দেশনায়ক ও দ্বীপ-২

নেলসন ম্যান্ডেলা। ছবি: রয়টার্স
নেলসন ম্যান্ডেলা। ছবি: রয়টার্স
>দীর্ঘ কারাবাসের দিনগুলোয় মানসিকভাবে শক্ত থাকতে ম্যান্ডেলা আশ্রয় নিলেন শেক্‌সপিয়ারের নাটকে, নাদিন গর্ডিমারের উপন্যাসে। পাশাপাশি কারারক্ষীদের চোখ এড়িয়ে শুরু হলো তাঁর আত্মজীবনী লেখা। ইতিহাস বলে, রোবেন আইল্যান্ডের দীর্ঘ কারাবাস যেমন তাঁর জীবন থেকে বহু বসন্ত কেড়ে নিয়েছিল, তেমনি তাঁর অমরত্বের সোপানের অন্যতম মূল কারিগরও সে। জন্মশতবর্ষের আলোকে সেই দ্বীপের সঙ্গে ম্যান্ডেলার সম্পর্ককেই ফিরে দেখা। আজ দ্বিতীয় পর্ব। আজ দ্বিতীয় পর্ব -

‘সত্যি বলতে কি, কারান্তরালে থাকার সময় মাদিবার ক্ষমতা বাড়তে থাকে আর যারা তাঁকে অন্তরীণ করে রেখেছিল, তাদের ক্ষমতাই কমতে থাকে। কারণ, তিনি জানতেন, সত্যের পথে অবিচল থাকলে, বিশাল বাধার সামনে অবিচল থাকলে জয় হবেই। হয়তো সেটা আগামীকাল হবে না, হয়তো সেটা আগামী সপ্তাহে হবে না, হয়তো সেটা জীবদ্দশায় হবে না। সাময়িকভাবে ঘটনার অন্য রকম মোড়ও নিতে পারে। কিন্তু এক সময়ে শুভশক্তির জয় হবেই।’

—২০১৮ সালের ১৭ জুলাই জোহানেসবার্গে নেলসন ম্যান্ডেলার স্মারক বক্তৃতায় বারাক ওবামা

জুলিয়াস সিজার থেকে রোজমেরি বার্জার: কারান্তরালের প্রেরণা
কারাগারের সেই অন্ধকার দিনগুলোয় পড়া এবং লেখা ছিল ম্যান্ডেলার সর্বক্ষণের সঙ্গী। সেলেরই বিছানার পাশের টেবিলে ছিল খান কয়েক বই। বাইরের বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে তাই কখনো শেক্‌সপিয়ার, কখনো দক্ষিণ আফ্রিকার নোবেলজয়ী লেখিকা নাদিন গর্ডিমারের লেখায় ছুটে গিয়েছেন।

শেক্‌সপিয়ার গভীরভাবে ম্যান্ডেলার মনে দাগ কেটেছিল। ষোড়শ শতাব্দীর এই ইংরেজ কবির লেখা থেকে লড়াইয়ের রসদ খুঁজেছেন মাদিবা। কোনো রকম রাজনৈতিক কাগজ বই পড়তে দিতে জেলের কর্তাদের বড় আপত্তি। তাই অনেক ভেবে এক উপায় বের করা হলো। শেক্‌সপিয়ার রচনাবলির সামনের মলাটে রাম-সীতা, পেছনের মলাটে বিষ্ণু-লক্ষ্মী, মাঝে বংশীবাদনরত কৃষ্ণ। সনি ভেঙ্কটরত্নম নামের এক রাজনৈতিক বন্দী এই বুদ্ধি করে বইটা ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮—এই তিন বছরে ম্যান্ডেলাসহ ৩৩ জন বন্দীর সেলে পৌঁছে দিলেন।

