ইলিশের পদ্মায় বালুর রাজত্ব

চর পড়ে পদ্মা ভরাট হয়ে গেছে। পদ্মা প্রবাহিত হচ্ছে এক কিনার দিয়ে। সম্প্রতি কুষ্টিয়া জেলার সুলতানপুর এলাকায়।  ছবি: তৌহিদী হাসান
চর পড়ে পদ্মা ভরাট হয়ে গেছে। পদ্মা প্রবাহিত হচ্ছে এক কিনার দিয়ে। সম্প্রতি কুষ্টিয়া জেলার সুলতানপুর এলাকায়। ছবি: তৌহিদী হাসান

‘গতিশীল জলতলে পদ্মার মাটির বুক কেহ কোনো দিন দেখে নাই, চিরকাল গোপন হইয়া আছে।’ এই চিত্তাকর্ষক বর্ণনা পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পদ্মার বুক এখন দেখা যায়। সেখানে পানির চেয়ে বালুর বাহুল্য বেশি। পানির প্রবাহের চেয়ে বালুর স্থবিরতা মনকে বিষণ্ন করে।

এই বিষণ্নতা, এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে পাঁচ দিনের পদ্মা ভ্রমণের পর। ১৯ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভারত সীমান্ত থেকে পদ্মা নদীর পরিস্থিতি দেখার শুরু। রাজশাহী, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ হয়ে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মার শরীর বেয়ে আসতে আসতে ২৩ এপ্রিল পার। সংক্ষেপে বললে, ভারত সীমান্ত থেকে গোয়ালন্দে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগ পর্যন্ত পদ্মা হয়ে পড়েছে দীনহীন। ইলিশের জন্য বিখ্যাত পদ্মা এখানে বালু আর চরের রাজত্বে কোণঠাসা। তবে আরিচা থেকে চাঁদপুরে মেঘনায় মিলিত হওয়া পর্যন্ত পদ্মা এখনো বিপুলা।

এপ্রিলের মাঝামাঝি কুষ্টিয়ার পাকশীতে হার্ডিঞ্জ সেতুর তিন কিলোমিটার উজানে স্থানীয়রা পদ্মার বুকে আধা কিলোমিটার বাঁশের সাঁকো তৈরি করেছিল। তার ওপর দিয়ে পদ্মার পশ্চিম তীরের কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার গোলাপনগর ইউনিয়ন ও পূর্ব তীরের ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের মানুষ যাতায়াতও করেছিল সপ্তাহখানেক। জলজীবীদে
র আপত্তিতে পরে অবশ্য সে সাঁকো সরিয়ে নেওয়া হয়। মানুষ পদ্মার ওপর বাঁশের সেতু তৈরি করতে সাহস দেখিয়েছে। কারণ সেখানে দুই তীরে চর জেগে নদীর প্রশস্ততা কমে গেছে, ক্ষীণ হয়েছে স্রোত। শিলাইদহের মাঝি মো. আবদুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মায় নৌকা বাইতে এখন আর বুক কাঁপে না।’ পদ্মা এখন যেন বালুর মোকাম। আর তার দখল কেবল প্রভাবশালীদের হাতে। বালুতে কাবু হওয়ায় কেউ কেউ পদ্মার বুক দখলেরও দুঃসাহস দেখাচ্ছে।

