সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার কোটার হিসাব অত্যন্ত জটিল

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। প্রথম আলো ফাইল ছবি
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। প্রথম আলো ফাইল ছবি
>

• আগে অগ্রাধিকার কোটার ২১ শতাংশ পদ শূন্য থাকত
• ৩৫তম বিসিএস থেকে কোটার শূন্য পদ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হচ্ছে 
• বাকি সব সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার কোটার সমস্যা রয়ে গেছে 
• ১১ এপ্রিল সংসদে প্রধানমন্ত্রী কোটাব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দেন 
• প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় নতুন কর্মসূচি দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা


সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার কোটার হিসাব অত্যন্ত জটিল। ফলে প্রার্থী নির্বাচন ও পদ বণ্টনে সমস্যা হয়। সরকারি কর্ম কমিশনও (পিএসসি) এ জটিলতা স্বীকার করে কোটাব্যবস্থা সহজ করার পরামর্শ দিয়ে আসছে।

আগে এই অগ্রাধিকার কোটার ২১ শতাংশ পদ শূন্য থাকত। পিএসসি দাবি করছে, ২০১৪ সালে আহ্বান করা ৩৫তম বিসিএস থেকে মুক্তিযোদ্ধা, নারী, নৃগোষ্ঠী ও জেলা কোটার শূন্য পদগুলো মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হচ্ছে। কিন্তু মেধাতালিকা থেকে কোন কোটায় কতজন চাকরি পাচ্ছেন, তা প্রকাশ করছে না প্রতিষ্ঠানটি। ফলে এ নিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে অস্বচ্ছতা রয়ে যায়। এখন ৩৮তম বিসিএস চলছে।

এদিকে কোটা সংস্কার করে ১০ শতাংশ করার দাবিতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে আন্দোলনে নামে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। ফেসবুক ইভেন্টের মাধ্যমে একত্র হয়ে এই আন্দোলন শুরু হয় এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম দফায় ৭ মের মধ্যে কোটা সংস্কারের সিদ্ধান্ত জানাবে বলে আন্দোলন স্থগিত রাখার আহ্বান জানায় সরকার। কিন্তু আন্দোলনকারীদের একটি অংশ আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দিলেও আরেকটি অংশ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। পরে ১১ এপ্রিল সংসদে প্রধানমন্ত্রী কোটাব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দেন। এক মাস হতে চললেও এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় নতুন কর্মসূচি দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।

পিএসসির বাইরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকসহ অন্যান্য সরকারি চাকরিতে কোটার পদ শূন্য থাকার হার গড়ে ২৫ শতাংশ। কোটায় যোগ্য লোক পাওয়া না গেলে সেখানে পদগুলো বছরের পর বছর শূন্যই থেকে যাচ্ছে।

প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় (মুক্তিযোদ্ধা, নারী, নৃগোষ্ঠী ও জেলা কোটা) নিয়োগের বিধান আছে। বাকি ৪৫ শতাংশ নিয়োগের বিধান মেধার ভিত্তিতে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে পোষ্য, আনসার-ভিডিপিসহ আরও কিছু কোটা রয়েছে।

পিএসসির সাবেক একজন চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, অনেকে ঠিকমতো জানেই না কীভাবে কোটার ব্যবহার হয়। জেলা কোটা উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে ৫৫ শতাংশ কোটাকে প্রথমে জেলার জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাগ করা হয়। জেলায় না মিললে বিভাগ ধরে ভাগ করা হয়। এটা এতটাই জটিল যে এ নিয়ে কারসাজিরও সুযোগ থাকে।

পিএসসির সূত্রমতে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৫৫ শতাংশ কোটাকে জেলা কোটায় ভাগ করার জটিল বিষয়টি বাদ দিয়ে কোটার মেধাতালিকা থেকে বণ্টনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীও ইতিবাচক ছিলেন। কিন্তু মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রস্তাব ওঠার পর কয়েকজন মন্ত্রীর বিরোধিতায় তা আর বাস্তবায়িত হয়নি।

পিএসসির সাবেক এক চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমান ব্যবস্থায় এক কোটার ওপর আরেক কোটা প্রভাব ফেলে। ২০০৮ সালে পিএসসির উদ্যোগে করা এক গবেষণার সূত্র ধরে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি চাকরিতে বর্তমানে ২৫৮ ধরনের (একটি ঐচ্ছিক) কোটা আছে। তাঁর মতে, পাঁচ বছর পরপর কোটা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা উচিত ছিল।

একাধিক বার্ষিক প্রতিবেদনে পিএসসিও বলেছে, বর্তমান কোটাসংক্রান্ত নীতিমালার প্রয়োগ অত্যন্ত জটিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন শতভাগ নিখুঁতভাবে করা কখনো কখনো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারা কোটা পদ্ধতি সহজ করা অপরিহার্য বলে মত দেয়।

পিএসসির এক হিসাবে দেখা যায়, ২০০৮ সালের ২৮ তম বিসিএস থেকে ২০১৩ সালের ৩৪ তম বিসিএস পর্যন্ত ৭টি পরীক্ষায় ৫ হাজার ৬০৯টি পদ খালি ছিল। চাকরিযোগ্য পদের হিসাবে এই সংখ্যা প্রায় ২১ শতাংশ। অর্থাৎ কোটায় পর্যাপ্ত যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় প্রায় ২১ শতাংশ পদ শূন্য থাকত।

