, ‘“কবিতা”র জন্য একটি কবিতা পাঠালাম। প্রকাশিত হলে বাধিত হব।’ সেটা ১৯৫৬ সাল, বুঝলে? আমার ঠিক ১৪ বছর বয়স। আমার ভাই আইকম পরীক্ষা দিচ্ছে। একদিন বিকেল বেলায় আম্মার প্রয়াণ হলো। আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ডাক্তার ডাকো, আমার কোরামিন লাগবে।’ আমাদের পাশের বাড়িতেই এক ফুপু থাকতেন। ডাক্তারের বাড়িতে যাওয়ার সময় দেখি, আম্মা এমন এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, যে দৃষ্টি আর কখনো আমি দেখিনি। ফুপুকে বললাম, আপনি একটু আমাদের বাসায় যান, আম্মা যেন কেমন–কেমন করছে। আমি যখন ডাক্তারকে নিয়ে এলাম, তখন আম্মা শেষ। আমার ভাই তখনো পরীক্ষা দিয়ে ফেরেনি। নিকটাত্মীয়দের জন্য রেখে দেওয়া হলো লাশ। পরদিন বিকেলে কবর হলো। কবর থেকে ফিরলাম। এরপর গোসল-টোসল করে, পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে যখন ঘর থেকে বের হলাম, দেখি অনেকে বসে আছে। শামসুর রাহমানও। আমি জানিও না কীভাবে সে খবর পেয়েছে। বিকেল বেলায় বিউটি বোর্ডিংয়ে এসেছি। কেউ নাই। আমি টেবিলে মাথা রেখে কাঁদছি। একটু পর শামসুর রাহমান এল। এসে বলল, ‘কবিতা’পত্রিকায় আপনার কবিতা ছাপা হয়েছে। শামসুর রাহমান বলল, আপনাদের বাসায় যখন ডাকপিয়ন এল, তখন আমি ওর হাত থেকে নিয়ে নিয়েছি। ভেবেছিলাম, এত লোকের ভিড়ে ওটা হারিয়ে যেতে পারে।

সুমনা: তার মানে যেদিন আপনার মা মারা গেলেন, তার পরদিনই এটা জানলেন?

শহীদ: হ্যাঁ। মা যেদিন মারা গেছে, তার পরের দিন। মা থাকলে খুব খুশি হতো। মাকে সবাই বলত, তোর ছেলে তো ভেরেন্ডা ভাঁজে সারা দিন, ও কী করবে, ও তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমার মা আমাকে রক্ষা করত। বলত, ও তো সব সময় বই পড়ে। এভাবেই শুরু হলো। ‘কবিতা’পত্রিকায় যদি লেখা ছাপা না হতো, তাহলে হয়তো আমি কবিতায় লেগেই থাকতাম না।

সুমনা: এটা আপনার কবিজীবনের বড় একটা পাওয়া?

শহীদ: হ্যাঁ, তখন আমাদের বিখ্যাত বিখ্যাত লেখককে নরেশ গুহ চিঠি লিখতেন ‘কবিতা’ থেকে, ‘কবিতা পেলাম, ছাপা গেল না।’ বুদ্ধদেবের রুচির ওপর আমাদের আস্থা ছিল। তিনি যদি মনে করেন কবিতা, তাহলে ওটা কবিতা হয়েছে। উনি মনে না করলে হয়নি। আমি শামসুর রাহমানকে বলেছিলাম, বুদ্ধদেব যদি ছাপেন, তাহলে আমি লিখব ভবিষ্যতে। আল মাহমুদ আর আমার কবিতা ছাপা হলো একই সংখ্যায়। আল মাহমুদ বলল, তুমি আমাকে না জানিয়ে...। আমি বললাম, আমি তো তোমাকে দেখেই পাঠিয়েছি।

সুমনা: এখন কি যোগাযোগ হয় আপনার সঙ্গে শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদের?

শহীদ: না।একটা ইন্টারভিউতে বলেছিলাম, আল মাহমুদ সাম্প্রদায়িকতা আর আধ্যাত্মিকতাকে গুলিয়ে ফেলেছে। তাতে সে খুব রাগ করেছে। তবে আমি তাকে বড় কবি বলেই মনে করি। কিন্তু ওটা তো আমার পক্ষে সমর্থন করা সম্ভব না।

সুমনা: কবি হিসেবে আল মাহমুদকে আপনি বড় কবি বলে মনে করেন?

