নিসর্গে নির্জন গণেশ হালুই

বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের আয়োজনে গত ২৮ আগস্ট শুরু হয়েছে ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী গণেশ হালুইয়ের চিত্র প্রদর্শনী। ‘বাস্তবের ছন্দ’ শিরোনামে এ প্রদর্শনীতে সহায়তা দিচ্ছে প্রথম আলো। প্রদর্শনী চলবে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত

শিল্পী: গণেশ হালুই, ‘শিরোনামহীন-৪৭’
শিল্পী: গণেশ হালুই, ‘শিরোনামহীন-৪৭’

আজন্মকাল ধরে শিল্পী গণেশ হালুইয়ের ছবিতে এক প্রবহমান নিঃসঙ্গতা থেকে গেছে। বিচ্ছিন্নতা তাঁর চিত্রধারায় অনিবার্য উপকরণ, যার শুরুতে কোথাও নিরন্তর সংঘাত ছিল—ব্যক্তি আর সমাজের বলয়ে। শিল্পী বলেছিলেন, সবকিছুর উৎসে কোনো এক যন্ত্রণা থাকে। সে কারণেই বিমূর্ত-নিসর্গের প্রাজ্ঞ শিল্পী হয়েও নিছক প্রকৃতিবাদিতাকে আশ্রয় করেননি তিনি—নিসর্গচিত্রে নিজস্ব আঙ্গিক আর প্রকাশভঙ্গি নির্মাণ করেছেন, যা তাঁকে ভারতের সমকালীন চিত্রধারার অগ্রজ শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বেঙ্গল গ্যালারির ‘বাস্তবের ছন্দ’ পর্বে, ওয়াটার কালার আর গোয়াশে গণেশ হালুইয়ের স্বতন্ত্র চিত্রধারা আরও প্রাজ্ঞ হয়ে উঠেছে।
গণেশ হালুইয়ের জন্ম পূর্ববঙ্গের জামালপুরে, ১৯৩৬ সালে। ব্রহ্মপুত্রের বদ্বীপ অধ্যুষিত ভূখণ্ডে বেড়ে ওঠা; তারপর দেশভাগের আশ্চর্য করুণ দিনলিপি লিখতে লিখতে ওপারে চলে যাওয়া, সেটা ১৯৫০ সাল। কলকাতার চারু ও কারু মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন ১৯৫৬ সালে। দীর্ঘদিন নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন বিমূর্তধারার নিসর্গচিত্রে, যদিও তাঁর শুরুটা অজন্তার ম্যুরাল স্টাডি দিয়ে, যা তাঁর ছবিতে বর্ণনাধর্মিতা আর বৌদ্ধধর্মের শান্ত-সমাহিত মিনিমালিস্ট অভিব্যক্তি নিয়ে এসেছে।
রেখা, বিন্দু কিংবা জলের অধঃক্ষেপে সংকেতচিহ্নের মতো তাঁর ছবিতে জল, মাটি এবং শ্যামলিমা নির্ভার-নিরবচ্ছিন্ন। সেখানে সন্তর্পণে জ্যামিতির বিসর্জন আছে, ভাসমান প্রান্তরে ক্ষীণতর যথাসামান্য সরলরৈখিক ছায়া আছে। এই প্রকৃতি দূরবর্তীভাবে বাংলার, এখানে নিরুত্তাপ বর্ণের একমুখিন বিস্তৃতির মধ্যে কৃষিক্ষেত্রের বিভাজন আর নদীমাতৃক ভূখণ্ড চোখে পড়ে।
কুমড়ো ফুলে নুয়ে পড়া লতায় ঘনঘোর বর্ষা আর পরিপার্শ্বের ভ্রাম্যমাণ মেঘ তাঁর ছবিতে কিউবিস্ট হয়ে উঠতে পারত, কেবলই ত্রিকোণ হতে পারত পাহাড়। যেমন বৃত্তের গায়ে রেখাই যথেষ্ট বৃক্ষের স্থাপনায়, সেভাবে বিমূর্তের সহজতর জ্যামিতিতে শিল্পী বিচরণ করেননি। তাঁর পাহাড়ের গায়ে মাটির ঘন আভরণ লেগে থাকে আর সহজ নীল বেঁকে যায় নদী হয়ে। চিরপরিচিত বাস্তব প্রকৃতির সঙ্গে বিমূর্তের ছন্দ এখানে প্রলেপের মতো অস্ফুট লেগে থাকে।
দ্বিমাত্রিক কম্পোজিশনকে তিনি অনায়াস ঋদ্ধতা দিয়েছেন; এখানে আনুভূমিক স্থিতিই প্রধান। ফর্মের বিন্যাসে কৌণিকতা যদিবা আসে, তবে তা পারসপেক্টিভের আপাত গণিতে; আগন্তুক কোনো গতির আরোপণে নয়। কিংবা কখনো অমোঘ বাতাস যদি আসে, তাঁর ছবিতে বস্তুকণারা ভেসে যায়, এমনকি পাহাড়ও। এভাবে শিরোনামহীন হতে হতে তুলট কাগজে ভেসে গেছে নদী, মেঘ, লতাপাতা-গুল্ম আর অঝোর বৃষ্টিপাত।