পিএসসির বাইরে অন্য চাকরিতে কোটা: অগ্রণী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পদে নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়েছে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি। এতে ২৬২টি পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা, কিন্তু ৬৪টি পদ শূন্য থেকে গেছে। ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যসচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন খান প্রথম আলোকে জানান, কোটায় কাঙ্ক্ষিত প্রার্থী না পাওয়ায় ওই পদগুলো সংরক্ষিত রাখতে হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে হাউস বিল্ডিং ফিন্যান্স করপোরেশনে দুটি নিয়োগে মোট ২০টি এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে ১০টি পদ শূন্য রাখতে হয়েছে। মোট পদের হিসাবে খালি থাকার হার গড়ে ২৫ শতাংশ।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকের পদ তৃতীয় শ্রেণির এবং প্রধান শিক্ষকের পদ দ্বিতীয় শ্রেণির। বর্তমানে ৬৫ হাজার ৩২৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন সাড়ে তিন লাখ। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা ২০১৩ অনুযায়ী সরাসরি নিয়োগযোগ্য পদগুলোর ৬০ শতাংশ নারী প্রার্থীদের দিয়ে, ২০ শতাংশ পোষ্য প্রার্থীদের দিয়ে এবং ২০ শতাংশ পুরুষ প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক একজন মহাপরিচালক এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব প্রথম আলোকে বলেন, উল্লেখিত কোটার মধ্যে আবার ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ প্রচলিত অন্যান্য অগ্রাধিকার কোটা আছে। অর্থাৎ ১০০ জনকে চাকরি দিলে সেখানে ৬০ জন নারী নিতেই হবে। কিন্তু এই ৬০ জন নির্বাচনে বিদ্যমান অগ্রাধিকার কোটাগুলো বিবেচনা করা হয়। একইভাবে ২০ শতাংশ পুরুষ কোটার ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার কোটা বিবেচনা করা হয়।

তবে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলার মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত ৬ মার্চ সরকারি সব চাকরিতে অগ্রাধিকার কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেগুলো মেধাতালিকা থেকে পূরণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এক মাস পর ৫ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এর একটি ব্যাখ্যা দেয়। তাতে প্রথমে এক কোটার শূন্য পদ আরেক কোটা থেকে পূরণের কথা বলা হয়। তাতেও যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে তবেই মেধাতালিকা থেকে পূরণের কথা বলা হয়। এই পদক্ষেপে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ক্ষোভ বেড়ে যায়। তাঁরা কোটা সংস্কার ও মেধাতালিকা থেকে নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যান। ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ২১ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাদের আগের প্রজ্ঞাপনটিই গেজেট আকারে প্রকাশ করে। গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আবারও কোটা বাতিলের পক্ষে তাঁর অবস্থান তুলে ধরেন।

কোটার শুরু: ১৯৭২ সালে নির্বাহী আদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ২০ শতাংশ পদ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হতো। বাকি ৮০ শতাংশ পদে কোটায় নিয়োগ হতো। ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে বাড়ানো হয়। ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করা হয়। বাকি ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ হয়। এই অগ্রাধিকার কোটার মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা (পরে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, এখন নাতি-নাতনি) কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা এবং ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা। সর্বশেষ ২০১২ সালে বিদ্যমান অগ্রাধিকার কোটায় কাঙ্ক্ষিত যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেই কোটা থেকে ১ শতাংশ পদ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণের নিয়ম চালু হয়। বাছাই, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্য থেকেই কোটায় নিয়োগ হয়।

প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আশির দশকের পর থেকে কোটার বিপুল পদ শূন্য থাকা শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ হলেও ১৯৮২ সালে এই কোটার ২৩ শতাংশই শূন্য ছিল। পরের বছর ১৯৮৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পান মাত্র ৩ শতাংশ, ১৯৮৪ সালে ৮ শতাংশ, ১৯৮৫ সালে ৫ শতাংশ চাকরি পান। ১৯৮৯-৯০ সালে এই কোটায় চাকরি পাওয়ার হার ১ শতাংশে নেমে এসেছিল।

১৯৯৭ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া না গেলে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এই কোটায় চাকরি দেওয়া হবে। এরপরও দেখা যায়, কোটার পদ শূন্য থাকে। ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনটি বিসিএসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা কোটার পদ বেশি শূন্য থাকে। ১৯৯৯ সালে অনুষ্ঠিত ২১ তম বিসিএসে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, ২২ তম বিসিএসে ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২৫ তম বিসিএসে ৬ দশমিক ১ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার পদ শূন্য ছিল।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত কোটায়ও কাঙ্ক্ষিত যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছিল না। ২১ তম বিসিএসে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটার ৪ দশমিক ৫ শতাংশই শূন্য ছিল। ২৫ তম বিসিএসে এই কোটার পদ শূন্য ছিল ৪ শতাংশ।

তবে পিএসসির দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, শুধু কোটার কারণেই যে পদ শূন্য থাকে, তা নয়, অনেক সময় কারিগরি ও বিশেষায়িত পদ যোগ্য প্রার্থীর অভাবে শূন্য থেকে যায়।

পিএসসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক বছরে বিভিন্ন ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পদে অগ্রাধিকার কোটায় যোগ্য প্রার্থীর অভাবে কোটার পদ শূন্য থাকলে সেগুলো মেধাতালিকা থেকে পূরণের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। ফলে ৩৫ তম বিসিএসে ৬৭ শতাংশ ও ৩৬ তম বিসিএসে ৭০ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রার্থীকে মেধাতালিকা থেকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এখন নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার যে নীতি করে দেবে, তা-ই বাস্তবায়ন করা হবে।

আরও পড়ুন:

আগামীকাল পড়ুন:
বারবার সংস্কারের সুপারিশ গুরুত্ব না দেওয়ায় জটিলতা