ক্রেইজি ডেইজি

বুকস্টোরের মেঝেতে ইয়োগার আসন। ছবি: লেখক
বুকস্টোরের মেঝেতে ইয়োগার আসন। ছবি: লেখক

ডেইজি ডিটার্ক কলোনিয়াল ধাঁচের যে বাড়িতে একা বসবাস করে, তার একতলা, দোতলা ও বেসমেন্টে আছে অনেকগুলো খালি কামরা। বাড়িখানির বয়স দেড় শ বছরের কাছাকাছি। চারদিকে আপেল ও স্ট্রবেরির সাত একরের অরচার্ড। ডেইজি আজকাল ভারতীয় ধর্মতত্ত্ব নিয়ে রিসার্চ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক্রেইজি ডেইজি’ বলে আড়ালে–আবডালে তার নামডাক আছে। খানিকটা জরাজীর্ণ তার পুরোনো বাড়িটির রোদ ঝলসানো সানরুমে বসে আমি ভাবি, অ্যায়সা আলিশান একটি বাড়িতে তার মতো আকর্ষণীয়া যুবতী নিঃসঙ্গ হালতে বাস করছে, তাতে তার ক্রেইজি হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। সানরুমে আমি একা নই। আরেক ভুঁড়িওয়ালা শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক নাকের ব্রিজে বাইফোকাল চশমা ঝুলিয়ে মস্ত একটি পোস্টারে মন্দিরের দেয়ালগাত্রে আঁকা কোনো দেবীমূর্তির দিকে ধুন ধরে তাকিয়ে আছেন। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বলেন, ‘দিস ইজ দ্য পসচার অব আসটংগা ইয়োগা। এই ইয়োগার সিগনিফিকেন্স হচ্ছে...।’ এ ভদ্রলোকের সন্তান ইয়োগার মাহাত্ম্য সম্পর্কে বিস্তর বলে যান, আলোচনাটি ফিলোসফিক্যাল, কিন্তু আজকাল আমার মাথায় ইনটেলেকচুয়াল মঙ্গা চলছে, তাই আসটংগার আলাপ বিশেষ ঢোকে না। অন্য পাশে ছালবাকলা ওঠা একটি পিয়ানোর পায়ায় হেলান দিয়ে বসে এক তরুণী ‘ওম’ ধ্বনিতে শোল্ডার শ্রাগ করে মৃদু হাসে। তার খোলা কাঁধ ও বাহুতে চন্দনের গাঢ় প্রলেপ, মুখে কেষ্ট ঠাকুরের আড়বাঁশির মতো নীলাভ কাচে তৈরি দীর্ঘ পাইপ, তা থেকে নিঃসৃত ধোঁয়ায় ছড়াচ্ছে আবগারি আমেজ।

মন্দিরের মিউজিক্যাল পিলার। ছবি: সংগৃহীত
মন্দিরের মিউজিক্যাল পিলার। ছবি: সংগৃহীত

ডেইজির সাথে প্রথম আলাপ হয় আমহার্স্ট শহরের ‘ফুড ফর থট বুকস’ নামে একটি বোহেমিয়ান কিসিমের বইয়ের দোকানে। স্টেগ করে রাখা প্রায় হাজার তিনেক বইয়ের বান্ডিলের আড়ালে বৃত্তাকারে সাজানো চেয়ারে বসে ছিল জনা সাতেক ভবঘুরে গোছের পাঠক। খানিক দূরে তাদের সগোত্রীয় এক সহেলি ভরদুপুরে মেঝেতে তার মাথাটি রেখে ডিগবাজির কায়দায় পদযুগল ঊর্ধ্বে তুলে ইয়োগার কোনো বিচিত্র আসনে মশগুল হয়ে আছে। এসব স্রেফ ইগনোর করে, গোল হয়ে বসা গ্রুপটির মধ্যমণি হয়ে ভারতীয় শাস্ত্রের ‘অহং’ প্রসঙ্গে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখছে ডেইজি, তা নিয়ে আলোচনা করছে। আমি তাদের কাছে ভিড়লে ডেইজি চোখ মুদে জোড়হাতে আমাকে প্রণাম করে বসতে অনুরোধ জানায়। সে দিনের সান্ধ্য-আলাপে বিষয় হিসেবে অহং যতটা না সুশ্রাব্য ছিল, তার চেয়ে অধিক আকর্ষণীয় ছিল তার পরনের লেহেঙ্গাটি। ডেইজি লেহেঙ্গা নামক পরিধেয়টিকে আধ্যাত্মিক পরিচ্ছদ হিসাবে আখ্যায়িত করে। পাঁড় পাঠক গোছের শ্রোতাদের কেউ কেউ প্রতিক্রিয়ায় কমেন্ট করতে গেলে, তাদের উচ্চারণবিভ্রাটে অহং-লেহংয়ে বেজায় তালগোল পাকিয়ে যায়। কুমিল্লা খদ্দরের ফতুয়াটি পরে আমি এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে ছিলাম, আলোচনা শেষ হতেই আমাকে গুরু সম্বোধন করে জানায় যে এক সাঁই-সন্তের সন্ধানে আগামী সপ্তায় সে কর্ণাটক যাচ্ছে। তার কাছে সে পূর্বজন্ম ও ইয়োগার অন্ধিসন্ধি শিখবে। ভারতে কোন মন্দিরটি তার পরিদর্শন করা উচিত, সে সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চায়। আমি বিজ্ঞজনোচিত ভঙ্গিতে তাকে মাদুরার মীনাক্ষী মন্দিরের কথা বলি। শুনেছি যে মীনাক্ষী মন্দিরে আছে অজস্র স্তম্ভ। এসব স্তম্ভে খোদাই করা নানাবিধ মূর্তি। সমুদ্রতীরের মন্দিরটিতে হু হু করে হাওয়া বয় সারাক্ষণ। আর স্তম্ভগুলোর হরেক রকমের খাঁজে বাতাসের তাড়ন লেগে বেজে ওঠে আশ্চর্য সংগীত। পর্যটকদের কেউ কেউ এ কারণে মীনাক্ষী মন্দিরকে মিউজিক্যাল টেম্পলও বলে থাকেন।

