পদ্মায় শত শত রঙিলা সারস

একঝাঁক উড়ন্ত রঙিলা সারস। ২৩ অক্টোবর রাজশাহীর পদ্মায় l ছবি: মো. কায়েস
একঝাঁক উড়ন্ত রঙিলা সারস। ২৩ অক্টোবর রাজশাহীর পদ্মায় l ছবি: মো. কায়েস

রোদেলা বিকেল। পাখিপ্রেমিক কায়েস-শাওন-শোভনদের সাতজনের দল ক্যামেরা হাতে রাজশাহী পুলিশ লাইনসে পাশের টি-বাঁধ ঘাটে অনিক মাঝির নৌকায় চাপল। কিছুটা এগোতেই চর খানপুরের দিক থেকে বিশাল একটা পাখির ঝাঁক আসতে দেখল। ওরা ভেবেছিল শামুকখোল, কারণ রাজশাহীতে অগুনতি শামুকখোলের বাস। আমি গত আগস্টে জেলখানার বড় বড় গাছে প্রায় চার শ শামুকখোলের বাসা দেখেছি। কিন্তু খানিক পরেই ভুল ভাঙল। এদের মাথা তো সোনারঙা! কিছু উড়ন্ত ছবি উপহার দিয়ে সারসের ঝাঁক মুহূর্তেই যেন শহরের আকাশে ঢুকে পড়ল। সদ্য তোলা ছবি রিভিউ করে ঝাঁকে কমবেশি ১৪০টি পাখি পেল। একসঙ্গে ৫০টি এই প্রজাতির পাখি দেখারও কোনো রেকর্ড নেই এ দেশে।

মিনিট কুড়ি পরে ওদের অবাক করে দিয়ে পাখির ঝাঁকটি শহর থেকে উড়ে গিয়ে চর খানপুরে যাওয়ার প্রথম বাঁকের কাছে ডুবোচরে বসল। হঠাৎ করেই কোত্থেকে এক ঝাঁক মৌমাছি এসে অাক্রমণ করল। শেষমেশ মাঝি নৌকার ইঞ্জিনের স্পিড বাড়িয়ে-কমিয়ে কালো ধোঁয়া তৈরি করে পতঙ্গগুলোকে তাড়ালেন। সূর্য তখন পড়ন্ত। দূর আকাশের সোনারঙা পাখিদের মাথার রঙের সঙ্গে মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গেল। প্রায় চল্লিশ মিনিট পাখিগুলো ডুবোচরে বসে থাকল। এরপর যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে, অর্থাৎ ভারত সীমা‌ন্তের দিকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। সোনারঙা এই সারসের ঝাঁক মহাবিপন্ন পরিযায়ী রঙিলা সারস। সোনা জঙ্গা, রাঙা মানিকজোড় বা রঙিলা বক নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Painted Stork। Ciconidae পরিবারের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Mycteria leucocephala

রঙিলা বক লম্বায় ৯৩ থেকে ১০২ সেন্টিমিটার, ওজনে ২ দশমিক শূন্য থেকে ৩ দশমিক ৫ কেজি। মাথার পালকবিহীন অংশ কমলা-হলুদ। লম্বা ঠোঁটটি হলদে। মেটে-বাদামি পায়ে যেন আলতা মাখানো। ঘাড় ও পিঠ সাদা। দেহের নিচটা সাদা এবং বুকে কালো ছোপ। ডানার ওপরটা কালো এবং তাতে সাদা ছোপ। লেজের পালকেও আলতা-লাল রং মাখানো। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি ফ্যাকাশে সাদা। এদের মাথা-ঘাড়-ডানার পালক-ঢাকনি বাদামি।

রঙিলা বক এ দেশের সাবেক আবাসিক পাখি। দেশব্যাপী বিচরণ করত। কিন্তু নানা কারণে এ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এত দিন শীতে অনিয়মিতভাবে এলেও তিন-চার বছর ধরে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এরা প্রায় বিপদগ্রস্ত। জলমগ্ন মাঠ, নদীর তীর, জোয়ার-ভাটার কাদাচর, হ্রদ ইত্যাদিতে জোড়ায় জোড়ায় বা ছোট দলে বিচরণ করে। অল্প পানিতে হেঁটে এবং কাদায় ঠোঁট ঢুকিয়ে মাছ, ব্যাঙ, চিংড়ি, বড় কীটপতঙ্গ ইত্যাদি খায়। সাধারণত চুপচাপ থাকে। তবে প্রজনন মৌসুমে নিচু স্বরে গোঙানোর মতো শব্দ করে।

জুলাই-অক্টোবর প্রজননকাল। পানিতে দাঁড়ানো উঁচু গাছের মগডালে ডালপালা দিয়ে মাচানের মতো বড়সড় বাসা বানায়। একই গাছে দলবদ্ধভাবে বাস করে। বাসা তৈরি হলে স্ত্রী তাতে তিন-চারটি সাদাটে ডিম পাড়ে, তাতে থাকে লম্বা বাদামি দাগ। ডিম ফোটে ২৮ থেকে ৩৫ দিনে। বাচ্চারা প্রায় ২৮ দিনে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল প্রায় আট বছর। কামনা করি, ওরা ফিরে আসুক এ দেশে পাকাপোক্তভাবে।