বিজ্ঞান গবেষণায় এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা

শত বছরের পুরোনো নারীশাসিত এক রাজ্য। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী বিজ্ঞানীরা প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এক দল ইচ্ছেমতো বৃষ্টি ঝরায়, অন্য দলটি সৌরশক্তি জমিয়ে রেখে আলো জ্বালায়। এমন রাজ্যের অস্তিত্ব হয়তো বাস্তবে ছিল না। ছিল বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘সুলতানার স্বপ্নে’। সেই স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে চলেছে দেশ।
খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, সংক্রামক ব্যাধি নিরাময়ে, খাদ্য সংরক্ষণে, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যাচর্চায় এগিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের নারীরা। গবেষণার অপ্রতুল সুযোগ, সম্পদের সীমাবদ্ধতা, সামাজিক বাধা ঠেলে নারীরা কাজ করছেন। কেউ কেউ পেয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
সত্তরের দশকের শেষ ভাগে ইডেন মহিলা কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মালিকা আল রাজির হাত ধরে জনা দশেক বিজ্ঞানীকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ উইমেন সায়েন্টিস্টস অ্যাসোসিয়েশন। এই সংস্থার বর্তমান প্রেসিডেন্ট শাহিদা রফিক বলেন, এখন সংগঠনের সদস্যসংখ্যা এক হাজারের বেশি।
বাংলাদেশের শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর কমপক্ষে ১০টিতে নারী বিজ্ঞান গবেষকের শতকরা হার ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের উচ্চপর্যায়ের গবেষণায় যুক্ত আছেন নারীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন মো. আফতাব আলী শেখ বলেছেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে এখন নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীর সংখ্যা সমান।
আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ফিজিকসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে পদার্থবিদ্যায় মোট শিক্ষার্থীর ১০ শতাংশ ছিলেন নারী, ২০১০ সালে তা দাঁড়ায় ৩০ শতাংশ।
এ বিষয়ে এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ১৯৬৩ সালে তিনি যখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন, তখন কোনো নারী শিক্ষার্থী ছিলেন না। আর এখন দেশে প্রকৌশল শিক্ষায় নারীর উপস্থিতি ৩০ শতাংশের মতো, যা উত্তর আমেরিকার চেয়েও বেশি। তিনি মনে করেন, সংখ্যাটা আরও বাড়ত, যদি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নারীর আবাসন-সংকট না থাকত।
কোথায় কতজন নারী বিজ্ঞান গবেষণায়: বাংলাদেশ ন্যাশনাল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল ডকুমেন্টেশন সেন্টারের (ব্যান্সডক) ওয়েবসাইটে দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং তাতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত গবেষকদের তালিকা রয়েছে। এই তালিকা থেকে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) ২৬৮, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (সায়েন্স ল্যাবরেটরি) ১০২, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে ৭২, বাংলাদেশ লাইভ স্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ২৬, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ব্রি) ১৯, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে ১৩০, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজিতে (এনআইবি) ৭, রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) ৬, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে ২৪, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে ২৬ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচারে (বিনা) ১২ জন গবেষণায় নিযুক্ত আছেন।
সফল যাঁরা: ব্রির উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তমাল লতা আদিত্য। তাঁর হাত ধরে বাংলাদেশের কৃষকেরা পেয়েছেন ১০টি জাতের ধান। এর মধ্যে আছে ব্রি-৫৮, বাংলামতি, সরু বালাম, ব্রি-৭০। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এমন কিছু করতে চেয়েছি, যা আমাকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। দিনাজপুর থেকে নালিতাবাড়ী, যেখানে আমার ধান বোনা হয়েছে, সেখানে ছুটে গেছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের কাজে যুক্ত ছিলেন। একই বিভাগের অধ্যাপক জেবা ইসলাম সেরাজের নেতৃত্বে সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে লবণসহিষ্ণু ধান। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী রহিমা খাতুনের নেতৃত্বে আবিষ্কৃত হয়েছে দেশি পাট-৭, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচারের (বিনা) বিজ্ঞানী শামসাদ বেগম আবিষ্কার করেছেন গ্রীষ্মকালীন টমেটো।
আইসিডিডিআরবির ফেরদৌসী কাদরির সংক্রামক ব্যাধির গবেষণাকাজকে সম্মান জানিয়েছে দ্য ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স। ওই প্রতিষ্ঠানের রুবানা রকিব ফুসফুসবহির্ভূত যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের কৌশল আবিষ্কার করে সারা বিশ্বে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। আইসিডিডিআরবির আয়েশা মোল্লাকে বাংলাদেশ উইমেন সায়েন্টিস্টস অ্যাসোসিয়েশন সেরা বিজ্ঞানীর পুরস্কার দিয়েছে চালের গুঁড়া দিয়ে মারাত্মক ডায়রিয়ায় কার্যকর স্যালাইন আবিষ্কারের জন্য।
১৯৭৫ সালে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে পিএইচডির কাজ শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শাহিদা রফিক। ডায়মন্ড রিসার্চ ল্যাবে তাঁদের আবিষ্কার এখনো কাজে লাগাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশ উইমেন সায়েন্টিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাজিরা বেগম বিসিএসআইআরের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তিনি তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ফরমালিনের বিকল্প আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন। আমেরিকান জার্নাল অব ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে এ নিয়ে দুটি প্রতিবেদন বেরিয়েছে। এ রকম অনেক ক্ষেত্রেই যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন এবং রাখছেন এ দেশের কৃতী নারীরা।