বন্দীদের সবারই পড়ার পছন্দের তালিকায় চলে এল শেক্‌সপিয়ার।

অনেকেই আবার পড়েই ক্ষান্ত হলেন না, পছন্দের লাইনগুলো দাগ দিয়ে সইও করলেন। ম্যান্ডেলাও পড়ে ফেললেন শেক্‌সপিয়ার। পরবর্তী জীবনে অনেক জায়গাতেই শেক্‌সপিয়ারকে তিনি উল্লেখও করেছেন। এখানে ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকের একটা সংলাপে মাদিবা দাগ দিলেন, যেখানে সিজার বলছেন, ‘ভীরুরা মৃত্যুর আগে বহুবার মরে। সাহসীরা একবারই মৃত্যুবরণ করে।’ আদতে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সিজার যে কথাগুলো তাঁর স্ত্রী কলপুর্নিয়াকে বলে সাহস জোগাচ্ছেন, সেটা যে ম্যান্ডেলার মনের কথা হয়ে উঠবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী! কঠিন পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ কবি নাট্যকারের লেখাকেই তাই আঁকড়ে ধরলেন মাদিবা।

শেক্‌সপিয়ার রচনাবলির এই বইয়ের নামই হয়ে গেল রোবেন আইল্যান্ডের বাইবেল। এই বই পড়ে দাগ দিয়েছিলেন যেসব বন্দী, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বহু পরে নাটক লিখে ফেললেন ম্যাথিউ হান। হানের মনে হয়েছিল, সিজারের উদ্ধৃতিতে দাগ দিয়ে ম্যান্ডেলা কারাগারের বাইরে তাঁর অনুগামীদের সংকল্পে অটল থাকতেও বলেছিলেন। কারণ, তিনি নিশ্চিত জানতেন যে বই সমুদ্র পেরিয়ে কেপটাউন পৌঁছাবেই।

নাদিন গর্ডিনারের ‘বার্জারস ডটার’-ও ম্যান্ডেলাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসে দক্ষিণ আফ্রিকার নোবেলজয়ী লেখিকা সামনে আনেন বর্ণবৈষম্যবাদবিরোধী সংগ্রামে লিপ্ত শ্বেতাঙ্গিনী রোজমেরি বার্জারের কাহিনি, যে তার বাবা লাওনেল বার্জারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে দক্ষিণ আফ্রিকার অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গ প্রশাসনকে উৎখাত করতে চায়। কাহিনির শেষে দেখা যাচ্ছে, শত শত কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনকারীর সঙ্গে রোজমেরিকেও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, বিনা বিচারে দীর্ঘদিন তাঁকে বন্দী করে রাখা হচ্ছে। তবে লেখিকা জানাচ্ছেন, রোবেন আইল্যান্ড থেকে শেষ বন্দী মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রোজমেরির লড়াই চলবে।

আদতে তাঁর সহযোগী ব্রাম ফিসারের চরিত্র রূপায়িত এই রাজনৈতিক উপন্যাস পড়ে গর্ডিমারের প্রশংসা করে ম্যান্ডেলা পরে হেলেন জোসেফকে বলেন, ‘ওনার বলিষ্ঠ, ঋজু বক্তব্য দেশ-কালের গণ্ডি অতিক্রম করে। এই রকম নারী আজকের দিনে অমূল্য।’ লেখিকাকে চিঠিও লেখেন ম্যান্ডেলা। পরে নিউইয়র্কার পত্রিকায় এক প্রবন্ধে গর্ডিমার লেখেন, ‘জানি না কীভাবে এই বই তাঁর রোবেন আইল্যান্ডের সেলে পৌঁছেছিল। তবে তাঁর মতো এত গুরুত্বপূর্ণ পাঠকের কথা তো ভাবাই যায় না।’

