ঘূর্ণিঝড়ের কবলে উপকূল

ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র প্রভাবে উত্তাল সমুদ্রের জোয়ারের ধাক্কায় ভেঙে পড়ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে সৃজিত ঝাউবাগান। গতকাল দুপুরে তোলা ছবি l প্রথম আলো
ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র প্রভাবে উত্তাল সমুদ্রের জোয়ারের ধাক্কায় ভেঙে পড়ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে সৃজিত ঝাউবাগান। গতকাল দুপুরে তোলা ছবি l প্রথম আলো

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র প্রভাবে দেশের উপকূলজুড়ে ঝোড়ো হাওয়া ও বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। দেশের চারটি সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আজ মঙ্গলবার ভোর পাঁচটার পর ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করার কথা।

এ পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরের জন্য ১০ নম্বর মহা বিপৎসংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। একই সঙ্গে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৮ নম্বর মহা বিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। ১০ নম্বর মহা বিপৎসংকেতের অর্থ হচ্ছে, বন্দর (এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর) প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে নিপতিত। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা তার বেশি। ঝড়টি বন্দরের ওপর দিয়ে বা নিকট দিয়ে উপকূল অতিক্রম করবে।

ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে এর পরবর্তী পর্যায় হচ্ছে ১১ নম্বর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সংকেত। এই সংকেতের অর্থ হচ্ছে, আবহাওয়ার বিপৎসংকেত প্রদানকারী কেন্দ্রের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং স্থানীয় কর্মকর্তা আবহাওয়া অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ বলে মনে করেন।

সূত্র: নাসা
সূত্র: নাসা

প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম রাতে ভিয়েনা থেকে ফোনে বাসসকে জানান, সেখানে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র বিষয়ে ঢাকার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। তিনি ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রশাসনকে সর্বাত্মক প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।

প্রচণ্ড মাত্রার এই সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ক্রমশ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে। ক্রমেই সেখানে বৃষ্টি ও বাতাসের গতি বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায় ঘূর্ণিঝড়টি কক্সবাজার উপকূল থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ ৮০ থেকে ১১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। রাত ১১টায় চট্টগ্রাম থেকে ৩৬০ কিলোমিটার, মোংলা থেকে ৪৩০ এবং পায়রা থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল।

চট্টগ্রাম থেকে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম তলিয়ে গেছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে দমকা বাতাস বইতে শুরু করেছে।

দুর্গত মানুষের জন্য এই দুই জেলার ১ হাজার ৩৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি ও দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর জন্য সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চিকিৎসক-নার্সদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

সন্ধ্যা ছয়টায় ঘূর্ণিঝড়-সংক্রান্ত আবহাওয়া অধিদপ্তরের ১২ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে ও তৎসংলগ্ন এলাকা থেকে উত্তর দিকে (অর্থাৎ বাংলাদেশ উপকূলের দিকে) অগ্রসর হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ছাড়াও উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর এবং এই জেলাগুলোর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ১০ নম্বর বিপৎসংকেতের আওতায় থাকবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৮ নম্বর মহা বিপৎসংকেত দেখাতে বলেছে। ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং এই জেলাগুলোর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৮ নম্বর মহা বিপৎসংকেতের আওতায় থাকবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং জেলাগুলোর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে চার থেকে পাঁচ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

ঘূর্ণিঝড়টি উপকূল অতিক্রমের সময় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর এবং জেলাগুলোর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোতে অতি ভারী বর্ষণসহ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা তারও বেশি বেগে দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। গত রাতে এ প্রতিবেদন লেখার সময় উপকূলীয় অঞ্চলে ঝোড়ো বৃষ্টি শুরু হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

গতকাল দিনভর আবহাওয়া অধিদপ্তর একের পর এক বিপৎসংকেত বাড়িয়েছে। আর তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। গতকাল বিকেলেই ঢাকার সদরঘাট থেকে দেশের ৩৭টি রুটে সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল, পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় জেলাসমূহে আঞ্চলিক নৌযান এবং ফেরি চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য আঘাতস্থল উপকূলীয় সব জেলায় মোট প্রায় তিন হাজার আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়। সমুদ্রে মাছ ধরা বন্ধ করে দিনের ভাগেই জেলেরা তীরে ফিরে আসেন।

গত শনিবার পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে গত রোববার মধ্যরাতে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। ঘূর্ণিঝড়টির নামকরণ করা হয়েছে ‘মোরা’। এর অর্থ সাগরের তারা (স্টার অব দ্য সি)। এই ঘূর্ণিঝড় এমন এক সময়ে এসেছে, যখন বর্ষাকালের সূচনা ঘটাতে মৌসুমি বায়ুও বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশে ঢোকার মুখে রয়েছে। এর ফলে ঘূর্ণিঝড়ের বিরূপ প্রভাব প্রকটতর হতে পারে বলে কয়েকজন আবহাওয়াবিদের অভিমত।

সরকারের প্রস্তুতি

ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ মোকাবিলায় সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। উপদ্রুত এলাকার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সচিবের দায়িত্বে) গোলাম মোস্তফা।

গতকাল সোমবার সচিবালয়ে গোলাম মোস্তফা সাংবাদিকদের বলেন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা করে সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জেলা-উপজেলার সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় উদ্ধার তৎপরতা চালাতে পর্যাপ্ত নৌযান প্রস্তুত রাখতে জেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সংকেত অনুযায়ী সমুদ্রে অবস্থানরত সব জাহাজ ও ট্রলারকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা-উপজেলা প্রশাসন দুর্যোগ মোকাবিলা ও দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার অভিযান চালানোর জন্য প্রস্তুত আছে। রেড ক্রিসেন্ট, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্য স্বেচ্ছাসেবকদেরও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬২ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ১১৭ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে।

এর আগে গত ১৫ এপ্রিল সকালে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় এবং পরদিন তা ঘূর্ণিঝড় ‘মারুথা’য় রূপ নেয়। পরে সেটি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করে।