কপোতাক্ষের দুঃখ, দখল আর খনন

কপোতাক্ষ নদের মাঝখানে বেড়ি বানিয়ে এক পাশ দখল করে মাছের চাষ করা হচ্ছে। সম্প্রতি কেশবপুরের িত্রমোহনী এলাকায় l িদলীপ মোদক
কপোতাক্ষ নদের মাঝখানে বেড়ি বানিয়ে এক পাশ দখল করে মাছের চাষ করা হচ্ছে। সম্প্রতি কেশবপুরের িত্রমোহনী এলাকায় l িদলীপ মোদক

ভৈরব নদ থেকে কপোতাক্ষের যাত্রা যেখানে শুরু, ঠিক সেখানেই গড়ে তোলা হচ্ছে পানিগ্রাম রিসোর্ট। পাঁচ তারা হোটেলের সুযোগ-সুবিধা থাকবে রিসোর্টের ৪০টি কটেজে। এর তিনটি কটেজ কপোতাক্ষ নদের মধ্যে, ছোট একটি দ্বীপে। রিসোর্টের কর্মকর্তারা বলেছেন, গ্রামের মানুষের কাছ থেকে তাঁরা ১৮ একর জমি কিনেছেন। দ্বীপটি কেনা জমির অংশ। 

যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নে তাহেরপুর গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ভৈরব নদ। তাহেরপুর সেতু থেকে কয়েক শ গজ দূরে ভৈরব দুই ভাগ হয়েছে। পুব বা বাঁ দিকে মূল ভৈরব, আর ডান বা পশ্চিম দিকের শাখাটি কপোতাক্ষ।
ভৈরব বা কপোতাক্ষ-দুটি নদেই স্রোত নেই। কচুরিপানায় ভর্তি। তাহেরপুরের মানুষজন বলছেন, নৌকা চলে না এই পথে। ব্রিটিশ আমলে জাহাজ চলাচল করত, তার নিদর্শন আছে গ্রামে।
তাহেরপুর থেকে যাত্রা শুরু করে খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার শিববাড়িতে গিয়ে শেষ হয়েছে কপোতাক্ষ। সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা বলছেন, কপোতাক্ষ দৈর্ঘ্যে ১৮০ কিলোমিটার। যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দীর্ঘ নদটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুই পাড়ে শত শত দখলদার। কেউ ধান চাষ করছেন, কেউ কলার বাগান বা সবজির চাষ করছেন। ঘর তুলে দিব্যি বসবাস করছেন। ভূমি অধিদপ্তরের নানা রেকর্ড বা দলিলের কথা দখলদারদের মুখে শোনা যায়।
তাহেরপুর থেকে চৌগাছা সদরে এসে কচুরিপানার জমাট সবুজে হঠাৎ ধাক্কা লাগে। দেখা যায় ইটপাথরের ভবন নদের মাঝে। বাড়িঘর দেখে বোঝা যায়, এখানে নিম্নবিত্তের মানুষও কপোতাক্ষে দখল নিয়েছে।
চৌগাছা থেকে আরও দক্ষিণে এগোলে ঝিকরগাছা। সাদ্দাম পাড়ার বাসিন্দা ও ঝিকরগাছা মডেল হাইস্কুলের সাবেক শিক্ষক আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদী দখল করে একাধিক ব্যক্তি পুকুর তৈরি করেছেন। পূর্বপুরুষের জমির অজুহাত তুলে পৌরসভার প্রভাবশালী এক ব্যক্তি নদীর ১২ আনা (তিন-চতুর্থাংশ) দখল করেছেন।’
নৌকায় চলাচল করার মতো নাব্যতা পাওয়া যায় কেশবপুরের ত্রিমোহিনী বাজারে এসে। তাহেরপুর থেকে এই বাজারের দূরত্ব ৮৪ কিলোমিটার। এই বাজারে কপোতাক্ষের ওপরের সেতুটি বাঁশের তৈরি। সেতুর উত্তর পাশে কপোতাক্ষকে লম্বালম্বি দুই ভাগ করে রাস্তা তুলে মাছ চাষ হচ্ছে। যেন পারিবারিক সম্পত্তি দুই ভাই দুই ভাগ করে নিয়েছেন। এখানে যাঁরা মাছের চাষ করছেন তাঁদের একজন প্রথম আলোকে বলেছেন, নদীর মধ্যে গ্রামের মানুষের জমি আছে। সেই জমি ইজারা নিয়ে তাঁরা মাছ চাষ করছেন।