দুই নোবেলজয়ীর (শেষ শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ফ্রেডারিখ উইলিয়াম ডি ক্লার্কের সঙ্গে নতুন গণতান্ত্রিক দক্ষিণ আফ্রিকা গড়ার জন্য ম্যান্ডেলাকে ১৯৯৩ সালের শান্তির নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এর আগে ১৯৯০ সালে তাঁকে ভারতরত্ন উপাধিতে সম্মানিত করা হয়।) বন্ধুত্ব আমৃত্যু বজায় ছিল। মুক্ত হওয়ার পরে গর্ডিমারের সঙ্গে দেখাও করেন ম্যান্ডেলা।

কারান্তরালে থাকার সময় যেমন গান্ধীর পাশাপাশি মাও সে তুংয়ের গেরিলা যুদ্ধনীতিও তাঁর চোখ এড়ায়নি, তেমনি রক্ষীদের নজর এড়িয়ে লিখেছেন।

১৯৯৪ সালে প্রকাশিত তাঁর বিশ্বখ্যাত আত্মজীবনী ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’-এর মুখবন্ধে ম্যান্ডেলা লিখছেন, ‘পড়লেই পাঠকেরা বুঝে যাবেন এই বই লেখার পেছনে এক লম্বা ইতিহাস আছে। রোবেন দ্বীপের কারাগারে অন্তরীণ থাকার সময় ১৯৭৪ সালে লুকিয়ে এই বই লেখার শুরু। দুই সহযোগী বন্দী কমরেড ওয়ালটার সিসুলু আর আহমেদ কাতরাদা পদে পদে আমার স্মৃতিকে সাহায্য না করলে এই বই লেখাই হতো না। খসড়া লেখাটা জেলের রক্ষী দেখে ফেলে বাজেয়াপ্ত করল। কিন্তু আমার দুই সহযোগী ম্যাক মহারাজ আর ইস্যু চিবা এর প্রতিলিপিও করে রেখেছিল। সেটাই বাইরে চালান হয়ে গেল। ১৯৯০ সালে জেল থেকে বেরিয়ে আবার লেখা শুরু করলাম।’

সত্যি বলতে কি, এই আত্মজীবনীই ইঙ্গিত করছিল ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার দিকে। ম্যান্ডেলা তাঁর এই আত্মজীবনীর অন্তিম পরিচ্ছেদে লিখছেন, ‘স্বাধীনতার পথে দীর্ঘ পথ হেঁটেছি। চেষ্টা করেছি হোঁচট না খেতে। তবুও মাঝেমধ্যেই দিগ্ভ্রান্ত হয়েছি। বড় পাহাড়ে ওঠার পরে একটা রহস্যভেদ করেছি যে আরও অনেক পাহাড়ে চড়া বাকি। এখন সাময়িক বিশ্রাম নিয়ে দেখছি, চারিদিক কী মনোরম, দেখছি কত সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে এলাম। কিন্তু এই বিশ্রাম সাময়িক। স্বাধীনতা দায়িত্বও নিয়ে আসে। আমার আর থামার সাহস নেই, এখনো যে আমার পথচলা শেষ হয়নি।’ বস্তুত এই কথার শেষ বাক্যে ‘থামার সাহস নেই’ বা Dare not linger-ই তাঁর আত্মজীবনীর পরের পর্বের নাম।

২০১০ সালে মূলত বন্দিদশায় তাঁর চিঠিপত্র, সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘কনভারসেশনস উইথ মাইসেল্ফ’, যার ভূমিকা লেখেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সেই বইয়ের মুখবন্ধে ওবামা লিখছেন, ‘রাজনৈতিক জীবনে আসার দুই দশক বাদে রোবেন আইল্যান্ডে ম্যান্ডেলার সেই সেলে এলাম। এখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিয়ে গেলাম সেই সময়ে, যখন প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলা ছিলেন কয়েদি ৪৬৬/৬৪, সেই সময়ে যখন তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামে সাফল্য আদৌ আসবে কি না, তা অনিশ্চিত। ইতিহাসের মোড় ঘোরানো ম্যান্ডেলাকে কল্পনা করলাম, স্মরণ করলাম দিন বদলানোর পেছনে রয়েছে তাঁর চরম আত্মত্যাগকে।’

