পাহাড় কেটে রাস্তা বানাচ্ছে সিডিএ

  • কাটা হয়েছে ১০টি পাহাড়
  • আয়তনের হিসাবে ২৩ দশমিক
  • ৬ একর
  • এখনো মেলেনি
  • পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি

যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে চট্টগ্রামে অন্তত ১০টি পাহাড় কেটে ফেলেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে প্রায় ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য প্রায় দুই বছর ধরে পাহাড় কাটছে সরকারি দপ্তরটি। সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট থেকে নগরের শেরশাহ বাংলাবাজার পর্যন্ত এই পাহাড় কাটা চলছে।

পাহাড় কাটার দায়ে পরিবেশ অধিদপ্তর নামমাত্র ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। এরপরও পাহাড় কাটা থেমে নেই। কেটে ফেলা পাহাড়গুলোর উচ্চতা ২৫ থেকে ১৫০ ফুট পর্যন্ত। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের হিসাবে ইতিমধ্যে ২০ দশমিক ৬ একর পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া নগরের অংশে প্রায় তিন একর পাহাড় কাটা হয়েছে।
নগরের শেরশাহ বাংলাবাজার থেকে এশিয়ান উইমেন ইউনিভার্সিটির পাশ দিয়ে নির্মাণাধীন সংযোগ সড়কটি ফৌজদারহাট বাইপাস এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে মিশবে। সংক্ষেপে এটি লুপ সড়ক নামে পরিচিত। এর প্রস্থ হবে ১২০ ফুট। দৈর্ঘ্য প্রায় ৬ (৫.৯৬০) কিলোমিটার। স্পেকট্রা ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পাল বলেন, উন্নয়নকে বাদ দেওয়া যাবে না। তবে পরিবেশের দিকটিও দেখতে হবে। এভাবে নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণে দিন দিন পাহাড়শূন্য হয়ে পড়ছে চট্টগ্রাম। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। তবে এত বড় বড় পাহাড় কেটে যে সড়কটি করা হচ্ছে, সে সড়কটিই তো পাহাড়ধসে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ পাহাড়গুলো কাটা হয়েছে খাড়াভাবে।
প্রকল্পটির জন্য ২০১৬ সালের ১ আগস্ট সিডিএ পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করে। কিন্তু ছাড়পত্র পাওয়ার আগেই তারা প্রকল্পটির কাজ শুরু করে দেয়। সিডিএর আবেদনটি পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে ঢাকায় মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো হয়। মহাপরিচালকের দপ্তর থেকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কতটা পাহাড় কাটা হতে পারে, তা জানতে চেয়ে চট্টগ্রাম কার্যালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। পরে চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে পাহাড় কাটার সম্ভাব্য হিসাব দিয়ে ঢাকায় মহাপরিচালকের দপ্তরে প্রতিবেদন পাঠানো হয়।
তবে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, সিডিএর প্রকল্পটি এখনো পরিবেশগত ছাড়পত্র পায়নি।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মো. মকবুল হোসেন বলেন, সিডিএ পাহাড় কাটছে এটা সত্য। সড়ক নির্মাণের জন্য এই পাহাড় কাটা চলছে। তারা পরিবেশগত ছাড়পত্র এখনো পায়নি। তবে সেটা শিগগিরই পেয়ে যাবে। ঢাকায় আন্তমন্ত্রণালয়ে যোগাযোগের মাধ্যমে ছাড়পত্র দেওয়া হবে।
সরেজমিন চিত্র
গতকাল সোমবার সরেজমিনে দেখা গেছে, ফৌজদারহাট বাইপাস এলাকা হয়ে প্রকল্পটির শুরু। ওই অংশে ঢুকতেই দেখা যায় একের পর এক পাহাড় কেটে মাঝখান দিয়ে বিশাল সড়ক তৈরির কাজ চলছে। পাহাড় কাটা হয়েছে একেবারে খাড়াভাবে। কাটা পাহাড়ের পাশে বড় বড় বৈদ্যুতিক খুঁটি বসানো হচ্ছে। কয়েকটি স্থানে পাহাড়ি ছড়ার পানি যাওয়ার জন্য কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। যত দূর যাওয়া যায়, সেখানে পাহাড় কাটার চিহ্ন দেখা যায়। রয়েছে খননযন্ত্রও।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. এরশাদ বলেন, বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান পাহাড় কাটলে এতক্ষণে লঙ্কাকাণ্ড হয়ে যেত। সিডিএ কাটছে বলে কিছু বলছে না কেউ। তবে যেভাবে পাহাড় কেটে সড়ক করা হয়েছে, তাতে পাহাড়ধস হবে নিশ্চিত।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মো. মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম যদি সরকারি প্রতিষ্ঠান এভাবে পাহাড় কাটে, তাহলে বেসরকারিরা উৎসাহিত হবে।’
২০ একর পাহাড় সাবাড়
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে গত ১ জানুয়ারি সিডিএকে নোটিশ দেওয়া হয়। ওই নোটিশে বলা হয়, জঙ্গল সলিমপুর মৌজার বিএস ৩৫৭, ৩৫৮ ও ৩৫৯ দাগের প্রায় ২০ দশমিক ৬ একর পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। এভাবে পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এলাকাটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রায় ১০টি পাহাড় ইতিমধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে। এক-একটি পাহাড় ২৫ ফুট থেকে দেড় শ ফুট উচ্চতার।
নামমাত্র জরিমানা
লুপ সড়কের প্রায় দুই কিলোমিটার পড়েছে চট্টগ্রাম নগরের শেরশাহ ও বাংলাবাজার এলাকায়। উত্তর পাহাড়তলী মৌজার প্রায় বিএস দাগ ৩০১, ২০০ ও ১৯৮ দাগের প্রায় দুই একর পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। এই অংশটি তদারক করে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগর অঞ্চল। গত বছরের ৫ নভেম্বর মহানগর অঞ্চল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রা ইন্টারন্যাশনালকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে।
তবে এই জরিমানা একেবারে নামমাত্র বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের অফিস আদেশে বলা হয়, এক একর পর্যন্ত পাহাড় কাটার ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুট ৫০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। এক একরের বেশি পাহাড় কাটা হলে প্রতি বর্গফুট এক হাজার টাকা থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার বিধান রয়েছে।
এ বিষয়ে অধিদপ্তরের মহানগরের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক বলেন, পাহাড় কাটার অনুমতি না নিয়ে তারা পাহাড় কাটছিল। তাই তাদের জরিমানা করা হয়। এরপর পাহাড় কাটার অনুমতির জন্য মন্ত্রণালয়ে দরখাস্ত করেছিল।
জানতে চাইলে সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক রাজীব দাশ বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে ইতিমধ্যে পাহাড় কাটার অনুমতি সই হয়ে গেছে। হয়তো এখনো তা পরিবেশ অধিদপ্তরে এসে পৌঁছায়নি।
১৯৯৫ সালের চট্টগ্রাম নগর মহাপরিকল্পনায় এই সংযোগ সড়কটির উল্লেখ রয়েছে। এই সড়ক বাস্তবায়িত হলে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও উত্তর চট্টগ্রামের যানবাহনগুলো শহরের বাইরে দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে উঠতে পারবে।