মধু কবির নদ
ত্রিমোহিনী থেকে দক্ষিণে কপোতাক্ষের চেহারা ভিন্ন। নদে স্রোত কিছুটা বোঝা যায়। কচুরিপানাও অনেক কম। ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি ভটভট শব্দে সামনে চলতে থাকে।
সন্ধ্যার কিছু আগে নৌকা পৌঁছায় সাগরদাঁড়িতে, কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ির ঘাটে। এই গ্রামের মানুষ দাঁড় বেয়ে একসময় সমুদ্রস্নানে যেতেন, সে জন্য নাকি গ্রামের নাম এমন। জোয়ারের পানি এককালে সাগরদাঁড়িতে পৌঁছাত। কপোতাক্ষ ভরাট হয়েছে, সাগরের পানি এখন আসে না। জানা যায়, ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কবির গ্রামের কাছে জোয়ারের পানি আসত।
কবির বাড়িতে একসময় স্কুল বসত। সেই স্কুলে পড়েছেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী আইনজীবী ও ঔপন্যাসিক ড. চিত্ত রঞ্জন দাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কপোতাক্ষের দুই পারের মানুষের দুঃখের শেষ নেই। কয়েক বছর ধরে কপোতাক্ষের দুই পাড়ের বিভিন্ন বিলে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। ফসল হচ্ছে না। মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।’ চিত্ত রঞ্জন দাসের বয়স ৬০ বছর। তাঁর কাছে কপোতাক্ষ অনেকটাই মৃত।
পাশের গ্রাম কোমরপুরের ভ্যানচালক নূর আলী বলেন, পাকিস্তান আমলে তাঁর ছোটবেলায় কপোতাক্ষে যেসব মাছ ছিল, তার কিছু এখন আর দেখাই যায় না।
সমস্যার শুরু তিন দশক বা তার আগে থেকে। সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে যশোর এলাকায় কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন গড়ে উঠেছে। আর সাতক্ষীরা এলাকায় পানি কমিটি গঠিত হয়েছে। এই কমিটি গঠনের পেছনে স্থানীয় এনজিও উত্তরণের ভূমিকা ছিল। পানি কমিটি আন্তর্জাতিক এনজিও অ্যাকশনএইডের আর্থিক সহায়তায় ২০০৯ সালে একটি জরিপ করেছিল। সেই জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, তাহেরপুর থেকে পাইকগাছার শিববাড়ি পর্যন্ত কপোতাক্ষের নিষ্কাশন এলাকায় (ক্যাচমেন্ট এরিয়া) গ্রাম আছে ৫৪৭টি আর জমির পরিমাণ ৯৪ হাজার ৭৪৪ হেক্টর। জরিপের সময় ৪৭০টি গ্রামের ৩৮ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে জলাবদ্ধতা ছিল।
২০০০,২০০৩ ও ২০০৮ সালে কপোতাক্ষ অববাহিকার বেশ কয়েকটি এলাকায় বন্যা হয়। আর জলাবদ্ধতা অব্যাহত থাকে অনেক বিলে। ২০১১ সালে বড় বন্যা হয়। বন্যা হয় ২০১৩ সালেও। বর্তমানে কেশবপুর, সাতক্ষীরা সদর ও কলারোয়া এলাকায় জলাবদ্ধতা আছে।

