প্রত্যাশিত ফলই এল অনাস্থা ভোটে

পার্লামেন্টে বক্তব্য দেওয়ার পর হুট করেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আলিঙ্গন করেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। ছবি: সংগৃহীত
পার্লামেন্টে বক্তব্য দেওয়ার পর হুট করেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আলিঙ্গন করেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। ছবি: সংগৃহীত

প্রত্যাশামতোই বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব পরাজিত হলো। অনাস্থার পক্ষে মাত্র ১২৬ ভোট পড়ে। বিপক্ষে অর্থাৎ মোদি সরকারে পক্ষে পড়ে ৩২৫ ভোট। ভোটের আগে শুক্রবার দিনভর লোকসভায় এই প্রস্তাব নিয়ে চর্চা পরিণত হলো আগামী বছরের সাধারণ নির্বাচনের প্রচারের মহড়া।

সেই মহড়ায় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী যেমন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তুমুল সমালোচনার পর তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেন, মোদি তেমন রাহুলের ওই আচরণ নিয়ে কটাক্ষ করে বলেন, ক্ষমতায় আসতে এত তাড়া কিসের? জবাবি ভাষণে মোদি স্পষ্ট বুঝিয়ে দেন, আগামী পাঁচ বছর তিনিই ক্ষমতায় থাকবেন। কংগ্রেসের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রার্থনা করি, যাতে আপনাদের শক্তি বাড়ে। ২০২৪ সালে ফের অনাস্থা আনতে পারেন।’

মোদি বলেন, ‘গণতন্ত্রে মানুষই বিচার করে। এটা কংগ্রেসের ফ্লোর টেস্ট নয়। অন্যরা তাদের সঙ্গে আছে কি না, এই অনাস্থা প্রস্তাব ছিল তা দেখার জবরদস্তি পরীক্ষা। মোদিকে সরাতে যাদেরও মুখ দেখাদেখিও বন্ধ তারা চেষ্টা করছে। আমরা ক্ষমতায় আছি সংখ্যা ও দেশের মানুষের রায় আছে বলে।’

বিরোধীরা দিনভর যে যে বিষয়ে সরকারের স্পষ্ট অভিমত জানতে চেয়েছিল, জবাবি ভাষণে মোদি সেগুলো সযত্নে এড়িয়ে সরকারের ‘সাফল্যের’ খতিয়ান তুলে ধরার পাশাপাশি কংগ্রেসের ‘অপদার্থতার’ ফিরিস্তি দিয়ে যান। ১৮ হাজার গ্রামে বিজলি, গরিবদের জন্য ৩৬ কোটি জনধন খাতায় ৮০ হাজার কোটি টাকা জমা, ৮ কোটি শৌচালয়, উজ্জ্বলা যোজনায় ৪ কোটি পরিবারে গ্যাস চুলা, আয়ুষ্মান যোজনা এবং ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা শুনিয়ে বলেন, আর্থিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভারত এখন বিশ্বের ষষ্ঠ। ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হতে যাচ্ছে দেশ।

কিন্তু কালোটাকা দেশে এনে প্রতি মানুষের ব্যাংক খাতায় ১৫ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, ডোকলামে ভারতের পিছিয়ে এসে চীনের আধিপত্য স্থাপন, রাফায়েল যুদ্ধ বিমান কিনতে কেন তিন গুণ বেশি টাকার চুক্তি, কেন জাতিগত বিভাজন বেড়ে সহিংসতা মাত্রাছাড়া হয়ে যাচ্ছে, নোট বাতিল ও জিএসটির বিরূপ প্রভাব বা পেট্রল-ডিজেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে সমালোচনার স্পষ্ট কোনো উত্তর মোদি দেননি। বস্তুত, চার বছরে এই প্রথম নরেন্দ্র মোদিকে লিখিত ভাষণ পাঠ করতে দেখা গেল। সেই ভাষণের আগাগোড়া ছিল সরকারি ‘সাফল্যের’ সাতকাহন এবং কংগ্রেসের পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির নিন্দা।