শহীদ: হ্যাঁ, সমসাময়িকদের মধ্যে।

সুমনা: শামসুর রাহমানের সঙ্গে যোগাযোগ হয় না?

শহীদ: শামসুর রাহমান টেলিফোনে খুব ম্রিয়মাণ। কথা বলতে চায় না। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বের করতে হয়। গত বছর ফোনে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক কথা বলেছিলাম। আমি অসুস্থ হওয়ার পর শামসুর রাহমানও আমাকে ফোন করেছিল। ফোন করে বলল, শহীদ, আই প্রে ফর ইয়োর ফুল রিকভারি।

সুমনা: আপনি দেশ থেকে কবে চলে আসলেন?

শহীদ: ১৯৭৮-এ।

সুমনা: শুনেছি, আপনার মনে পাহাড়প্রমাণ অভিমান জমে আছে। কেন?

শহীদ: ১৯৭৬-এ ঢাকায় আমি অ্যাকসিডেন্ট করি, গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট। ঢাকা মেডিকেল কলেজে নয় মাস ছিলাম, হুইল চেয়ারে। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসার পরও এক বছর আমাকে ফিজিওথেরাপি করতে হয়েছিল। এক কবি তখন রোজ আসে। সে বলল, শহীদ ভাই, একটা ছাপাখানা পাওয়া যাচ্ছে, অল্প দামে—১০–১২ হাজার টাকায়। আমরা নিতে পারলে ভালো হতো। আমি বললাম, নিয়ে নাও। ভাবলাম, দূর, আর চাকরিবাকরি করব না। আমার ভাই তখন টেক্সটাইল করপোরেশনের পরিচালক। একদিন আমি ওর অফিসে গিয়েছি। ওর একজন সহপাঠী, একটা টেক্সটাইলের ম্যানেজার, এসেছেন সেখানে। আমাকে বলল, তুমি কত কাজ চাও? কাজ করে তো তুমি শেষ করতে পারবে না। আমি অন্যান্য ম্যানেজারকেও বলে দেব। পরে শুনি, ওরা বলছে, তোমার ভাই সবাইকে ফোন করে তোমাকে কাজ দিতে মানা করে দিয়েছে।

সুমনা: কেন?

শহীদ: ভাইয়াকে বললাম, তুমি এটা করলে কেন? সে বলল, তুমি করবে কাজ; আর লোকে মনে করবে, আমি ঘুষ খাচ্ছি। কিন্তু যে লোকটা আমাকে অফার করেছিল, তাকে আমি ছেলেবেলা থেকে চিনি, ভাইয়ার ক্লাসমেট। ভাইয়া ওটাও বন্ধ করে দিল। যাক গিয়ে, এরপর সেই কবি রোজ সন্ধ্যায় আসে। তিন-চার মাস যাওয়ার পর হঠাৎ দেখি, সে আসা বন্ধ করে দিল। কী কারণ, বুঝলাম না। গেলাম প্রেসে।

সুমনা: তখন আপনি সুস্থ?

শহীদ: সুস্থ, কিন্তু সেভাবে হাঁটতে পারি না। প্রচণ্ড ব্যথা। ওই অবস্থাতেই গেলাম। গিয়ে সেই কবিকে পেলাম না। একটা অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে দেখি, কবি সেখানে। বললাম, তোমার তো কোনো পাত্তা নাই। তুমি আসো না কেন? বলল, ব্যস্ত আছি। বলি, কী নিয়ে ব্যস্ত? প্রেসের কী অবস্থা? সে বলল, প্রেসের অবস্থা আপনার জানার কী দরকার? আমি বলি, কী বলছ তুমি? বলল, প্রেস ভালোই আছে। প্রেস তো আমার। আমি বললাম, টাকা তো আমি দিলাম। তোমার প্রেস হলো কী করে? সে বলল, না, কিনেছি তো আমি।

সুমনা: কী বলেন?