১৬ সেতু
নদীপথে যেতে বেশ কয়েকটি বড় সেতু চোখে পড়ে। বিভিন্ন সময় এসব সেতু তৈরি করা হয়েছিল। সেতু তৈরির সময় নদীর স্বার্থকে গুরুত্ব দেননি সেতু প্রকৌশলীরা। প্রতিটি ক্ষেত্রে সেতু তৈরির সময় নদীর প্রশস্ততা কমানো হয় বলে অভিযোগ আছে।
পানি কমিটির আহ্বায়ক ও চুকনগর কলেজের শিক্ষক হাসেম আলী ফকির বলেন, ১৯৯৪ সালে সরসকাটিতে ও ১৯৯৭ সালে কপিলমুনিতে সেতু তৈরির সময় নদের প্রশস্ততা ছোট করে ফেলা হয়। নদের মধ্যে একাধিক স্তম্ভ তৈরি করা হয়। স্তম্ভের গোড়ায় পলি জমে। বাধাগ্রস্ত হয় প্রবাহ।
তাহেরপুর থেকে পাইকগাছা পর্যন্ত কপোতাক্ষের ওপর সেতু আছে ১৬ টি। এর মধ্যে চৌগাছা উপজেলায় তিনটি, ঝিকরগাছা উপজেলায় ছয়টি, কেশবপুর উপজেলায় একটি এবং মনিরামপুর, তালা ও পাইকগাছা উপজেলায় দুটি করে।

খননে ক্ষতি
কপোতাক্ষে পলি জমে নাব্যতা কমে যাওয়ার সমস্যা দীর্ঘ দিনের। পানি উন্নয়ন বোর্ড পলি অপসারণের কাজও করছে দীর্ঘদিন ধরে। স্থায়ী সমাধান নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। কেউ বলছেন বুদ্ধির ঘাটতি, কেউ বলছেন আন্তরিকতার অভাব।
২০১১ সাল থেকে ‘কপোতাক্ষ নদ অববাহিকায় জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (১ম পর্যায়) ’ বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প ২০১৫ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখনো শেষ হয়নি।
যেমন তালা উপজেলায় পাখিমারার বিলে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) বাস্তবায়ন করার কথা। জোয়ারের পানি বিলে তোলা হবে, জোয়ারে আসা পলি বিলে পড়ে বিল ভরাট হবে। আবার ভাটার সময় বিলের পানি নদীতে ফিরে স্রোত বাড়াবে, ফলে নাব্যতা বাড়বে। এটাই এই প্রযুক্তির মূল কথা। কিন্তু জমির মালিকানা ও ক্ষতিপূরণের টাকা তোলা নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা।
উত্তরণের পরিচালক শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্পের কিছু কাজ হয়তো ঠিকমতো বাস্তবায়িত হয়নি। যেটুকু হয়েছে তাতেই কপোতাক্ষে স্রোত ফিরে এসেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড আন্তরিক হলে অবস্থার আরও উন্নতি হবে।’
এই প্রকল্পের আওতায় ত্রিমোহিনী থেকে বালিয়াগ্রাম পর্যন্ত কপোতাক্ষ ৯০ কিলোমিটার খনন করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে খনন করা মাটি অপরিকল্পিতভাবে নদীর দুই পাড়ে রাখা হয়েছিল। বর্ষায় সেই মাটি আবার নদীতে ফিরে এসেছে।
মূল নদ ছিল অনেক প্রশস্ত। খনন করা হয় কম প্রস্থে। এতে অনেক জায়গায় কপোতাক্ষ অনেক সরু হয়ে গেছে। এ ছাড়া যথেষ্ট গভীর করে খনন করা হয়নি বলে পানি কমিটির লোকজন অভিযোগ করেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কপোতাক্ষকে খনন করে ছোট করেছে। এতে লাভ হয়েছে দুই পাড়ের প্রভাবশালীদের। তাঁরা নদীর ছেড়ে দেওয়া জমিতে মনের আনন্দে চাষাবাদ করছেন। প্রায় ৯০ কিলোমিটারে এই দৃশ্য চোখে পড়ে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কেশবপুর প্রতিনিধি দিলীপ মোদক]