গঙ্গা-পদ্মা নদী প্রণালি

ইন্টারনেটে গুগল সার্চ ইঞ্জিনে খুঁজলে দেখা যায়, প্রবহমান নীল স্রোতোধারার গঙ্গা ফারাক্কা ব্যারাজে পৌঁছে পদ্মা হয়ে গিয়েছে। ফারাক্কা থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে গঙ্গা নদী পদ্মা নাম নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা দিয়ে। এরপর রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী হয়ে পৌঁছায় গোয়ালন্দ-দৌলতদিয়া-আরিচা পর্যন্ত। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে ফারাক্কার পর থেকে দৌলতদিয়া পর্যন্ত পদ্মা ১৮৫ কিলোমিটার। দৌলতদিয়া থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মার দৈর্ঘ্য ৯৫ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে ২৮০ কিলোমিটার।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের দলিল বলছে, ৭০-৮০ বছর আগে আরিচার কাছে পদ্মা ১৫ কিলোমিটার প্রশস্ত ছিল। এখন ৫ কিলোমিটারেরও কম। দৌলতদিয়ায় পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয় যমুনা। নদী বিজ্ঞানীরা যমুনাকে বলেন ব্রহ্মপুত্র। তাঁদের কাছে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলত নাম পদ্মা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সম্প্রতি ২৪টি নদীর ওপর গবেষণা করেছে। তাতে গঙ্গা ও পদ্মাকে পৃথক নদী হিসেবে দেখা হয়েছে। পদ্মা নদীর গবেষণায় বলা হয়েছে, আরিচা থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মার বর্তমান প্রবাহের বয়স ২০০ বছরের কাছাকাছি। তুলনায় নদীটি নবীন।

 দীর্ঘ যাত্রাপথে পদ্মা নদী ১০টি বড় বাঁক নিয়েছে। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মার ভাঙা-গড়া মূলত এই বাঁকগুলোতে। একটি বাঁকে ভাঙন শুরু হলে তা চলতে থাকে ৫ থেকে ২০ বছর।

পাঁচ দিনের পদ্মাযাত্রা শুরু হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে তারাপুর টুটাপাড়া গ্রামে কার্তিক প্রামাণিকের বাড়ি। বিরানভূমিতে শত শত গাছ লাগিয়ে দেশব্যাপী খ্যাতিমান কার্তিক প্রামাণিক। বয়স আশি বছর ছুঁই ছুঁই। বৃক্ষপ্রেমিক বললেন, ‘আমার এই বাগানের নিচে ছিল পদ্মা। এখন দুই মাইল দূরে সরে গেছে।’

আমবাগানের ভেতর দিয়ে কিছু পথ হাঁটার পর সামনে পড়ে পদ্মা নদী। নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে কার্তিক প্রামাণিক আঙুল উঁচিয়ে বলেন, ওপারে পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার আওরঙ্গবাদ। সেখান থেকে ১৪-১৫ কিলোমিটার উত্তরে ফারাক্কা ব্যারাজ। ওই ব্যারাজে বাধাগ্রস্ত পদ্মার প্রাকৃতিক প্রবাহ। ফলে নদীতে একের পর এক জাগছে চর, জাগবে আরও।

একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা পাওয়া গেল। ওই নৌকায় শিবগঞ্জের পাকা ইউনিয়নের একটি চরের ছোট দশ রশিয়া বাজারে পৌঁছা। আসাদুল হোসেনের দোকানে কথা বলার সময় ভিড় জমে গেল। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানালেন, চরটি জেগেছে ৩০-৩৫ বছর আগে। বসতি শুরু হয়েছে ১০-১২ বছর। প্রায় ছয় হাজার মানুষের বাস। নদী থেকে প্রায় ২০ ফুট উঁচু চরটি ভাঙতে শুরু করেছে। মানুষজন অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চিত, কয়েক বছরে এই চর পদ্মায় বিলীন হয়ে যাবে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) বলছে, পদ্মা নদীতে ভাঙন যেমন বেশি, চর জেগে ওঠার প্রবণতাও বেশি। তবে ভাঙনে জমি বিলীন হওয়ার পরিমাণই বেশি। ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যকার উপগ্রহের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এই সময়ে নবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজবাড়ী জেলায় ২৮ হাজার ৩৯০ হেক্টর জমি পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়েছে। আর জেগে উঠেছে ২৫ হাজার ৬৮০ হেক্টর চর। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, পদ্মার ডান তীরে ভাঙন বেশি।