শুক্রবার সকালে প্রস্তাব উত্থাপনের শুরুতেই ওডিশার বিজু জনতা দল (বিজেডি) সভাকক্ষ ত্যাগ করে। শিবসেনা সদস্যরা সভাতেই এলেন না। ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতিও (টিআরএস)। অতএব শুরু থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়, সোনিয়া গান্ধী প্রয়োজনীয় সংখ্যার কথা বললেও তা ছিল ফাঁকা আওয়াজ। মোদি সরকার মাথা উঁচু করেই লোকসভা থেকে বের হবে।

এই অনিবার্যতা সত্ত্বেও শুক্রবারের লোকসভা ভরপুর ছিল নানা নাটকীয়তায়, যার চূড়ামণি ছিলেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। তীব্র আক্রমণাত্মক ভাষণ সত্ত্বেও তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর নিজের আসনে ফিরে দলীয় সদস্যদের দিকে তাকিয়ে ‘চোখ টিপলেন’। স্পিকার সুমিত্রা মহাজন কংগ্রেস সভাপতির এই আচরণ অনুমোদন না করলেও অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার দিন এটাই হয়ে থাকল মূল চর্চার বিষয়।

বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর বিতর্ক শুরু হয় শুক্রবার। রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, লোকসভার আজকের অধিবেশনের সবচেয়ে বড় চমক ছিল কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর বক্তব্য। ছবিটি টুইটার থেকে নেওয়া
বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর বিতর্ক শুরু হয় শুক্রবার। রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, লোকসভার আজকের অধিবেশনের সবচেয়ে বড় চমক ছিল কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর বক্তব্য। ছবিটি টুইটার থেকে নেওয়া

রাহুল ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম বক্তা। প্রস্তাবের ভাগ্য জানা ছিল বলে ভাষণের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন আক্রমণাত্মক। এত দিন ধরে যে যে বিষয় নিয়ে তিনি ও তাঁর দল সরকারের সমালোচনা করে আসছেন, ভাষণে সেই প্রসঙ্গগুলোই তিনি তুলে ধরেন। যেমন নোট বাতিল, তড়িঘড়ি জিএসটি প্রচলন, পেট্রল-ডিজেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, দেশজোড়া কৃষক বিক্ষোভ, সরকারের দুর্নীতি, সামাজিক অসন্তোষ ও সহিংসতা, মহিলা সুরক্ষা নিয়ে বদনাম, শিল্পবান্ধব হয়ে ওঠা, কালোটাকা ফেরত আনতে ব্যর্থতা, ব্যাংক জালিয়াতি করে দেশান্তরী হওয়া ইত্যাদি। সরকার এবং বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা কড়া ভাষায় করার মধ্য দিয়ে রাহুল স্পষ্ট ভাষায় এ কথা বলে দেন, আগামীবার পালাবদল তাঁরা ঘটাবেন। সেই প্রক্রিয়ায় অংশ নেবেন শাসক দলের অসন্তুষ্টরাও।

সততার প্রশ্নে রাহুল সরাসরি আক্রমণ করেন মোদিকে। ফ্রান্সের সঙ্গে রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনাবেচার যে চুক্তি মোদি সরকার করেছে, দুর্নীতি যে সেখানেই তা পরিষ্কার জানিয়ে তিনি বলেন, কংগ্রেসের চুক্তি মানলে বিমান প্রতি যে টাকা খরচ হতো, তার বদলে তিন গুণ টাকা দিয়ে সেই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে। সরকারি সংস্থার বদলে লাভ করে দেওয়া হয়েছে কাছের শিল্পপতির। মোদিকে সরাসরি আক্রমণ করে রাহুল বলেন, উনি বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি দেশের চৌকিদার। অথচ দেখা যাচ্ছে, চৌকিদার নন, তিনি দুর্নীতির ভাগীদার। রাফায়েল কেনাবেচা প্রসঙ্গে রাহুল অসত্য ভাষণের অভিযোগ আনেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের বিরুদ্ধেও। রাহুল এ কথাও বলেন, এই চার বছরে হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পপতির মধ্যে রয়েছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর পুত্রও। বিজেপি ঠিক করেছে, রাহুলের বিরুদ্ধে সভার অধিকার ভঙ্গের নোটিশ আনা হবে।

আরও পড়ুন...