শহীদ: হ্যাঁ। এ ঘটনা তো সবাই জানে। আমি ভাবলাম, কী করি? একটা কিছু তো করতে হয়। তখন রেক্স–এ আড্ডা মারতাম। ওখানে কিছু পালোয়ান ব্যায়াম করত। আমি এক পালোয়ানকে চিনতাম। বাঙালি ছেলে, ভালো পালোয়ান। ইরানে পালোয়ানি করতে গিয়েছিল। ওকে বললাম, এই অবস্থা। শুনে ও বলল, আজিমপুরে যে গুণ্ডাপান্ডা আছে, ওদের আমি বলে দেব। কী চান আপনি? আমি বললাম, ওদের বলো, প্রেসটা ভেঙে দিতে। ওরা গিয়ে প্রেস ভেঙে দিল। পরে আমি ভাবলাম, দুর, আর থাকব না এ দেশে।

শহীদ কাদরী প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
শহীদ কাদরী প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

সুমনা: ওই কবির সঙ্গে আপনার যোগাযোগ এরপর আর হয়নি?
শহীদ: হয়েছে। তার বই বের হয়েছে। বইয়ের পেছনে আমি লিখেও দিয়েছি। টাকা তো আমার কাছে বড় কোনো ব্যাপার কোনো সময়ই ছিল না। মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল।
সুমনা: এরপর দেশ ছেড়ে চলে এলেন?
শহীদ: ১৯৭৮ সালে। প্রেসের ঘটনার পর একদিন ফজল শাহাবুদ্দীন আমাকে বলল, আসো, আমরা একটা অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি করি। তখন সাধনা ঔষধালয় ছিল। বছরে ওদের কয়েক লাখ টাকার কাজ হয়। ওর যে মালিক, সে আমার ক্লাসমেট। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমি ওর কাছে গেলামও। ও বলল, ঠিক আছে। আমার সঙ্গে যাদের কন্ট্রাক্ট আছে, সেগুলো শেষ হয়ে যাবে। তারপর তোমার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করে নেব। আমার কোনো সমস্যা নাই। ফজল শাহাবুদ্দীন তখন আমাকে বলে কি, তুমি এক কাজ করো, তুমি কন্ট্রাক্টগুলো আনো, তোমাকে একটা পার্সেন্টেজ দিয়ে দেব, কিন্তু মালিকানা আমার থাকবে। আমি বললাম, দোস্ত, এর মধ্যে আমি নাই। আমাকে তুমি দালাল ভেবেছ নাকি? আমি কি দালাল? ওই টাকার আমার দরকারই নাই। তারপর চলে আসলাম।
সুমনা: প্রবাসজীবন আপনার কি ভালো লেগেছে?
শহীদ: আমি ভালো ছিলাম লন্ডনে।
সুমনা: আপনি কি সরাসরি লন্ডনে গিয়েছিলেন?

শহীদ: প্রথমে জার্মানি গিয়েছিলাম। জার্মানিতে গিয়ে ভাবলাম যে, সারা জীবন ইংরেজি সাহিত্য পড়লাম, একটু লন্ডনে না গেলে কীভাবে হয়। লন্ডনে গিয়ে...ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে।

সুমনা: কীভাবে ফান্দে পড়িল বগা? পুরোনো স্মৃতি কি চমৎকারভাবে আপনি মনে রাখতে পেরেছেন। কোনো রকম জং ধরেনি?

শহীদ: না। আমার স্মৃতিশক্তি ভালো। ফটোগ্রাফিক মেমরি। আমি একবার পড়লেই মনে থাকে।

সুমনা: লন্ডনের সেই ফান্দে পড়া জীবন কেমন কাটল?

শহীদ: না। ওই মহিলার জন্যই তো পরে আমি আমেরিকায় এলাম।

সুমনা:তাঁর সম্পর্কে কিছু বলবেন না?

শহীদ: কী আর বলব, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বিষাক্ত ও তিক্ত হয়ে গেছে। ওই প্রসঙ্গে আর যেতে চাই না। ছেলে আসার সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে বদলে গেল। আমার প্রথম বিয়ে তো তুমি জানোই। এক বাঙালি ভদ্রমহিলার সঙ্গে। লন্ডনে থাকতেই ডিভোর্স হয়েছে।

সুমনা:তিনি তো দেশেই থাকতেন?

