ইতিহাস কথা কয়

জাতীয় জাদুঘরের শতবর্ষ পূর্তি হলো এ বছরের ৭ আগস্ট। এখানে রক্ষিত আছে বাঙালির আবহমান ইতিহাস। কিন্তু ’৫২ থেকে ’৭১ পর্যন্ত ইতিহাস এখানে সেজেছে অপূর্ব ভঙ্গিমায়—নতুন সাজে, নতুন উপাদানে, এক আন্তর্জাতিক মানে। ঘুরে এসে লিখেছেন আশীষ-উর-রহমানআপনি যখন পা রাখবেন জাতীয় জাদুঘরের তৃতীয় তলার ৩৭ নম্বর গ্যালারিতে, তখন দুই শতাব্দীর বেশি সময়ের ইতিহাসের পথ ধরে যাত্রা শুরু হবে আপনার। সাম্রাজ্য গড়া ও ভাঙার ঘটনা, বহু বীরত্বব্যঞ্জক আন্দোলন-সংগ্রামের তথ্য-উপাত্ত, নিদর্শন, আত্মদানের মহৎ কীর্তি আপনাকে মনে করিয়ে দেবে পরাভব না মানা বাঙালির গৌরবগাথা। জাতীয় জাদুঘরের শতবর্ষ পূতি হলো এ বছর। ‘ঢাকা জাদুঘর’ নামে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট। ১৯৮৩ সালে এটি জাতীয় জাদুঘরের মর্যাদা লাভ করে। বর্তমানে ৮৬ হাজারের বেশি নিদর্শন নিয়ে জাতীয় জাদুঘর বিশ্বের একটি অন্যতম প্রধান জাদুঘর হিসেবে স্বীকৃত। এখন জাদুঘরে গেলে আপনি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভূ-প্রকৃতির পাশাপাশি, বিশ্বসভ্যতার বহু নিদর্শন সম্পর্কে যেমন জানতে পারবেন, তেমনি এর দুটি বিশেষ প্রদর্শনীতে দেখতে পাবেন কালানুক্রমিকভাবে সাজানো জাতির স্বাধীনতাসংগ্রামের চির দীপ্তিমান অধ্যায়টিও।‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম: বাঙালি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ’ নামে জাতীয় জাদুঘরের ৩৭, ৩৮, ৩৯ ও ৪০ নম্বর গ্যালারিতে দুটি বিশেষ প্রদর্শনীর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রামাণ্যভিত্তিক পরিচিতি। এ বছরের ২০ জানুয়ারি থেকে প্রদর্শনী দুটি দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। এতে প্রতিদিন দুইবার ২০ মিনিটের একটি ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’ দেখানো হয়, দুপুর ১২টায় ও বিকেল চারটায়।এ ছাড়া প্রতিটি গ্যালারিতে আছে একটি করে টাচ স্ক্রিন। এখানে আঙুলের স্পর্শ করে আগ্রহীরা বাংলা-ইংরেজি দুই ভাষায় ‘বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস’ জানতে পারবেন। এমনকি ৩৭ ও ৩৯ নম্বর গ্যালারিতে এ বিষয়ের চারটি প্রামাণ্যচিত্রও অবিরাম প্রদর্শিত হচ্ছে প্লাজমা টিভি মনিটরে। স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসের যাত্রা শুরু হয়েছে ১৭৫৭ সাল থেকে। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রতিকৃতি চোখে পড়বে ৩৭ নম্বর গ্যালারিতে প্রবেশের মুখেই। এক পাশে তাঁর তরবারি ও বিশাল এক গালিচা। এখানে রয়েছে ১৯৪৭ পর্যন্ত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিভিন্ন নিদর্শন ও আলোকচিত্র—নীল প্রস্তুত করার বিশাল কড়াই, টিপু সুলতানের তরবারি, ফকির মজনু শাহর পাঞ্জা, নীল বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহসহ বিভিন্ন সময়ের বিপ্লবীদের প্রতিকৃতি। আছে ব্রিটিশদের নির্যাতনের দৃশ্যসহ অনেক দুর্লভ ছবি। আরও আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতের লেখা চিঠি ও স্যুপের বাটি, কাজী নজরুল ইসলামের গানের খাতা, বেগম রোকেয়ার ডায়েরি। গ্যালারি থেকে বেরোনোর মুখেই দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধা মানচিত্র—ভাগ হয়ে গেল দেশ। এক দিকে ভারত, অন্য দিকে পাকিস্তান।পরের গ্যালারিতে ঢুকলেই অন্য রকম একটা অনুভূতি জাগে মনে। বিশাল লম্বা এই ৩৮ নম্বর গ্যালারি। এখানেই ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’ দেখানো হয়।