‘শিরোনামহীন-৬৭’
‘শিরোনামহীন-৬৭’


বর্ণমুখরতায় গণেশ হালুইয়ের আগ্রহ সীমিত, তিনি ফর্মের আউটলাইনকে প্রাধান্য দেন। আর এতে ছায়া-প্রচ্ছায়ার গভীরতা অতিপ্রাকৃতিক হয়ে ওঠে। সাদা-কালোর সারল্যে বস্তুকণারা নির্লিপ্ত থেকে যায়। ছবির ফ্রেমে বিষয়বস্তুর সমাবেশে শিল্পী প্রবলভাবে স্থাপত্যিক। টু-পয়েন্ট, থ্রি-পয়েন্ট পারসপেক্টিভকে ভেঙে দিয়ে নতুন ত্রিমাত্রিক পরিসর নির্মাণ করেন তিনি।
নিসর্গকে তিনি দেখছেন উড়ে যাওয়া পাখির দৃষ্টিতে। কেননা অনেকটা পরিসরজুড়ে তিনি অধিকার করতে চেয়েছেন প্রান্তরকে। তাঁর ছবিতে, নিজস্ব নির্জনে কোথাও মানুষের চলাচল নেই, শব্দ নেই, সামাজিক যোগাযোগ নেই। যেন তিনি মানুষের বিসর্জন চান নিসর্গে, এমনকি নিজেরও।
তাঁর ব্যক্তিগত নির্বাণযাত্রা মহাজাগতিক এক প্রকৃতির কাছে সমর্পিত। এই প্রকৃতি পরিচিত পটভূমি থেকে উঠে আসেনি। শিল্পীর কোনো এক ব্যক্তিগত নিসর্গ আছে । সেখানে সবই ক্ষীণধারা জল আর বাদামি রোদে ভেসে থাকা বৃক্ষের মতো পরিমিত রেখা এবং রং। কখনো তা দূরের, যেন জানালার ওপাশে বন পার হয়ে পথ, পথের শেষে সবুজ মাঠ-রেললাইন পার হয়ে হলুদ আকাশে শুচিস্নিগ্ধ বৃষ্টি নেমেছে। তার পতনের শব্দেরা আসবে না জেনে শিল্পী কোনো একটি স্মৃতিচিহ্ন এঁকেছেন জলের রঙে। কখনো তিনি নিঝুম শেওলার গাঢ় সবুজ অন্ধকারে ডুবে গেছেন। ছবিতে উঁকি দিয়ে গেছে মিরো, ক্যান্ডিনিস্কি কিংবা ক্যালডারের মুক্ত ফর্ম। তবু সব ছাপিয়ে গণেশ হালুইয়ের নিঃসঙ্গ ব্যক্তিগত অভিযাত্রাই মৌলিক হয়ে উঠেছে।
ব্রহ্মপুত্রের অবিরল জলধারা, পূর্বপুরুষের অপস্রিয়মাণ ছায়া আর ধর্মযুদ্ধের হন্তারক চাহনি মনে পড়ে গেলে তিনি পরিত্যক্ত দুঃখকে আনন্দের রঙেই চিত্রিত করেন। এত যে বিমূর্ত প্রকৃতি, রেখায়-রঙে-বিন্দুতে, জাগতিক ঋতুচক্রে, তাতে শেষাবধি মানুষ থাকল না? মানুষ কি প্রকৃতির বিরুদ্ধজন, যাকে শিল্পী সন্তর্পণে সরিয়ে রাখেন? মানুষ কি কেবলই বারুদ?
নিশ্চিতভাবে এই ভূখণ্ডে গণেশ হালুইয়ের পদচারণ স্মৃতিতাড়িত। অপরিসীম নৈঃশব্দ্যের ভেতর সেই স্মৃতির উদ্যাপনকে তিনি ‘শিরোনামহীন’ রেখেছেন। একই সঙ্গে পরিমিত সংকেত, নিয়ন্ত্রিত চাহনি, অস্বচ্ছ কিংবা প্রবল জলরঙে ব্যক্তিগত নিসর্গের নির্মাণ বিধৃত করেছেন। সেখানে কেবল নিরেট বস্তু নেই, তার উদ্ভাস আছে, স্মৃতির তাড়না নেই, তার সংকলিত অধঃক্ষেপ আছে। তুলট কাগজে অবিরল শূন্যস্থান আছে, তুলির টানে অপ্রচলিত ধ্রুপদ পরিমিতি আছে। যতটা প্রয়োজন তার চেয়েও সংক্ষিপ্ত সেই রূপকল্পে বৌদ্ধধর্মের প্রশান্তির মতো হোমগন্ধ লেগে থাকে।