আরবের বসন্ত বিলাপ

এই জানুয়ারিতেই ফুটেছিল আরব বসন্তের ফুল। এই বিপ্লবের মাধ্যমে আরব বিশ্বের শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল গণজাগরণ। সে জাগরণের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল স্বৈরশাসকদের লৌহ-আসন। আরবেরা স্বপ্ন দেখেছিল‍— বেকারত্ব, ঘুষ, দুর্নীতি, নিপীড়ন, বঞ্চনার অবসান ঘটে এবার গণতন্ত্র আসবে। দুর্বিনীত শাসকদের যূপকাষ্ঠে আর পাঁঠার বলি হবে না সাধারণ মানুষ।

কে জানত, মাত্র পাঁচ বছরেই বিলীন হয়ে যাবে তাদের সেই স্বপ্ন। শুকিয়ে মরীচিকা হবে আরব বসন্তের ফুল। সে ফুলে আজ আবার গণতন্ত্রের সুঘ্রাণ নেই। আছে কেবলই করুণ বিলাপ।
আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল তিউনিসিয়ায়। ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর নিজের গায়ে আগুন জ্বেলে বিপ্লবের মশাল জ্বেলে দেন তিউনিসিয়ার ফেরিওয়ালা বাওয়াজিজি। ঘুষ, দুর্নীতি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তা ছিল এক জ্বলন্ত বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের আগুন আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এসব দেশ হচ্ছে তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন ও সিরিয়া। বিদ্রোহের সে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় স্বৈরশাসক জয়নাল আবেদিন বেন আলীর ক্ষমতার আসন। ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। কিন্তু বেন আলীকে হটিয়েও পাঁচ বছরে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি দেশের সার্বিক পিরিস্থিতি। সে দেশে বর্তমানে সাত লাখ লোক বেকার। এর মধ্যে আড়াই লাখই শিক্ষিত তরুণ। প্রেসিডেন্ট বেজি সাইদ এসেবসি সম্প্রতি নিজেই স্বীকার করেছেন দেশের এই ভয়ানক দুর্গতির কথা। কর্মসংস্থানের দাবিতে তিউনিসিয়ায় এখন প্রতিদিনই চলছে বিক্ষোভ, চলছে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ। এর শেষ কোথায়, কে জানে?

তিউনিসিয়ায় বিপ্লবের সফল পরিণতি উজ্জীবিত করে হোসনি মোবারকের স্বৈরশাসনে নিষ্পেষিত মিসরের সাধারণ মানুষকে। ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি সে দেশেও বিপ্লবের গণজাগরণ সৃষ্টি করে। কাররোর তাহরির স্কয়ার পরিণত হয় মুক্তিকামী মানুষের জনসমুদ্রে। ১৮ দিনের টানা বিক্ষোভের পরিণতিতে প্রায় ৮৫০ জন মানুষের রক্ত ঝরিয়ে এই বিপ্লবও সাফল্যের মুখ দেখে। ১১ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন মোবারক। সেই মোবারক এখন কারাগারে।

পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ইসলামপন্থী ব্রাদারহুড ক্ষমতায় এলেও তা বেশি দিন টেকসই হয়নি। মূলত ব্রাদারহুড়-সমর্থিত মোহাম্মদ মুরসির ক্ষমতালিপ্সাই তাঁর পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৩ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি ক্ষমতা কেড়ে নেন মুরসির কাছ থেকে। এখন সিসির বজ্রশাসনে আগের মতোই লৌহবন্ধনীর ভেতর কাটছে মিসরীয় মানুষরে জীবন। ২০১৪ সালে নতুন সংবিধান দেশের সেনাবাহিনীর ক্ষমতা বাড়িয়েছে। এখন মোবারকের চেয়েও কঠোর হস্তে দেশ শাসন করছেন সিসি। বিক্ষোভ করা দূরে থাক, কারও কোনো টুঁ শব্দটি করার সাহস নেই।

আরব বসন্ত আসা অন্য দেশগুলোর মধ্যে সিরিয়া, ইয়েমেন ও বাহরাইন এখন গোলযোগপূর্ণ দেশ। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি শুরু হয়েছে অনেক আগেই। শুরুতে এই যুদ্ধ ছিল কেবল প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অনুগত সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব এতে নাক গলিয়ে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে তোলে। বাশারের পক্ষে রাশিয়ার শক্ত অবস্থান তাঁকে জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। এর মধ্যে আবার ঢুকেছে ইসলামি সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস। সব মিলিয়ে এখন জটাজালে ঘুরপাক খাচ্ছে সে দেশ। ব্যাপক প্রাণহানি আর ধ্বংসযজ্ঞ সেখানে নৈমিত্তিক ঘটনা। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, দেশটিতে সাড়ে চার বছর ধরে চলমান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এ পর্যন্ত আড়াই লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে শিশু। যুদ্ধের কারণে এক কোটির বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এসব মানুষ বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় ভিক্ষা করছে। সিরিয়ায় এখন না খেয়ে প্রতিদিনই প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে।