আর ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত ম্যান্ডেলার পাঁচ বছরের প্রেসিডেন্ট জমানার চিঠিপত্র আর ডায়েরি নিয়ে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘ডেয়ার নট লিঙ্গার’। যার মুখবন্ধে ম্যান্ডেলার তৃতীয় স্ত্রী গ্রাসা ম্যাশেল লিখলেন, তাঁদের বিয়ের তিন মাসের মধ্যে মাদিবা তাঁর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় ভাগ লিখতে বসলেন। বিশ্বের সামনে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতাসংগ্রামের কথা তুলে ধরতেই তাঁর আত্মজীবনী ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’ লেখা। আর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি কী কী করতে চেয়েছেন, তার কতটুকুইবা করতে পেরেছেন, সদ্য ভূমিষ্ঠ গণতান্ত্রিক সরকারের কর্মসূচিই-বা কী ছিল, কী রকম বাধারও সম্মুখীন হতে হয়েছে, এসবই বিশদে বলতে চাইছিলেন মাদিবা। চার বছর ধরে লেখার কাজ চলল। কখনো ফাউন্টেন পেনে, কখনো-বা বলপেনে। লিখছেন, কাটছেন, ফের লিখছেন। কিন্তু হাজারো কাজের মধ্য থেকে লেখার সময় বের করাই ক্রমশ দুরূহ হয়ে দাঁড়াল। বয়সও তার উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করল। ড্রয়ারবন্দী হয়ে পড়ে রইল খসড়া। অবশেষে দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক মান্ডলা লাঙ্গার উদ্যোগে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে মাদিবার লেখা, নোটস একত্র করে তাঁর ও তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে ঘণ্টার পর কথা বলে ‘ডেয়ার নট লিঙ্গার’ খাড়া করা হলো।

প্রতিবাদের কৌশল
রাজনৈতিক লড়াই ম্যান্ডেলার কাছে ছিল আসলে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। তাই যে কারাগারে তাঁকে অপমানিত হতে হয়েছে, যেখানে দেখেছেন কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীরা ফুলপ্যান্ট পর্যন্ত পায় না, জেলের খাবারও নিকৃষ্ট মানের, সেখানে তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন, দেরিতে হলেও জেল কর্তৃপক্ষ মানতে বাধ্য হয়েছে সেসব দাবি।

কারাগারে রাজনৈতিক বন্দীদের অভাব-অভিযোগ জানাতে ম্যান্ডেলা সব সময়ই এগিয়ে আসতেন। রিচার্ড স্টেনজেলকে মাদিবা জানান, তিনি যে অন্য বন্দীদের মুখপাত্র, এটা মানতে জেল কর্তৃপক্ষ মোটেই রাজি ছিল না। কিন্তু তিনি ছাড়ার পাত্র নন। প্রথমে জেলকে বলতেন, সেখানে কাজ না হলে মন্ত্রকে অভিযোগ করতেন। তাতেও ফল না মিললে চিঠি জেলের বাইরে পাচার করে দিতেন। চারদিকে হুলুস্থুল পড়ে যেত। বার কয়েক এভাবে ধাক্কা খেয়ে জেল কর্তৃপক্ষও আপসে বাধ্য হলো।

রোলিহলাহালা থেকে নেলসন
১০০ বছর আগে ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই বাশি নদীর ধারে থেম্বু উপজাতির গ্রাম এমভেজোতে জন্মগ্রহণ করেন রোলিহলাহালা ম্যান্ডেলা।

বাবা গাদলা হেনরি এমফাকানিসোয়া ছিলেন থেম্বু উপজাতির রাজাদের কার্যত প্রধানমন্ত্রীই শুধু নয়, সময়বিশেষে সিংহাসনে বসানোর ক্ষেত্রেও মুখ্য পরামর্শদাতাও।

