অবশেষে শিশুটির দেখা পাচ্ছেন সেই মা

বাঁয়ের ছবিটিকে নিজের হারিয়ে যাওয়া সন্তান ঝুমুর বলে নিশ্চিত করেছেন আসমা। ডানের ছবিটির শিশুটিকে জান্নাতি নামে দত্তক দেওয়া হয়েছে।
বাঁয়ের ছবিটিকে নিজের হারিয়ে যাওয়া সন্তান ঝুমুর বলে নিশ্চিত করেছেন আসমা। ডানের ছবিটির শিশুটিকে জান্নাতি নামে দত্তক দেওয়া হয়েছে।

অবশেষে রাজধানী ঢাকার আজিমপুর ছোটমণি নিবাস থেকে দত্তক দেওয়া ‘জান্নাতি’ নামের শিশুটির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাচ্ছেন সেই মা। জান্নাতির সঙ্গে তিন বছর আগে তাঁর হারিয়ে যাওয়া মেয়ে ঝুমুরের চেহারায় মিল খুঁজে পাওয়ায় আসমা নামের এক নারী ওই শিশুটিকে নিজের সন্তান বলে মনে করছেন। সামনাসামনি দেখে তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি দেখা করার বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। আইনি জটিলতা দেখিয়ে তাঁকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি শিশুটির সঙ্গে।

এ নিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো অনলাইনে ‘জান্নাতি না ঝুমুর?’ শিরোনামে খবর প্রচারের পর নরসিংদীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আসমাকে শিশুটির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দিচ্ছেন। আদালতের হস্তক্ষেপে আসমা আজ মঙ্গলবার নরসিংদী গিয়ে এ ব্যাপারে একটি পিটিশন করেছেন।

প্রথম আলোর খবরটি নজরে আসার পর নরসিংদীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট চন্দন কান্তি নাথ আসমাকে সাহায্য করার উদ্যোগ নেন। আজ তাঁর আদালতে দত্তক দেওয়া মেয়েটির মা হিসেবে দাবি করে পিটিশন করেন আসমা। পিটিশনের ব্যাপারে তাঁকে সহায়তা করেছেন লিগ্যাল অ্যাইডের প্যানেল আইনজীবী লাবণী আমীন। এর আগে চন্দন কান্তি নাথের আদালত ২০১৬ সালের ১৬ মে জান্নাতি নামের ওই মেয়েটিকে আজিমপুর ছোটমণি নিবাসে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

আইনজীবী লাবণী আমীন পিটিশনের ব্যাপারে নিশ্চিত করে প্রথম আলোকে বলেন, আজ ঢাকা থেকে মেয়েটির বাবা ও মা দাবিদার মোতাহার হাওলাদার ও আসমা নরসিংদীর আদালতে আসেন। মেয়েটিকে দেখার সুযোগ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কিছু কাজ করা হয়েছে। তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র চাওয়া হয়েছে। পিটিশনে ডিএনএ টেস্টের বিষয়ে বলা হয়েছে। শিশুটি এবং তার মা দাবিদার আসমা দুজনের কাছ থেকে একসঙ্গে ডিএনএ টেস্টের নমুনা নেওয়া হবে। এই নমুনা মিলে গেল এই মেয়েটির মা আসমা কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যাবে।

জানা যায়, বিচারক চন্দন কান্তি নাথের আদালতে ২০১৬ সালে নরসিংদী থানা থেকে আদালতে ওই শিশুটিকে জান্নাতি নামে উপস্থাপন করা হয়। মেয়েটির অভিভাবকের খোঁজ না পাওয়ায় ঢাকায় ছোটমণি নিবাসে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক। এরপর দুটি পরিবার মেয়েটিকে নিজেদের সন্তান দাবি করে আদালতে পিটিশন করে। তবে ডিএনএ টেস্টে না মেলায় মেয়েটিকে হস্তান্তর করা হয়নি।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, প্রথম আলোর খবরে ‘জান্নাতি নামের শিশুটিকে আসমা নামের আরেক নারী নিজের সন্তান বলে দাবি করছেন’ বলে প্রকাশ পায়। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে শিশুটিকে আসমা সামনাসামনি দেখে যাচাই করার সুযোগ পাচ্ছেন না। বিষয়টি চন্দন কান্তি নাথের আদালতে উপস্থাপন করা হলে ওই নারীকে সহায়তা করার উদ্যোগ নেন।

পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে আসমার ডিএনএ টেস্ট করে তা শিশুটির সঙ্গে মেলে কি না তা দেখা হবে। শিশুটিকে সামনাসামনি দেখানোরও সুযোগ করে দেওয়া হবে।

মেয়ের ছবি হাতে আসমা। ছবিটি কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয় থেকে তোলা। ছবি: নাজনীন আখতার
মেয়ের ছবি হাতে আসমা। ছবিটি কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয় থেকে তোলা। ছবি: নাজনীন আখতার

আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন আসমা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। মেয়েটি আমার কি না, তা জানার সুযোগ পেলাম। মনে অনেক কষ্ট নিয়ে ঘুরি। দোয়া করবেন, এই মেয়েটি যেন আমার হারিয়ে যাওয়া ঝুমুর হয়।’

মোতাহার হাওলাদার ও আসমার তিন সন্তানের মধ্যে বড় ঝুমুর। ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি মোহাম্মদপুরে সাত মসজিদ হাউজিংয়ের ৫ নম্বর রোডের বাসা থেকে হারিয়ে যায় সে।

আসমা ছুটা বুয়ার কাজ করেন। তাঁর স্বামী মোতাহারের কোনো স্থায়ী পেশা নেই। এখন তিনি বাবুর্চির কাজ করেন। এর আগে চালক হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেছিলেন। আসমা জানান, ঘটনার দিন সকাল ১০টার সময় বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ঝুমুরের হাতে ১০ টাকা দিয়ে বলেন কিছু কিনে খেতে। দোতলা বাড়ির গেটের সামনে বসে খেলছিল সে। বেলা তিনটার দিকে বাড়ি ফিরে দেখেন ঝুমুর বাসায় নেই। এরপর চারপাশে খোঁজ শুরু হয়। এলাকায় মাইকিং করা হয়। কিন্তু ঝুমুর নেই যে নেই-ই। তিন বছরেও খুঁজে পাওয়া গেল না তাকে।

আসমা বলেন, বাড়ির আশপাশে থাকা কয়েকজনের কাছ থেকে শুনেছেন, ঝুমুর খেলার সময় ওখানে হাতি নিয়ে আসে এক লোক। হাতি দিয়ে আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে টাকা তোলা হচ্ছিল। সমবয়সী এক ছেলের ডাকে ঝুমুর খেলা ছেড়ে হাতি দেখতে চলে যায়।

দুই মাস আগে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তিনি জানতে পারেন, বাবা-মার সন্ধান চেয়ে ফেসবুকে ঝুমুরের ছবি পোস্ট করা হয়েছে। কিন্তু ওই পোস্ট থেকে মেয়ে কোথায় আছে সে সন্ধান পাননি। পরে অপর একজনের মাধ্যমে ফেসবুকে জান্নাতি নামে হারিয়ে যাওয়া এক মেয়ের ছবি পোস্ট করা হয়েছে বলে জানতে পারেন। জান্নাতির ছবির সঙ্গে তাঁর মেয়ে ঝুমুরের চেহারার অনেক মিল। ফেসবুকের পোস্ট ধরে ছোটমণি নিবাসে জান্নাতিকে দেখতে যান। কিন্তু তাঁকে জানানো হয়, মেয়েটিকে দত্তক দেওয়া হয়ে গেছে। নরসিংদী থেকে মেয়েটিকে ছোটমণি নিবাসে পাঠানোর কারণে নরসিংদী আদালতের অনুমতি নিয়ে দেখা করতে আসতে হবে। অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য না থাকায় নিয়ম নামের আইনি বেড়াজাল আসমার কাছে পাহাড়সমান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়।