তবে রাজশাহী শহর থেকে ১০-১৫ কিলোমিটার দূরের পদ্মার চর খিদিরপুরের বয়স অনেক বেশি। শহরের জাহাজঘাট থেকে ২০ এপ্রিল সকাল ১০টায় ইঞ্জিনচালিত চৌকায় চড়ে এই চরে পৌঁছাতে ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগল। এ চরটিও ভাঙতে শুরু করেছে দুই-তিন বছর ধরে। চরবাসী রাজশাহী শহরে আশ্রয় নিয়েছেন, অথবা দেশের অন্য কোথাও চলে গেছেন।

নৌকা যায় পরের চরে।নাম ‘দশ নম্বর চর’। সেখানকার দোকানমালিক শুকুর আলী বলেন, ‘যত নষ্টের গোড়া ওই ফারাক্কা বাঁধ।’ তাঁর ক্ষোভ, ভারত পানি আসতে দিচ্ছে না বলে পদ্মায় এত বালি আর এত ভাঙন।

নদীভাঙনের কারণে চর খানপুর, চর খিদিরপুর, দশ নম্বর চরের মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন রাজশাহী শহরে। শহরের মিজানের মোড়ে বসলে তাঁদের কথা শোনা যায়। কারও হয়তো ৬০ একর জমি ছিল, এখন তিনি ছোট মুদি দোকানি। দিনমজুর খাটাতেন যিনি, তিনি নিজেই দিনমজুর।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ফারাক্কায় পানি প্রত্যাহারের কারণে পানি কমে পদ্মার গতিপথে পরিবর্তন আসে। অপ্রত্যাশিত ভাঙন শুরু হয়। পদ্মার ভাঙন থেকে রাজশাহী শহর রক্ষা করতে আশির দশকে ‘টি-বাঁধ’ দিয়েছিল সরকার। এই বাঁধে শহর রক্ষা পাচ্ছে ঠিকই, তবে স্রোত ভাঙছে খানপুর বা খিদিরপুরের মতো বসতি।

ভারত সীমান্তে পদ্মার এই ভাঙনে চর খিদিরপুরে প্রথম আলোর একটি স্কুলও নদীতে হারিয়ে গেছে। নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘ভাঙতে ভাঙতে গঙ্গা (পদ্মা) যদি ভারতের ভেতরে ঢুকে যায়, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’

পদ্মার মাঝিরা বলেন, পানি নেই বলে নৌকা চলে না। জেলেরা বলেন, পানি নেই, তাই মাছ নেই। আর বাস্তবতা বলে, পদ্মায় পানি নেই বলে, পাগলা নদী মরেছে, মহানন্দা শুকিয়েছে, মাথাভাঙ্গা মৃতপ্রায়। আরও বহু নদ-নদী, খাল-বিলের একই অবস্থা। এসব জলাধারের আশপাশে বাস করা মানুষের কষ্ট বেড়েছে। তাদের কথাবার্তায় ন্যায্য-অন্যায্যভাবে উঠে আসে প্রতিবেশী ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ।

এই ক্ষোভ শুধু পদ্মার দুই পাড়েই জমে থাকেনি। পদ্মার মতো ক্ষীণ ধারায় হলেও তা ছড়িয়েছে সারা বাংলাদেশে। স্থান করে নিয়েছে দেশের রাজনীতিতে, প্রভাব ফেলে জাতীয় নির্বাচনে। বাংলাদেশ-ভারত পররাষ্ট্রনীতিতেও বড় জায়গা করে নিয়েছে পানি।

হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে গঙ্গার উৎপত্তি। হিন্দুদের কাছে গঙ্গা পবিত্র জলধারা; ‘মা গঙ্গা’। বহু সভ্যতা, নগর-বন্দর জন্ম দিয়েছে এই গঙ্গা। নদী বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাসবিদদের মতে, কালের বিবর্তনে গঙ্গার প্রধান ধারাটি প্রবাহিত হয়েছিল বাংলাদেশে। পূর্বমুখী এই নদী ভারতের একাধিক রাজ্য অতিক্রম করার পর ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাজমহল পাহাড়ের গা ঘেঁষে পশ্চিম বাংলায় প্রবেশ করে। এরপর মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে ঢোকার আগে ফারাক্কা গ্রামে ১৯৭১ সালে ব্যারাজ তৈরির কাজ শেষ করে ভারত। ১৯৭৪ সাল থেকে তারা নদী থেকে পানি প্রত্যাহার শুরু করে। পানি নিয়ে যায় হুগলি নদীর নাব্যতা বাড়াতে, লবণাক্ততা কমাতে এবং তাদের কলকাতা বন্দর বাঁচাতে।

