মায়াবী চিতালশাবক

চিতালশাবক। সম্প্রতি সুন্দরবনের কচিখালীতে।  ছবি: লেখক
চিতালশাবক। সম্প্রতি সুন্দরবনের কচিখালীতে। ছবি: লেখক

গোলবনের সুন্দরী হাঁসের খোঁজে ঢাকা থেকে সুন্দরবনের কচিখালী পৌঁছেছি। ভোরে ছোট্ট লঞ্চ থেকে ডিঙিতে চড়লাম দুটি উদ্দেশ্যে। প্রথমত কচিখালীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালে পাখি-প্রাণীর সন্ধান। দ্বিতীয়ত বাঘের বৈঠকখানাখ্যাত কচিখালীর ঘাসবনে ঘুরে ঘুরে পাখি-প্রাণী দেখা। খালে ঢোকার মুখেই দেখা হয়ে গেল মায়াবী ও শান্ত-সৌম্য হরিণশাবকের সঙ্গে। খুবই মায়াবী চেহারা। তার মধ্যে কোনো চাঞ্চল্য দেখলাম না। ওর টানা টানা চোখ ও গেরুয়া রঙের দেহে সাদা সাদা ফোঁটা বেশ লাগছিল। আমাদের ডিঙি যখন ওর প্রায় কাছাকাছি চলে এল, তখনো সে ঠায় দাঁড়িয়ে। আমরা কিছুটা আশ্চর্য হলাম। তবে খুশি হলাম ওকে কাছ থেকে দেখতে পেয়ে।

মায়াবী এই শাবক আমাদের প্রিয় প্রাণী চিত্রা হরিণ। চিতাল বা স্বর্ণমৃগ নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম স্পটেড ডিয়ার, অ্যাক্সিস ডিয়ার বা ইন্ডিয়ান স্পটেড ডিয়ার। হরিণের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে চিতালকেই সবচেয়ে সুন্দর বলে গণ্য করা হয়। সার্ভিডাই পরিবারের চিতালের বৈজ্ঞানিক নাম Axis axis

রামায়ণের সীতা একে দেখেই মুগ্ধ হয়ে ধরে আনার জন্য রামকে অনুরোধ করেছিলেন। একসময় এ দেশের ব্যাপক এলাকাজুড়ে, বিশেষ করে বনাঞ্চলে এদের যথেষ্ট সংখ্যায় পাওয়া যেত। বর্তমানে প্রাকৃতিকভাবে সুন্দরবন ছাড়া কোথাও দেখা মেলে না। অবশ্য বন বিভাগ সুন্দরবন থেকে কিছু হরিণ হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে ছেড়েছিল। ওখানে কোনো শিকারি প্রাণী না থাকায় ও খাদ্যের প্রাচুর্য থাকায় ব্যাপক বংশবৃদ্ধি ঘটেছে।

চিতালের দেহের দৈর্ঘ্য গড়ে ১.৫ মিটার ও কাঁধ পর্যন্ত উচ্চতা ০.৬-১.০ মিটার। হরিণের ওজন ৩০-৭৫ কেজি ও হরিণীর ২৫-৪৫ কেজি। দেহের লোম লালচে, তার ওপর সাদা ফোঁটা। গলা ধবধবে সাদা। বুক ও দেহের নিচটা সাদাটে। হাঁটু থেকে পায়ের খুর পর্যন্ত হালকা সাদা বা ধূসর। হরিণের সুন্দর শিং প্রতিবছর ঝরে পড়ে। হরিণীর শিং নেই। নবজাতকের গায়ের রং বাদামি। কয়েক মাস পর্যন্ত গায়ে কোনো ফোঁটা দেখা যায় না, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোঁটা সৃষ্টি হতে থাকে।

চিতাল তৃণভোজী। সাধারণত ঘাস, লতাপাতা, গাছের পাতা ও বাকল খেয়ে জীবণধারণ করে। চরে নতুন জেগে ওঠা ঘাসের মধ্যে দূর্বা, নলখাগড়া, হোগলা, মারিয়া ইত্যাদি বেশি পছন্দ করে। সাধারণত সূর্য ওঠার আগে ও ডোবার পর খাবারের সন্ধানে বের হয়। আর সারাটি দিন জঙ্গলে বিশ্রাম করে।

সচরাচর ১০-১৫টি চিতাল মিলে দলবদ্ধভাবে থাকে। দলে ২-৩টি শক্ত-সমর্থ হরিণ থাকে। প্রজননের আগে হরিণদের শক্তি পরীক্ষা চলে শিংয়ের গুঁতাগুঁতির মাধ্যমে। দলের সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও দীপ্তমান হরিণের হাতেই থাকে কর্তৃত্ব। দলের সব হরিণীর ওপর থাকে তার একচ্ছত্র আধিপত্য। যেহেতু সারা বছরই দলে থাকে, তাই এদের মধ্যে মিলন (ম্যাটিং) বেশি হয় ও সারা বছরই বাচ্চা জন্মায়। তবে মে-আগস্টেই বেশির ভাগ প্রজনন ঘটে। সাত-আট মাস গর্ভধারণের পর একটি বাচ্চার জন্ম দেয়। সাধারণত বর্ষার আগে আগে যখন ঘাস ও লতাপাতায় বন ছেয়ে যায়, তখন বেশির ভাগ হরিণীর বাচ্চা হয়। আয়ুষ্কাল ৯-১৩ বছর।