সব মিলিয়ে ১৩ জন ভাইবোন। চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। স্কুলের শিক্ষক মিস মিদিনগানে দিলেন নতুন নাম—নেলসন।

নেলসন কেন? ম্যান্ডেলার অনুমান, ব্রিটিশ শিক্ষাদান ব্যবস্থায় থেকে শিক্ষিকা ইংরেজ নৌসেনাপতি হোরেস নেলসনের নামটাই বিশিষ্ট উপজাতি নেতার ছেলেকে দেওয়া উপযুক্ত মনে করলেন।

হলেন আইনজ্ঞ, কিন্তু বর্ণবৈষম্যের প্রাচীর ভাঙাকেই করলেন জীবনের ধ্যানজ্ঞান। আর এই আন্দোলনের সহযোগী ওয়ালটার সিসুলুর বোন ইভলিন মেসকে বিয়ে করলেন ১৯৪৪ সালে। কিন্তু সে বিয়ে টিকল না। ১৯৫৮ সালে গাঁটছড়া বাঁধলেন উইনির সঙ্গে। ২৭ বছর কারান্তরাল থাকার সময় উইনিই তাঁর হয়ে আন্দোলন চালানোয় মুখ্য ভূমিকা নেন। ১৯৯০ সালে মুক্ত হয়ে দলের হাল ধরেন। কলকাতাতেও আসেন। ১৯৯৪ সালে হলেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট। ১৯৯৯ সালে কার্যকাল শেষ হলে অবসর নিলেন। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর ৯৫ বছর বয়সে মাদিবার তিরোধান হয়। তৃতীয় স্ত্রী গ্রাসা ম্যাশেল আর দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার উপস্থিতিতে ছোটবেলার কুনু গ্রামে খোসা উপজাতির নিয়ম মেনে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। যে দিগন্তপ্রসারিত প্রকৃতির মাঝে এক যুগান্তকারী জীবন শুরু হয়েছিল, সেখানেই সে মিলিয়ে গেল। রয়ে গেল তার রেশ।

ম্যান্ডেলাল্যান্ড
কী ছাপ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে গেলেন মাদিবা?

পথচলা যে আদতে নতুনভাবে ফের শুরু হলো, তা ১৯৯৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর বুঝতে পারলেন ম্যান্ডেলা। আর এ ক্ষেত্রে অর্থনীতির হিসাব সরিয়ে তিনি মানবকল্যাণকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। আত্মজীবনীর দ্বিতীয় পর্ব ‘ডেয়ার নট লিঙ্গার’-এ তিনি লিখছেন, ‘আমরা জানতাম, দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতার টানাপোড়েনে দেশের ভাঁড়ারে মাত্র ৫১০ কোটি রান্ড পড়ে আছে। (বিনিময় মূল্যের নিরিখে ১ দক্ষিণ আফ্রিকীয় রান্ড ৬ দশমিক ৩৯ বাংলাদেশি টাকা আর ৫ দশমিক ১৬ ভারতীয় রুপির সমান)। কিন্তু যা হতবাক করেছিল, তা হলো ২৫ হাজার ৪০০ কোটি রান্ডের বিপুল ঋণের বোঝা। ...দেখলাম, রাষ্ট্রসংঘেও ১০ কোটি ডলার চাঁদা বাকি। সদস্যপদ যখন রদ করা হয়েছিল, সেই সময় আগের সরকার বাকি রেখে গিয়েছে। আমাকে রাষ্ট্রসংঘে যেতে হলো। বিল ক্লিনটন (তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট), বরিস ইয়েলেৎসিন (তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট), জ্যাক চিরাক (তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট), জিয়াং জেমিনদের (তৎকালীন চীনা প্রেসিডেন্ট) অনুরোধ করলাম বকেয়া চাঁদা মওকুফ করতে। তাঁরা সেই অনুরোধ রাখলেন। ভাবলাম, এবার ওই ২৫ হাজার ৪০০ কোটি রান্ড ঋণেরও সুরাহা করা যাবে। অর্থমন্ত্রীকে বললাম এই ঋণের বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করতে। তা সেই প্রতিবেদন পড়ে তো আমি হতভম্ব। এই ঋণের ৯০ শতাংশ হলো দেশের খেটে খাওয়া শ্রমিকদের পেনশন ফান্ডের বকেয়া। আগের বর্ণবিদ্বেষী সরকার এঁদের অর্থই আত্মসাৎ করেছিল। আমরা এই ঋণের দায় অস্বীকার করতে পারি না। কারণ, তাতে সরকারের মুখ রক্ষা হয় না। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অস্ত্রভান্ডার, বিদেশি ব্যাংকের থেকেও ধার ছিল।’