বছরখানেক পরের ঘটনা। ডেইজি হিন্দুস্তান থেকে ফিরে এসেছে রীতিমতো ভারতনাট্যমের সবক নিয়ে। সাঁই-সন্ত স্নেহ করে তাকে কুমারী অনুরাধা নাম দিয়েছেন। পূর্বজন্মে সে নাকি মীনাক্ষী মন্দিরে দেবদাসী ছিল, এ তত্ত্বও সে সাঁই-সন্তের কাছ থেকে জানতে পারে। সাঁই-সন্ত পুরুষটি তার চেতনায় মহাপুরুষ বিশেষ, শারীরিক অন্তরঙ্গতায় তাকে বরণ করে নিয়ে তিনি নাকি তার সাথে কেষ্ট ঠাকুরের মতো আচরণ করেছেন। মহাপুরুষটির সঙ্গে তার কামসূত্রের প্রায়োগিক পদ্ধতিতে দেহজ সম্পর্কের প্রসঙ্গটি আরেক দফা ‘ফুড ফর থটের’ আড্ডায় খোলামেলা আলোচনা করে সে রীতিমতো সেনসেশনের সৃষ্টি করে। তা ছাড়া তার কোনো কোনো অনুরক্ত তাকে অনুরাধার পরিবর্তে অনুনাসিক জবানে অনুগাঁধা ডেকে উচ্চারণ বিভ্রাটের ধাঁধাও তৈরি করেছিল।

আজ ডেইজির বসতবাড়িতে তার ভারত-সফরজনিত প্রতিফলন শুনতে আমি নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছি। কুমারী অনুরাধা নূপুর ঝমঝমিয়ে সানরুমের চৌকাঠে এসে দাঁড়ায়। তার পায়ে অলক্তরাগ। দেবদাসীদের কায়দায় বিনম্র প্রণামে সে আমাদের ড্রয়িংরুমে যেতে ইশারা করে। ওখানে ফ্লোরে ইয়োগা ম্যাট বলে রাবারের ছোট ছোট আসন পাতা। আমরা তাতে যোগাসনের কায়দায় বসি। আধো অন্ধকার কক্ষটি ভরে আছে ধূপধুনার সৌরভে। আমি অবাক হয়ে দেখি, কামরার সমগ্র দেয়ালজুড়ে পেস্ট করা মীনাক্ষী মন্দিরের ছবিওয়ালা বিশাল সব ওয়ালপেপার। দ্বিমাত্রিক ভঙ্গিতে তোলা এ ফটোগ্রাফে পাথরে খোদিত দেব–দেবী, কিন্নর ও অপ্সরার মূর্তি নিয়ে সারি সারি মিউজিক্যাল পিলারগুলো স্পষ্টত দৃশ্যমান। টেপে দক্ষিণ ভারতীয় কোনো শিল্পীর বীণাবাদন সারা কামরায় ছড়াতে থাকে আবেশ। আর সন্ধ্যা লাগার মুখে গোধূলির ছায়াময় মৃদু আলো মস্ত সব কাচের পিকচার উইন্ডো দিয়ে ফিল্টার হয়ে ধূপের ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে যেতে থাকে।

