কাটা হচ্ছে চার হাজার গাছ

আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রশস্ত করতে প্রায় ৪ হাজার গাছ কাটা হচ্ছে।
ইতিমধ্যে সহস্রাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
☀  পরিবেশবাদীরা বলছেন, গাছ রেখেই সড়ক প্রশস্ত করা সম্ভব।
পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা।

মানিকগঞ্জ–সিঙ্গাইর–হেমায়েতপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের দুইপাশের গাছ কাটা হচ্ছে। গতকাল বিকেলে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার শিবপুর এলাকায় l প্রথম আলো
মানিকগঞ্জ–সিঙ্গাইর–হেমায়েতপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের দুইপাশের গাছ কাটা হচ্ছে। গতকাল বিকেলে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার শিবপুর এলাকায় l প্রথম আলো

মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রশস্ত করতে প্রায় ৪ হাজার গাছ কাটা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সহস্রাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু পরিবেশবাদীরা বলছেন, এসব গাছ রেখেই সড়কটি প্রশস্ত করা সম্ভব। এটা করতে না পারলে পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়বে।

এদিকে সুবিধাভোগীদের না জানিয়ে বাজারদরের চেয়ে কম দামে জেলা পরিষদ এসব গাছ বিক্রি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জেলা সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার হেমায়েতপুর থেকে মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার জরিনা কলেজ মোড় পর্যন্ত ৩১ কিলোমিটার এই আঞ্চলিক মহাসড়ক ১৭ ফুট চওড়া। এটি প্রশস্ত করে ২৪ ফুটে উন্নীত করা হবে। গাছ কাটা ছাড়া মহাসড়কটি সম্প্রসারণ করা সম্ভব নয়।

জেলা পরিষদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জ-সিঙ্গাইর-হেমায়েতপুর আঞ্চলিক মহাসড়কটি প্রশস্ত করার জন্য দরপত্রের মাধ্যমে এসব গাছ বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় জেলা পরিষদ। গত বছরের ৬ নভেম্বর দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র অনুযায়ী, ৩ হাজার ৭২৫টি গাছ ২৮টি গুচ্ছে বিক্রি করা হয়। সর্বোচ্চ দর ১ কোটি ৩৬ লাখ ১৪ হাজার ১৩৯ টাকায় গাছগুলো বিক্রি করা হয়।

গতকাল বুধবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, সিঙ্গাইরের বেতিলা, শিবপুর, ঘোনাপাড়া এলাকায় সড়কের পাশের করাত ও কুড়াল দিয়ে গাছ কাটছেন শ্রমিকেরা। ইতিমধ্যে আউটপাড়া, পালপাড়া ও ঘোনাপাড়া এলাকার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের সিঙ্গাইর উপজেলার সমন্বয়ক মহিদুর রহমান বলেন, দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে গাছগুলো কাটা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সহস্রাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।

ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক আজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সড়কের এক পাশে খালে অনেক জায়গা আছে। গাছগুলো না কেটে তা মাঝখানে রেখে সড়কটির পৃথক লেন করা যেত। তিনি বলেন, গাছ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। বিপুলসংখ্যক গাছ কাটার কারণে এলাকায় খরার তীব্রতা বাড়তে পারে।

স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন পাখি লালন করির (পালক) সদস্যসচিব বিমল রায় বলেন, ‘আমরা উন্নয়নের বিপক্ষে নই। জনসাধারণের সুবিধার্থে সড়ক-মহাসড়কগুলো সংস্কার কিংবা সম্প্রসারণ করা হোক, তবে সড়কের দুই পাশের গাছ নিধন করে নয়। সড়কের এক পাশের গাছ রেখেই সড়কটি সম্প্রসারণ করা যেত।’

সড়কটির এক পাশে ৬৫ থেকে ৮০ ফুট পর্যন্ত প্রশস্ত খাল ও পরিত্যক্ত জায়গা আছে বলে জানিয়েছেন জেলা পরিষদের জরিপকারী এনামুল হক। এই জায়গায় সড়কের সম্প্রসারিত অংশ করা যেত কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি সওজ কর্তৃপক্ষের। সংস্থাটি কীভাবে নকশা করেছে, সেটা তারাই জানে।

জানতে চাইলে জেলা সওজের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (সড়ক বিভাগ) আবদুর রহিম বলেন,এক পাশে গাছ রেখে বা মাঝখানে গাছ রেখে সড়কটি সম্প্রসারণ করা সম্ভব নয়। আঞ্চলিক মহাসড়কটিতে ছোট ছোট ২৪টি সেতু আছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ১৯৯১ সালে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের উদ্যোগে ১০টি সমিতির সদস্যরা সিঙ্গাইরের জয়মন্টপ থেকে ডেফলতলী পর্যন্ত ওই সড়কে ১০ হাজার গাছ রোপণ করেন। বর্তমানে ৪ সহস্রাধিক গাছ আছে। এসব গাছের মধ্যে মেহগনির সংখ্যা বেশি। উপজেলা পরিষদ থেকে সড়কের পাশের জায়গা ইজারা নিয়ে প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র স্থানীয় ১০টি সমিতির মাধ্যমে সদস্যদের দিয়ে গাছগুলো রোপণ করে।

উপজেলা পরিষদ ও সংস্থাটির লিখিত চুক্তি অনুযায়ী, এসব গাছ বিক্রির আয়ের ৬০ শতাংশ পাবেন সমিতির সদস্যরা। এ ছাড়া প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র ২০ শতাংশ এবং উপজেলা পরিষদ ২০ শতাংশ পাবে।

গাছের সুবিধাভোগী ১০টি সমিতির ২০০ সদস্য আছেন। এর মধ্যে আজিমপুর নবজাগরণ সমিতির সদস্য মোসলেম উদ্দিনসহ কয়েকজন জানান, প্রায় ২৭ বছর ধরে তাঁরা গাছগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন। অথচ সমিতির কোনো সদস্যকে গাছ কাটার বিষয়ে জানানো হয়নি, টাকাও দেওয়া হয়নি। তাঁদের অভিযোগ, বাজারদরের চেয়ে গাছগুলো অনেক কম মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে। এতে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তারা আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন।

প্রশিকার উপজেলা সমন্বয়ক মহিদুর রহমান বলেন, বর্তমানে ৪ সহস্রাধিক গাছ আছে। বাজারদরে এসব গাছের মূল্য ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। তবে বিক্রি করা প্রতিটি গাছের গড় মূল্য ৩ হাজার ৬৭৫ টাকা ধরা হয়েছে। তিনি জানান, চুক্তি অনুযায়ী গাছ বিক্রির টাকার অংশ তাঁদের (সুবিধাভোগী ও প্রশিকা) দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে তিনি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মহীউদ্দিন বলেন, প্রশিকা ও সমিতির সদস্যদের গাছ বিক্রির প্রাপ্ত টাকা দেওয়া হবে। কম দামে গাছ বিক্রির অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, গাছ বিক্রির জন্য জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ দরেই এসব গাছ বিক্রি করা হয়েছে।