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী পানির একটি ভাগ পায় বাংলাদেশ। ফারাক্কায় পানি কম থাকলে বাংলাদেশও কম পায়। বর্ষায় পানির কোনো অভাব নেই, ভারতও ফারাক্কা ব্যারাজের সব দরজা খুলে দেয় তখন।

বাংলাদেশের চারজন প্রতিনিধি ফারাক্কা ব্যারাজে নিয়োজিত। যেটুকু পানি দেওয়ার কথা ভারত তা দিচ্ছে কি না, তা দেখাই তাঁদের দায়িত্ব। দৈনিক কত ঘনমিটার পানি দেওয়ার কথা, বাস্তবে কত ঘনমিটার পানি বাংলাদেশ পায়, সেই হিসাব জেলে-মাঝিরা জানেন না। কিন্তু তাঁদের ধারণা, বাংলাদেশ ঠিকমতো পানি পাচ্ছে না।

যৌথ নদী কমিশন বলছে, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে শুষ্ক মৌসুমে (১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে) বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী পানি পেয়েছে।

২১ এপ্রিল পরের দিন সকালে আবার যাত্রা শুরু হয় হার্ডিঞ্জ সেতু থেকে। নৌকায় উঠে মনে হলো নদীতে অনেক পানি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে, গত বছর ২২ এপ্রিল হার্ডিঞ্জ সেতুর কাছে পদ্মার গভীরতা ছিল ৫ দশমিক ১২ মিটার। এ বছর একই তারিখে গভীরতা ছিল ৪ দশমিক ৫১ মিটার। গত বছরের চেয়ে এখানে পানি কমেছে ৬১ সেন্টিমিটার।

 ভাটিতে কিছু দূর যাওয়ার পর বাম তীরে বিরাট চর চোখে পড়ে। মাঝি বললেন, বছর দুয়েক হলো চর জাগতে শুরু হয়েছে। শিলাইদহ ইউনিয়নের সুলতানপুর এসে দেখা যায়, নদী একেবারে সরু হয়ে গেছে। বিস্তীর্ণ বালুর চর আর সুলতানপুরের মধ্যে পদ্মা ৫০০ মিটারের মতো প্রশস্ত। যাঁরা পদ্মার আসল রূপ দেখেননি, তাঁরা হিসাব কষে বলবেন, আরে বাস্‌, আধা কিলোমিটার চওড়া। কিন্তু আগে এটা ছিল কয়েক কিলোমিটার।

সুলতানপুর রক্ষার কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এখানে ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ী ও পার্শ্ববর্তী এলাকা সংরক্ষণের লক্ষ্যে পদ্মা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

হার্ডিঞ্জ সেতুর নিচ থেকে নেওয়া নৌকার মাঝি আর দক্ষিণে যেতে রাজি হলেন না। নামিয়ে দিলেন শিলাইদহে। তাঁর ভয় যতটা না কালবৈশাখীর, তার চেয়ে বেশি ডাকাতের। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সহায়তায় একটি বড় নৌকা পাওয়া গেল বটে, তবে মাঝিরা বললেন, রাত ১২টার আগে গোয়ালন্দে পৌঁছানো সম্ভব হবে না।

শিলাইদহ ডানে রেখে নৌকা চলে গোয়ালন্দের দিকে। কিছু পথ যেতেই চোখে পড়ে নদী খননের দৃশ্য। অনেকগুলো খননযন্ত্রের মধ্যে মাত্র একটিকে সক্রিয় দেখা গেল। পানি যাওয়ার জন্য বড় নালা তৈরি করছে যন্ত্রগুলো, আর বালি রাখছে নদীর মধ্যে জেগে ওঠা চরে।

মাঝির সহকারী মোকাদ্দের শেখ বললেন, নদী খননে কোনো লাভ হয় না। বর্ষা শুরু হলে বালুতে আবার নদী ভরে যাবে। কত বালুর পেছনে কত টাকা যাচ্ছে, তার হিসাব শুধু ওপরওয়ালাই জানেন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির হিসাবে দেখা যায়, পদ্মা নদীতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এখন পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। অধিকাংশ প্রকল্প নদীর প্রবাহ ও তীর রক্ষার। অর্থ পাওয়া সাপেক্ষে এ ধরনের আরও ছয়টি প্রকল্প ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হবে। পদ্মার ওপর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় মাওয়া এলাকায় ‘পদ্মা সেতু প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে।

২৮০ কিলোমিটার পদ্মার ২০০ কিলোমিটারই বিপণনযোগ্য বালু তোলার উপযোগী। শিলাইদহের মাঝি মো. আবদুল কাদের বলেছিলেন, ভারত পানি দিচ্ছে কম, বালু দিচ্ছে বেশি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারাও বলছেন, বালু ব্যবস্থাপনাই এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।

পদ্মার বালু প্রাকৃতিক। আসে ভারত থেকে। বছরে কত লাখ ঘনমিটার বালু আসছে, তারও হিসাব আছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের খাতায়।

বালু ব্যবসা চলছে পদ্মাজুড়ে। বালুমহাল পদ্মার দুই পাড়ে। বালুমহাল দখল নিয়ে মারামারি-খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাগজপত্রে দেখা যায়, বালু সবচেয়ে বেশি জমছে পদ্মার পশ্চিম পাড়ে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর তালবাড়িয়া এলাকায়। তালবাড়িয়াতে পদ্মা থেকে জন্ম নিয়েছে গড়াই নদ। খুলনা-যশোর তথা সুন্দরবন এলাকার স্বাদু পানির প্রধান উৎস ছিল এই গড়াই। পরিবেশবিদেরা দীর্ঘকাল ধরে অভিযোগ করে আসছেন, স্বাদু পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে। গড়াই দিয়ে স্বাদু পানি আসে না। পদ্মায় পর্যাপ্ত পানি না থাকায় গড়াইয়ে স্রোত থাকে না।

প্রায় এক দশক ধরে গড়াই খনন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। খনন করে, আবার ভরে যায়। বছরের পর বছর এ রকমই চলছে। বারবার গড়াই খনন প্রকল্পের আয়ু বাড়ছে, সঙ্গে বরাদ্দও।

কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ২১টি বালুমহাল আছে। এর মধ্যে ১৬টি গড়াইয়ের তীরে, বাকি ৫টি পদ্মার পাড়ে। বালুমহালগুলো স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বালু তুলছে শত শত ট্রাক। সেই বালু নিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালীরা। সরকার পয়সা পাচ্ছে না।

গোয়ালন্দ থেকে ২২ এপ্রিল সকাল ১০টায় যাত্রা শুরু হয়। সঙ্গে দৌলতদিয়া বাজার মৎস্য আড়ত সমিতির সভাপতি মো. মোহন মণ্ডল। গন্তব্য মাওয়া। মোহন মণ্ডলের বয়স ৬৫ বছর। ছোটবেলায় নিজে নদীতে মাছ ধরেছেন। মাঝি দুজন তাঁর চেনা। নৌকা প্রথম যায় পদ্মা ও যমুনার মিলনস্থলে। জায়গাটি অনুমান করে নিতে হয়, সরকারি কোনো চিহ্ন সেখানে নেই। দুটি স্রোত বেশ আলাদা। যমুনার পানি পানি ঘোলা। পদ্মার পানি তুলনায় স্বচ্ছ। এরপর নৌকা চলে মাওয়ার দিকে।