শহীদ: হ্যাঁ।

সুমনা: ছেলের বয়স তখন কত?

শহীদ: পাঁচ-ছয় বছর হবে। ওকে যখন নিয়ে আসি, তখন ওর বয়স ১২। আমার তৎকালীন স্ত্রী ভয় পেত যে আমি হয়তো ছেলেকে নিয়ে চলে যাব।

সুমনা: তিনি কি ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন?

শহীদ: আমেরিকান। ইংল্যান্ডের একটি বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করত। ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল বিবিসি ক্লাবে। ও সাহিত্য সম্পাদনা করত। আমি ওর সঙ্গে কথা বললাম। এই আর কি, টুকটাক টুকটাক করে...

সুমনা: ছেলে এখন কেমন আছে?

শহীদ: ছেলে ভালো আছে। ভালো করছে। আছে নিউইয়র্কে। ডাবল মেজর করেছে। একটি ভালো কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে। বাংলা বলে না, ইংরেজি বলে। ভাত-টাতও খায় না।

সুমনা: আপনার সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন?

শহীদ: ওর যখন মনে কোনো কথা আসে, তখন ফোন করে। ও আবার পড়ে প্রচণ্ড। সাহিত্য পড়ে।

সুমনা: বাবার কবিতা পড়ে?

শহীদ: বাংলা পড়তে পারে না তো। আমাকে বলে, আব্বু, তুমি ইংরেজিতে লেখো না কেন?

সুমনা: আপনি কি কখনো ইংরেজিতে কবিতা লিখেছেন?

শহীদ: না।

সুমনা: আপনার কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে?

শহীদ: অনেক। শোনো, আমি জীবনে কোনো জিনিস কখনো সংগ্রহ করে রাখিনি।

সুমনা: আপনাদের প্রজন্মের অনেকেই বোধ হয় এ রকম।

শহীদ: না, না। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ—এরা বেশ গোছালো ছিল। আমার প্রথম বই ওভাবেই বেরিয়েছে। প্রথম বইয়ের জন্য যখন প্রস্তাব পেয়েছি, তার তিন বছর পরে সেটা বেরিয়েছে। কারণ লেখাগুলো আমি জোগাড় করতে পারছিলাম না। ওরা চেয়েছিল, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ আর আমার কবিতাগুলো একটা প্যাকেট করে বের করবে। শেষে আল মাহমুদ একদিন আমার এখানে এসে বলে, মিয়া, তোমার বই হবে না, আমাদেরও বই হবে না তোমার জন্য। এটা কী করছ? আমি বললাম, আমার কাছে তো কবিতা নাই। ও বলল, তোমার কবিতা তো আমার কাছে আছে। আমি বলি, তুমি তো বলো নাই আমাকে। আমি আড্ডায় ব্যস্ত। ঘুম থেকে উঠি, স্কুলে যাই, ফাঁক পেলে আড্ডা মারি। আমার তো সময় নেই এসব করার।

সুমনা: হারিয়ে গেছে কি কিছু এভাবে?

শহীদ: হ্যাঁ, বেশ কিছু লেখা হারিয়ে গেছে। যেসব পত্রিকায় শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদের সঙ্গে আমার লেখা ছাপা হয়েছে, ওগুলোর প্রত্যেকটা ওরা সংরক্ষণ করেছে। ওরা মিলিয়ে দেখল, ওগুলো দিয়ে একটা বই হয়ে যায়। ওরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে আনল। আল মাহমুদ আমার বাসায় আসত। ‘সমকাল’–এ কিছুদিন কবিতা দেখত। বলত, এই কী লিখেছিস, বের কর। আমি বলি, না, এগুলো কিছু হয় নাই। ও বলত, দেখি, দেখি, আমি এটা নিয়ে গেলাম। ওই যে ছিঁড়ে নিয়ে যেত না, আমার কাছে আর কোনো কপি থাকত না। তো, একগাদা দিল শামসুর রাহমান, একগাদা দিল আল মাহমুদ। ওগুলো মিলিয়ে বইয়ের পাণ্ডুলিপি করে আমি দিয়ে দিলাম।