মালিনীছড়ায় 'বাঘের' পায়ের ছাপ

বাঘের গতিবিধি জানতে সিলেট শহরতলির মালিনীছড়া চা-বাগান এলাকায় গতকাল নাইট ভিশন ক্যামেরা স্থাপন করেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।  ছবি: প্রথম আলো
বাঘের গতিবিধি জানতে সিলেট শহরতলির মালিনীছড়া চা-বাগান এলাকায় গতকাল নাইট ভিশন ক্যামেরা স্থাপন করেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা। ছবি: প্রথম আলো

প্রথম দফায় বিচ্ছিন্ন পায়ের ছাপ। তারপর দেখা গেল সারিবদ্ধ কিছু ছাপ। এতে চিন্তার খোরাক জোগায়। সবশেষে ঘাড় মটকানো অবস্থায় পাওয়া গেল একটি গরু। আশপাশে আরও পায়ের ছাপ। তখন সবাই মত দিলেন এটি বাঘের পায়ের চিহ্ন। বন বিভাগের কর্মকর্তারাও আলামত দেখে একমত প্রকাশ করলেন। 

সিলেট শহরতলির মালিনীছড়া চা-বাগানে বাঘের এই আনাগোনার আলামত পাওয়া গেছে। অবস্থান নিশ্চিত হতে বন বিভাগ তাই ‘ক্যামেরা ট্র্যাকিং’ পদ্ধতি শুরু করেছে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে বাঘ বিশেষজ্ঞদের পরিদর্শনের পর চা-বাগানের কাঁঠালবনে লাগানো হয়েছে ‘নাইট ভিশন ইনফারেক্ট ক্যামেরা’। এটি রাতের বেলা বাঘের বিচরণমাত্র স্থিরচিত্র ধারণে সক্ষম।
নগরের উত্তর-পশ্চিমে ১ হাজার ৫০০ একর জায়গাজুড়ে মালিনীছড়া চা-বাগানের অবস্থান। বাগান ছাড়াও আছে রাবার বাগানের ঘন বন। ১৮৫৪ সালে স্থাপিত বাগানটি উপমহাদেশের প্রথম চা-বাগান। সিলেটে বেড়াতে আসা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের এই চা-বাগানের সরু পথে গত ২০ ফেব্রুয়ারি প্রথম বাঘের পায়ের ছাপ দেখা যায়। এরপর আরেক দফা পায়ের ছাপ অনেকটা স্পষ্টভাবে দেখা গেলে বিষয়টি বন বিভাগকে জানানো হয়। গত বুধবার পায়ের ছাপের সঙ্গে গবাদিপশুর ঘাড় মটকানো অবস্থা দেখে চা-শ্রমিকসহ বন বিভাগের কর্মীরা বাঘ বলে নিশ্চিত হন।
গতকাল শুক্রবার দুই দফা বনকর্মীরা চা-বাগান পরিদর্শন করেন। পরে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে বাঘ বিশেষজ্ঞ একটি দল বাগান পরিদর্শন করে। চা-বাগানের কাঁঠালবনকে বাঘের সম্ভাব্য বিচরণস্থল চিহ্নিত করে সন্ধ্যায় দুটি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। ক্যামেরার সামনে শুঁটকিজাতীয় খাবার দিয়ে রাখা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এক সপ্তাহ শুধু সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ক্যামেরা সচল রাখা হবে। সকালবেলা মনিটরিং করা হবে। সহকারী বনসংরক্ষক আবু নাসের মহসিন হোসেন বলেন, উন্নত দেশে এই পদ্ধতিতে বাঘ গণনার কাজ করা হয়। স্থিরচিত্রের মাধ্যমে বাঘ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
পায়ের ছাপ ও গবাদিপশুর ঘাড় মটকানো প্রথম দেখেছিলেন সিলেটের সাইক্লিং কমিউনিটির মডারেটর আরিফ আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘প্রথমে বিচ্ছিন্ন পায়ের ছাপ দেখি। পরে যখন বালুর মধ্যে পরিকল্পিত কিছু ছাপ দেখি, তখন সুন্দরবনে বিচরণ করা বাঘের পায়ের ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি। এতে ধারণা স্পষ্ট হলে বন বিভাগকে জানাই।’
এস এম মুনিরুল ইসলাম সবকিছু দেখে ধারণা করছেন, এটি চিতা বাঘ হবে। কেননা, চা-বাগানে চিতা বাঘের বিচরণের ইতিহাস আছে। ক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ে ধরা পড়লে পরবর্তী কিছু নির্দেশনার মাধ্যমে পুরো চা-বাগান এলাকাকে নজরদারির মধ্যে রেখে বাঘের গতিবিধি শনাক্তে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
ঘাড় মটকানো অবস্থায় পাওয়া গরুটির মালিক চা-শ্রমিক নিদেশ মোদী। তিনি বলেন, এখানে মেছো বাঘের দেখা মিলেছে। কিন্তু কখনো বাঘ বা চিতা বাঘ দেখেননি। তবে তাঁর দাদার মুখে শুনেছেন, এখানে একসময় চিতা বাঘ হানা দিত।
নানা প্রজাতির বাঘ চা-বাগানের ঘন বনে আছে-এমনটি অতীতে শোনা গেলেও তিন দশক ধরে আর শোনা যায়নি বলে বন বিভাগ সূত্র জানায়। ১৯৬০ সালে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা ও মধুপুরে চিতা বাঘের বিচরণ দেখে শিকারও হয়েছিল। ১৯৮৮ ও ৯০ সালে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার সাগরনাল, রত্না এলাকায় কয়েকটি গরুর ঘাড় মটকানো দেখে ধারণা করা হয়েছিল, ওই এলাকার চা-বাগান ও ঘন বনে চিতা বাঘ আছে।
২০০৯ সালে সিলেটের কানাইঘাটের লোভাছড়া চা-বাগান এলাকায় জ্যান্ত ধরা পড়েছিল বিরল প্রজাতির কালো বাঘ। এলাকাবাসী জীবিত বাঘ ধরতে ফাঁদ পেতে কালো বাঘ আটক করে বন বিভাগে দিয়েছিল। বাঘটিকে হত্যা না করে জীবিত ধরতে সক্ষম হওয়ায় তখন ‘বাঘের মায়ায় এককাট্টা’ শিরোনামে প্রথম আলোয় বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল।