বন্যার পানি কমলেও দুর্ভোগ আছেই

বন্যায় ভাসছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। পানিবন্দী অবস্থায় বিশাল জনগোষ্ঠী। গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বাসিন্দারা। ডুবে যাওয়া ঘর থেকে হালের গরু নিয়ে অন্যত্র যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। গতকাল মাদারীপুরের শিবচরে।  ছবি: সাজিদ হোসেন
বন্যায় ভাসছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। পানিবন্দী অবস্থায় বিশাল জনগোষ্ঠী। গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বাসিন্দারা। ডুবে যাওয়া ঘর থেকে হালের গরু নিয়ে অন্যত্র যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। গতকাল মাদারীপুরের শিবচরে। ছবি: সাজিদ হোসেন

নদ–নদীর পানি কমতে শুরু করায় দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু দুর্ভোগ কমেনি বানভাসি মানুষের। এদিকে বেশির ভাগ জেলায় পরিস্থিতির উন্নতি হলেও মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও নওগাঁয় পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রথম আলোনিজস্ব প্রতিবেদকপ্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:

নীলফামারীতে বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। গতকাল সোমবার লালমনিরহাটের দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গত শনিবার সেখানে পানি ছিল বিপৎসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপরে। পরদিন তা ২৮ সেন্টিমিটার নিচে নামে।

ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি কমতে শুরু করায় কুড়িগ্রামে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। নদ-নদীর তীরবর্তী চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়ি থেকে পানি নামতে শুরু করলেও দুর্ভোগ কমেনি বন্যাদুর্গতদের। করোনা ও বন্যা পরিস্থিতিতে হাতে কাজ না থাকায় বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় লোকজন। গবাদিপশুর খাদ্য নিয়েও সংকটে পড়েছেন বানভাসি মানুষেরা।

চিলমারী ও নুনখাওয়া পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কমেছে তিস্তা, দুধকুমারসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানিও।

সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের প্রথম আলো চরের বাসিন্দা আমির হামজা বলেন, ‘খায়া না খায়া আছি হামরা, খুব কষ্ট।’।

রংপুরে ১০ দিন আগে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে গঙ্গাচড়া উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চল পানিতে নিমজ্জিত হয়। গত তিন দিন থেকে সেই পানি নেমে গেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, গত তিন দিনের ব্যবধানে তিস্তা নদীর পানি অনেক কমেছে।

গাইবান্ধায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। প্রতিদিন বন্যার পানি নামছে। তবে গতকালও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ও ঘাঘট নদের পানি বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে গোবিন্দগঞ্জে করতোয়ার পানি বাড়তে শুরু করেছে। এদিকে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, পশুখাদ্য, জ্বালানিসংকট দেখা দিয়েছে। বন্যায় কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষেরা খাদ্যসংকটে ভুগছেন।

লাগাতার ভারি বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে নওগাঁয় আত্রাই ও ছোট যমুনার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে মান্দা উপজেলায় তিনটি গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আত্রাই নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে মান্দা উপজেলায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত ২০টি স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে।

আত্রাই নদের শাখানদী ফকিরনী ও শিব নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাঁধের ভাঙন দিয়ে পানি প্রবেশ করে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এদিকে ছোট যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নওগাঁ শহর রক্ষা বাঁধের বাইরে পানি বের করে দেওয়ার নালা দিয়ে নদীর পানি শহরে ঢুকতে শুরু করেছে।

গতকাল বেলা দুইটা পর্যন্ত মান্দা উপজেলার জোতবাজার পয়েন্টে আত্রাই নদের পানি বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একই সময়ে নওগাঁ লিটন ব্রিজ পয়েন্টে ছোট যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

পাউবোর নওগাঁর নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টা পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।

বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল সকাল ছয়টা পর্যন্ত যমুনার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে ১৬ দশমিক ৯১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। যমুনায় পানি কিছুটা কমলেও কমেনি দুর্গত এলাকায় বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ। বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেওয়া বানভাসি ১৮ হাজার ৮৭২ পরিবারের দিন কাটছে চরম দুর্ভোগে।

জামালপুরে বন্যার পানি কমছে। বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেওয়া মানুষ ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। তবে দুর্গত এলাকায় খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। পাউবো সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ২৮ সেন্টিমিটার পানি কমে বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জামালপুর শহর রক্ষা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্ধশত পরিবার। গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, বাঁধের ওপর সারিবদ্ধ ছোট ছোট ছাপরা ঘর। সেখানে আশ্রয় নেওয়া সবার বাড়ি নাওভাঙা চরে। বাঁধের দক্ষিণ পাশেই নাওভাঙা চর। বাঁধের ওপর দাঁড়ালেই জলমগ্ন গ্রামটি দেখা যায়। এই গ্রামের প্রায় সবাই খেটে খাওয়া মানুষ। তাঁদের এখন তিন বেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। অনেকের মাথার ওপর আছে ঋণের সাপ্তাহিক কিস্তির চাপ। খেয়ে না খেয়ে বাঁধের ওপর দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা।

>নদ–নদীর পানি কমছে। কাজ না থাকায় বিপাকে পড়েছেন বানভাসি মানুষ।

টাঙ্গাইলে নদ–নদীর পানি কমতে শুরু করায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে যমুনা ধলেশ্বরী ও ঝিনাইয়ের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পানি কমতে শুরু করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৯ সেন্টিমিটার পানি কমে গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পাউবোর ফরিদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ জানান, পদ্মা নদীতে পানি কমতে থাকায় ফরিদপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

মাদারীপুরের শিবচরের বন্দরখোলা, মাতবরেরচর, চরজানাজাত ও কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নসহ নয়টি ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়ছে চরাঞ্চলের প্রায় ২ হাজার ৪০০ পরিবার।

গতকাল পদ্মা নদীর পানি শরীয়তপুরের নড়িয়ার সুরেশ্বর পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পানি বেড়ে নদীর তীরের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পাউবো সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহ ধরে পদ্মার পানি বাড়ছে। গত রোববার রাতে বিপৎসীমা অতিক্রম করে।

সুনামগঞ্জের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। জেলার নদী ও হাওরে পানি কমছে। পানি নামছে বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট থেকে। জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ৩২ হাজার ৪২টি পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সিলেটে গতকাল বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। সিলেটের প্রধান নদী সুরমা, কুশিয়ারা, লোভা, সারীসহ সব নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি কিছুটা কমে এখন বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাউবোর সিরাজগঞ্জের উপসহকারী প্রকৌশলী রনজিত কুমার জানান, সিরাজগঞ্জে যমুনা হার্ডপয়েন্টে গতকাল বিকেলে যমুনার পানি রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৩৩ মিটার। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পানি আরও কমতে পারে বলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানা গেছে। এখানে বিপৎসীমা ১৩ দশমিক ৩৫ মিটার।