ইয়েমেনের অবস্থাও টালমাটাল। আরব বসন্তের জেরে ২০১১ সালের শেষ দিকে দীর্ঘ সময়ের স্বৈরশাসক আলী আবদুল্লাহ সালেহ পদত্যাগ করলেও সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। সালেহর পর তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী আবদুরাব্বো মনসুর এখন দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু দেশে শান্তি নেই। এক দিকে যেমন আইএসের সন্ত্রাসী হামলা চলছে, আরেক দিকে রয়েছে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী আল-কায়েদার উৎপাত। এ ছাড়া শিয়া বিদ্রোহী হুতিদের দৌরাত্ম্য তো আছেই। এই ডামাডোলে পড়ে প্রেসিডেন্ট হাদি এর মধ্যে রাজধানী সানা ছেড়ে এখন এডেনে বাস করছেন। তাঁর সাময়িক সরকারি কর্মকাণ্ড চলছে সেখানেই। হাদির সমর্থনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট বিমান হামলা চালিয়েও হুতি ও ইসলামি জঙ্গিদের হটাতে পারেনি। বরং মাঝখান থেকে হাজারো মানুষের প্রাণ ঝরেছে। আইএস জঙ্গি বেশ কিছু সরকারি ভবন দখল করে বসে আছে। সব মিলিয়ে ইয়েমেনের পরিস্থিতি এখন সালেহর আমলের চেয়েও জটিল।
বাহরাইনের পরিস্থিতি ইয়েমেনের চেয়ে অনেকটা ভালো। তবে সেখানেও বিদ্রোহীরা প্রায়ই সংগঠিত হয়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে নামছে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে দেশটিতে সংখ্যালঘু সুন্নি শাসকদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়ারা বিদ্রোহ-বিক্ষোভ করে আসছে।

আফ্রিকার দেশ লিবিয়ায় আরব বিশ্বের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। সেখানে বিক্ষোভ ছিল মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের মদদে। তাদের সহযোগিতায় বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন ঘটায় বিদ্রোহীরা। এই বিদ্রোহীদের মধ্যে ছিল বিভিন্ন গোষ্ঠীর সশস্ত্র মিলিশিয়া। ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর বিদ্রোহীদের হাতে গাদ্দাফি তাঁর পুত্রসহ নিহত হওয়ার পর থেকে লিবিয়ায় ক্ষমতা নিয়ে রীতিমতো রশি টানাটানি শুরু হয়। বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনী, আদিবাসী গোষ্ঠী ও বিদেশ থেকে আসা সশস্ত্র দলগুলোর মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বৃদ্ধি পায়। এই সুযোগে সেখানে আইএস মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাদের দমনে যুক্তরাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগ করার চিন্তাও করছে। সব দিক মিলিয়ে লিবিয়ার পরিস্থিতি আর যা-ই হোক, গাদ্দাফির শাসনামলের চেয়ে ভালো নয়। বরং সংঘাত ও রক্তক্ষয়ী হামলার ঘটনা বেড়েছে।

আরব বসন্তের পাঁচ বছর পর এসব দেশের সার্বিক যে পরিস্থিতি, এতে কোনো দেশেই স্থিতিশীলতা বা শান্তি নেই। বরং যে আশা নিয়ে বিপ্লবের উন্মেষ ঘটেছিল, তা আজ সুদূরে বিলীন। এত দিনে এটাও পরিষ্কার যে, এই বিপ্লব আসলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লক্ষ্য নিয়ে আসেনি। গণতন্ত্রের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে তা ছিল পশ্চিমা স্বার্থাণ্বেষী গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা। ইউরোপ ও আমেরিকা এতে ইন্ধন জুগিয়েছে অস্ত্রের ব্যবসা করতে এবং তেল আমদানির সুবিধা নিতে।
গত ডিসেম্বরে একটি আঞ্চলিক শীর্ষ সম্মেলনে আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রামতানে লামামরা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিদেশের সামরিক হস্তক্ষেপ বিভিন্ন দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। সন্ত্রাস বাড়িয়েছে। এসব সামরিক হস্তক্ষেপ কেবল সমস্যারই অংশ হতে পারে, তা কোনো সমাধান আনতে পারে না।