সম্পদে ভরা টাঙ্গুয়ার হাওর

সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর।  ছবি: প্রথম আলো
সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। ছবি: প্রথম আলো

ছয় কুড়ি কান্দার নয় কুড়ি বিল। কান্দাভর্তি সারি সারি হিজল, করচ আর নলখাগড়ার বন। হাওরভর্তি মাছ, জলচর পাখি। মাছ, গাছ আর পাখি—এই হলো টাঙ্গুয়ার হাওর। তবে এসব সোনালি অতীতে পরিণত হলেও এখনো দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় এ জলাভূমি।

টাঙ্গুয়ার হাওরের কারণে সুনামগঞ্জকে বলা হয় ‘হাওরকন্যা’। এটি আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত দেশের দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’। প্রথমটি সুন্দরবন। হাওরের সম্পদ রক্ষা ও সংরক্ষণে কাজ করছে প্রশাসন। পাশাপাশি রয়েছে বেসরকারি উদ্যোগও। তবে উদ্যোগে কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি।

সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে তাহিরপুর ও ধরমপাশা উপজেলায় এ হাওরের অবস্থান। ৪টি ইউনিয়নের ১৮টি মৌজাজুড়ে এর আয়তন ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর। হাওরে আগে ১২০ কান্দাবিশিষ্ট (পাড়) ১৮০টি বিল ছিল। এখন ছোট-বড় মিলিয়ে বিল আছে ১০৯টি। প্রধান বিল ৫৪টি। এর ভেতর জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল ও নালা। বর্ষায় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন হাওর যেন রূপ নেয় সমুদ্রে। এ এলাকার ৮৮টি গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ হাওরের ওপর নির্ভরশীল। এর উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড়। এ পাহাড় থেকে ৩৮টি ঝরনা নেমে এসে মিশেছে টাঙ্গুয়ার হাওরে।

 রামসার সাইট ঘোষণা

রামসার কনভেনশন হলো বিশ্বব্যাপী পরিবেশ রক্ষার একটি সম্মিলিত প্রয়াস। ১৯৭১ সালে ইরানের রামসার নগরে প্রথম এ নিয়ে বিশ্বের পরিবেশবাদীদের একটি সম্মেলন হয়। এটিই রামসার কনভেনশন নামে পরিচিত। সেখানে ‘কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ডস’ নামে একটি চুক্তিতে সই করেন অংশগ্রহণকারীরা। পরে ১৫৮টি দেশ এতে স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ সই করে ১৯৯২ সালের ২০ এপ্রিল। ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি টাঙ্গুয়ার হাওরকে রামসার সাইট ঘোষণা করা হয়।

 হাওরের যত সম্পদ

টাঙ্গুয়ার হাওরকে বলা হয় দেশি মাছের আধার। এ হাওর জলজ বন, পরিযায়ী ও দেশি পাখির নিরাপদ আবাসস্থল। প্রতিবছর শীত মৌসুমে দেশি ও পরিযায়ী লাখো পাখি আসে এখানে। এটি দেশি মাছের অন্যতম প্রজননক্ষেত্র। দীর্ঘদিন পানির নিচে টিকে থাকতে পারে, এমন কিছু বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ আছে এখানে। বিলুপ্তপ্রায় হিজল, করচগাছের পাশাপাশি এখানে রয়েছে নলখাগড়া, সিঙরা, চাইল্যা, বইল্যা, বনতুলসী, উকল, গুইজ্জাকাটা, শালুক ও শাপলা।

হাওরে ১৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৪১ প্রজাতির মাছ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি, ২১ প্রজাতির সাপ দেখা যায়। অস্তিত্বের হুমকিতে থাকা ২৬ প্রজাতির বন্য প্রাণীর আবাসভূমি এ হাওর। বর্তমানে এখানে ৫৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। বর্তমানে মাছের মজুত আছে ৬ হাজার ৭০১ মেট্রিক টন।

 হাওরের সম্পদ রক্ষা

১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করে সরকার। এরপরই হাওরে দীর্ঘ ৬০ বছরের ইজারাদারির অবসান হয়। ২০০১ সালের ১২ জানুয়ারি হাওর এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।

২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর জেলা প্রশাসন হাওরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। বর্তমানে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ২৪ জন আনসার এ হাওরের দেখভালের দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি রয়েছে স্থানীয় লোকজনের সমন্বয়ে গঠিত ‘কমিউনিটি গার্ড’।

 হাওর উন্নয়নে প্রকল্প

সরকারি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ২০০৬ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরে সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের কাজ শুরু করে।

আইইউসিএন বলছে, তারা হাওরপাড়ের ৮৮টি গ্রামে সংগঠন তৈরির মাধ্যমে মানুষকে সংগঠিত করেছে। সংগঠন করে তাঁদের চাঁদায় একটি সামাজিক তহবিল গড়ে তোলা হয়েছে। মানুষ সচেতন হচ্ছে। এ তহবিলে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ টাকা আছে।