বস্তুত, মাদিবার হাত ধরেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রাত্য দক্ষিণ আফ্রিকা ফের জগৎসভায় প্রবেশাধিকার পায়। ম্যান্ডেলার জীবনীকার অ্যান্থনি স্যামসনের মতে, দেশের সঙ্গে এ রকম একাত্ম হতে খুব কম রাষ্ট্রনায়কই পেরেছেন। মাদিবা বলতেন, ‘১৯৯৪ সালের পর থেকে আমি দক্ষিণ আফ্রিকীয় বলাই যথেষ্ট। কৃষ্ণাঙ্গ বা শ্বেতাঙ্গ যে-ই হও না কেন, তোমার জন্য বিশ্বের অবারিত দ্বার।’

স্যামসন এক মজাদার কাহিনিও শুনিয়েছেন। অনেক বিদেশি তো দক্ষিণ আফ্রিকার নাম না শুনলেও ম্যান্ডেলার নাম জানতেন। থাইল্যান্ডে গিয়ে এক দক্ষিণ আফ্রিকীয় ব্যবসায়ীর সেই অভিজ্ঞতাই হলো। দেখলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার নাম না জানলেও ম্যান্ডেলার সুপরিচিত। তাদের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকা হলো ম্যান্ডেলাল্যান্ড।

স্যামসনের মতে, মাদিবার মধ্যে একদিকে যেমন ছিল রাজকীয় আভিজাত্য, তেমনি আম-আদমির সারল্য। একদিকে যেমন তিনি আইজেনহাওয়ার, চার্চিলের মতো যুদ্ধবিজয়ী বীরের মতো সদর্পে বিশ্ব সফর করেছেন, প্রেসিডেন্টের জেট থেকে ভিন দেশে নেমে সেখানকার রাষ্ট্রীয় অভিবাদন নিয়েছেন, তেমনি ভুবন-ভোলানো হাসি হেসে বুঝিয়েছেন, আমি তোমাদেরই লোক। তাই প্রেসিডেন্টের জেটে বসেও নিজের জুতো নিজেই সাফ করেন, মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৯০ সালের অক্টোবরে কলকাতা সফরে এসে ফিরে যাওয়ার সময় বিমানে ওঠার আগে, তাঁর কনভয়ের এসকর্ট কলকাতা পুলিশের সার্জেন্ট গুরুপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেন, ‘দারুণ কাজ করেছ ইয়াং ম্যান। গড ব্লেস ইউ,’ তারপর আলিঙ্গনও করেন। বলাই বাহুল্য, বহু সফররত রাষ্ট্রনেতার কনভয়ের এসকর্ট হওয়া গুরুপ্রসাদের উজ্জ্বল কর্মজীবনের এ এক পরম প্রাপ্তি।