রয়েছে ভাষা আন্দোলন পর্ব—ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র প্রতিবাদ, পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব, একুশের মিছিলসহ বিভিন্ন ঘটনার ডিজিটাল প্রিন্ট করা বিশাল আকারের অজস্র ছবি, ভাষাশহীদদের আবক্ষ ভাস্কর্য, শহীদ সফিউর রহমানের গুলিবিদ্ধ কোট ও শার্টসহ বিভিন্ন নিদর্শন।ইতিহাসের ধারাক্রম মেনে ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৫৪ সালের যুক্ত ফ্রন্টের ২১ দফা, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, এরপর মুক্তিযুদ্ধ—মুক্তিযুদ্ধের নানা পর্যায় উঠে এসেছে ছবি ও নিদর্শনে। রয়েছে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের দলিল স্বাক্ষরের ছবি। আর যে টেবিলে দলিলটি স্বাক্ষর করা হয়েছিল, সেই টেবিলটিও।৩৯ নম্বর গ্যালারিতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ও গণহত্যার নিদর্শন হিসেবে রাখা হয়েছে সারি সারি করোটি। দ্বিতীয় প্রদর্শনীটি ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ঘটনাবলি নিয়ে সাজানো হয়েছে ৪০ নম্বর গ্যালারিতে। এখানে আছে হাতে লেখা প্রথম সংবিধান, বঙ্গবন্ধুর ব্যবহূত কিছু আসবাবসহ সপরিবারে তাঁর হত্যার বিভিন্ন ছবি।আগের সব ছবিই সাদা-কালো। তবে এই গ্যালারিটি শেষ হয়েছে রঙিন ছবিতে। বাংলার নিসর্গ, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, পয়লা বৈশাখের উৎসব—নতুন ভবিষ্যতের দিকে বাঙালির অগ্রযাত্রার আশা জাগানো এ ছবিই জানিয়ে দেয়, দীর্ঘ রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে আসা বাঙালি ঠিকই যেতে পারবে তার স্বপ্নের সোনালি সোপানে।আয়োজনের নেপথ্যে যাঁরাভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে জাদুঘরের ৩৮ নম্বর গ্যালারিতে আগে ছোট আকারে একটি প্রদর্শনী চললেও ২০০৯ সালে গ্যালারিটির পুনর্বিন্যাসের কাজ শুরু হয়। পরিকল্পনা ছিল ১৭৫৭ থেকে ১৯৭১ এবং ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ কালপর্বে দুটি বিশেষ প্রদর্শনীর মাধ্যমে ইতিহাসের ধারাক্রম অনুসরণ করে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরা।এরপর ‘বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে দুটি বিষয়ভিত্তিক প্রদর্শনী উপস্থাপন’ নামের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অধ্যাপক নজরুল ইসলামকে সভাপতি করে ১০ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। সদস্যসচিব ও কর্মসূচি সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন জাদুঘরের সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা বিভাগের কিপার (চলতি দায়িত্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি জানালেন, নয় শতাধিক ছবি এবং প্রায় সমপরিমাণ নিদর্শন নিয়ে এই দুই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। দুই প্রদর্শনীর অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা করেছেন নাজনীন হক এবং ভাস্কর্য করেছেন আবু হেনা জিয়া উদ্দিন। সার্বিক পরামর্শ দিয়েছেন জাদুঘর বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মাহমুদ।জাদুঘরের মহাপরিচালক প্রকাশ চন্দ্র সাহা জানান, তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রামাণ্য আকারে দেশ ও জাতির গৌরবময় ইতিহাসকে এখানে তুলে ধরা হয়েছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানোর উদ্দেশ্যে।