জেলেদের মাছ ধারা দেখতে দেখতে নৌকা পৌঁছায় মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের বকচর গ্রামে। এখানে পদ্মা অনেকটা ‘কূল নাই, কিনারা নাই’ অবস্থায়। বকচর গ্রামের মুন্নাফ বিশ্বাসের দোকানটি পদ্মার পাড়ে। দোকানের সামনে দাঁড়ালে পদ্মার অন্য পাড় দেখা যায় বটে, কিন্তু কিছুই স্পষ্ট নয়। মুন্নাফ উত্তরের চরটি দেখিয়ে বলেন, বছর দুই হয়েছে চরটি জেগেছে। চরের কারণে স্রোত গ্রামের দিকে আসছে। গ্রাম ভাঙতে শুরু করেছে। অন্যদিকে বালু ব্যবসায়ীরা গ্রামের সামনে থেকে বালু তুলে ঝুঁকিতে ফেলছে গ্রামটাকে।

আকাশে মেঘ দেখে মাঝি আর রাজি হলেন না মাওয়া যেতে। ২৩ এপ্রিল ভোরে সদরঘাট থেকে লঞ্চে চাঁদপুর যাত্রা। চাঁদপুরে গিয়ে হারুন মাঝির নৌকায় আবার পদ্মায় নেমে পড়া। হাতের ডানে ছোট একটি ভূখণ্ড পড়ে। এটি রাজরাজেশ্বরপুর। পদ্মা ও মেঘনা একে ভেঙে চলেছে নিয়ত। হারুন মাঝি জানালেন, চাঁদপুর শহরকে ভাঙছে পদ্মা ও মেঘনার স্রোত। এখান থেকেই পদ্মা-মেঘনার মিলিত স্রোত মেঘনা নাম নিয়ে আরও দক্ষিণে গেছে, শেষে সাগরে মিশেছে।

২৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মার পাড়ে পাড়ে ইলিশকে ছাপিয়ে আলোচনায় এসেছে পদ্মার বালু আর ভাঙন। দুই পাড়ের মানুষেরা যা জানালেন তার সারমর্ম—পদ্মায় বালু ব্যবসায়ী ছাড়া এখন আর কারও ভবিষ্যৎ নেই। চর আর বালুর দৌরাত্ম্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আরিচা অংশে ভবিষ্যতে পদ্মায় পানি আরও কমবে বলে তাদের আশঙ্কা।

একসময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, রাজবাড়ীর পাংশায় গঙ্গা ব্যারাজ তৈরি হবে। পানি ধরে রেখে সারা বছর ব্যবহার করা হবে। তাতে পানীয় জলের সংকট দূর হবে, কৃষির উন্নতি হবে, জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে। প্রকল্প দলিলও তৈরি হয়েছিল। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্প দলিলে ত্রুটির কথা বলেছিলেন। ব্যারাজ এখন আর আলোচনায় নেই।

তবে এই ব্যারাজের চিন্তা মাথায় নিয়েই বাংলাদেশকে এগোতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, ‘যশোর-খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদী বাঁচাতে পদ্মায় পানির উচ্চতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। এ জন্যই ব্যারাজ দরকার।’ এই ব্যারাজ বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী ব্যারাজ হওয়াই ভালো বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ নদীরই দান। এতে গঙ্গা-পদ্মার অবদান এককভাবে অনেক বেশি। কয়েকটি খননযন্ত্র ও পদ্মা সেতুর কাজ ছাড়া পদ্মা নদীতে সরকারের উপস্থিতি চোখে পড়ে না। বাস্তবে এই নদী নিয়ে সরকারের সামগ্রিকভাবে কোনো পরিকল্পনা নেই। অন্যদিকে ভারত সরকার সে দেশে ‘জাতীয় নদী সংযোগ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন শুরু করেছে। বাংলাদেশ সরকার অভিন্ন নদীর প্রবাহ ব্যাহত করার বিষয়ে ভারতের কাছে উদ্বেগ জানিয়েছে। কারণ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ভারতের ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পদ্মার পানি আরও কমবে, শুকাবে বাংলাদেশ।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন, কুষ্টিয়া প্রতিনিধি তৌহিদি হাসান, গোয়ালন্দ প্রতিনিধি এম আর এইচ রায়হান ও চাঁদপুর প্রতিনিধি আলম পলাশ।)