চলতি বছরের ১৭ জুলাই জোহানেসবার্গে ম্যান্ডেলা স্মারক ভাষণে বারাক ওবামা বলেছেন, ‘মাদিবা যেভাবে তাঁর লক্ষ্যে স্থির থেকেছেন, আশা-ভরসা জুগিয়েছেন, সেই উদাহরণ আমাদের অনুসরণ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানবাধিকার রক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন। এই পথ কিন্তু সহজ ছিল না। তাঁকে প্রায় তিন দশক কারান্তরালে কাটাতে হয়েছে, প্রখর রৌদ্রে চুনাপাথর ভাঙতে হয়েছে, থাকতে হয়েছে ছোট্ট একটা সেলে, যেখানে দুজনে পাশাপাশি ভালোভাবে দাঁড়ানো যায় না, বারংবার অন্ধকার কুঠুরিতে তাঁকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।’

তাই ওবামার মতে, এই সংগ্রামের আরও বহু মানুষ শামিল হয়েছিলেন। মাদিবা শুধু নিজে যে এগিয়েছেন তা নয়, বাকিদেরও উদ্বুদ্ধ করেছেন তাঁর সঙ্গে পথ চলতে। এই গণজাগরণের মন্ত্রই মাদিবার কাছ থেকে পাওয়া উত্তরাধিকার।

অমরত্বের আসন পাতল যে ব্রাত্য দ্বীপ
আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত শোনালেও রোবেন আইল্যান্ডের মায়ায় জড়িয়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তাই কি ১৯৮২ সালের মার্চ মসে তাঁকে যখন হঠাৎ দ্বীপান্তর বাস ঘুচিয়ে মূল ভূখণ্ডের পোলসমুর কারাগারে পাঠানো হলো, তখন তাঁর গত ১৮ বছরের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে যেতে মন কেমন করেছিল? তাই কি আত্মজীবনীতে তিনি লিখলেন, ‘লোকে কত কিছুতেই তো অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। রোবেন আইল্যান্ডের সঙ্গে আমারও তা-ই হয়েছিল। জায়গাটা বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল।’

জীবনের ১৮টা তরতাজা বসন্ত আধো অন্ধকার সেলে কাটানোর পরে কী করে একজন এই কথা বলতে পারেন? তাহলে কি তিনি অনুভব করেছিলেন, কারাগারের নির্জনতা পুরোনো ম্যান্ডেলাকে ভেঙেচুরে এক নতুন মাদিবাকে জন্ম দিয়েছিল?

মানসিকভাবে নিজেকে সুস্থিত রাখার জন্য সেলে একাকী চিন্তামগ্ন হয়েছেন। পরে বলেছেন, ২৭ বছরের কারাজীবন তাঁকে বদলে দিয়েছে। তিনি ভিন্ন মানুষ হয়ে কারাগার থেকে বেরিয়েছেন। বহু পরে সেই বন্দিজীবনের সেলে বসে বলেছেন, ‘এই যে একা থাকা, এই যে একা বসে ভাবতে পারা, এটা দারুণ সুযোগ করে দেয় নিজেদের ব্যবহার, চিন্তাভাবনা সঠিক করার।’

সেই নাড়ির টানেই হয়তো বারবার ছুটে গিয়েছেন রোবেন আইল্যান্ডে, নিয়ে গিয়েছেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও তাঁর স্ত্রী হিলারিকেও।

স্যামসনকে মাদিবা একবার বলেছিলেন, ‘যদি জেলে না যেতাম, তাহলে অনেক কিছু শেখা বাকি থাকত।’

শতবর্ষের আলোকে তাই মনে হয়, রোবেন আইল্যান্ড দ্বীপ হয়েও বিচ্ছিন্ন নয়, ম্যান্ডেলার জীবনের সঙ্গেই জড়িয়ে সে। মাদিবার জীবনের বহু রঙিন বসন্ত হয়তো তার ছোট্ট সেল কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু বিশ্ব ইতিহাসে তাঁর অমরত্বের আসন পাততেও তাঁর ভূমিকা ফেলনা নয়।