ভারতের মীনাক্ষী মন্দির। ছবি: সংগৃহীত
ভারতের মীনাক্ষী মন্দির। ছবি: সংগৃহীত

আমি লোকমুখে শুনেছি যে আজকাল ডেইজি প্রায়শ রূপান্তরিত হয় অনুরাধা নামের পুরাকালের এক দেবদাসীতে। সে মীনাক্ষী মন্দিরের পুরাতাত্ত্বিক আবহে নৃত্যগীতে মশগুল হলে তার মন তৎক্ষণাৎ চলে যায় পূর্বজন্মে। আর ভিন্ন জন্মের অতীন্দ্রিয় বাস্তবতায় সে তখন সন্ধান করতে সমর্থ হয়, তার বন্ধুবান্ধব–স্বজনবিজনরা পূর্বজন্মে কে কোন পরিস্থিতিতে কী ধরনের জীবন যাপন করত। বিষয়টির অথেনটিসিটি বা সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে বটে, তবে আচরণটি নিঃসন্দেহে কৌতূহল উদ্দীপক। তাই কুমারী অনুরাধায় রূপান্তরিত হয়ে আমাদের ডেইজি কীভাবে এ জন্ম অতিক্রম করে ঢুকে পড়ে তার পূর্বজন্মের রহস্যময় ভুবনে, তা ডিটেইলড পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমি তার দিকে মনোনিবেশ করি।

এ মুহূর্তে বীণার বাদনের সঙ্গে জোরেসোরে মিশ্রিত হচ্ছে তবলার বোল, আর কুমারী অনুরাধা পিদিম হাতে ভারতনাট্যমের কায়দায় নেচে যাচ্ছে মিনাক্ষী মন্দিরের প্রেক্ষাপটে চিত্রিত স্তম্ভময় আঙ্গিনায়। না, তার বসনভূষণ সম্পূর্ণভাবে ভারতনাট্যমের নৃত্যশিল্পীদের মতো নয়। বিছেহারে জড়ানো খানিক উন্মোচিত কটিদেশ ও চন্দনের নকশা–আঁকা নিম্ন নাভি প্রভৃতি অজন্তার দেয়ালগাত্রের নারী মূর্তিদের কথা মনে করিয়ে দেয়। তার নৃত্যের ভঙ্গিও ধ্রুপদি ধাঁচের ভারতনাট্যম নয়; তবে তাতে যেন আলারিপ্পুর অল্প আভাস পাওয়া যায়। ক্রমশ আঁধার ঘনিয়ে আসে আর পিলসুজের মৃদু আলোয় বাঙ্​ময় হয়ে ওঠে তার চোখমুখে দেবদাসীর নিবেদনের আকুতি।

ফুড ফর থট বুকস, যে বইয়ের দোকানে প্রথম আলাপ হয়েছিল ডেইজির সঙ্গে
ফুড ফর থট বুকস, যে বইয়ের দোকানে প্রথম আলাপ হয়েছিল ডেইজির সঙ্গে

নৃত্যের শেষে সে কিছুক্ষণ যোগাসনে নিমগ্ন হয়। আমার পাশে ইয়োগা ম্যাটে বসা ভুঁড়িওয়ালা ভদ্রলোক ও পাইপ ফোঁকা তরুণী ফিসফিস করে যোগাসনের গুণাগুণ নিয়ে আলাপ করে। তারা ঠিক বুঝতে পারছে না, অনুরাধার বসার ভঙ্গিটি বকাসনা না শীর্ষাসনা। দু–পায়ে ঝিঝি ধরে যদি জকড়ি-মকড়ি লেগে যায়—এ আশঙ্কায় আমি উসখুস করি। যোগধ্যান শেষে অনুরাধা ছোট্ট ছোট্ট চিরকুটে আমাদের পূর্বজন্মের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু লেখে। আমি আমার চিরকুট নিয়ে আলোর জন্য সানরুমে চলে আসি। দেখি চিরকুটটিতে লেখা, ‘তোমার পূর্বের জীবন কিন্তু অনেকগুলো। আমি নিকট অতীতের কিছু তথ্য দিচ্ছি। আজ থেকে এক শ তেত্রিশ বছর আগে তুমি ছিলে গোয়ালিয়রের মহারাজার হাতির মাহুত। তোমার নাম কী ছিল, তা তুমি জানতে চাও কি?’ চিরকুট নিয়ে ড্রয়িংরুমে ফিরে আসতেই দেখি, ডেইজি ধ্যান ভেঙে মুখখানা বেজায় রহস্যময় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই সে বলে, ‘তোমার আগের দুটি জন্ম সম্পর্কে চমৎকার কিছু তথ্য জানতে পেয়েছি। আই অ্যাম শিওর ইউ আর ডাইয়িং উইথ কিউরিসিটি।’ আমি এ জন্ম নিয়ে বেজায় বিপাকে আছি, তাই বলি,‘ ডেইজি বাদ দাও, আগের জন্মগুলো নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই।’ তাকে কাটানোর জন্য ফের বলি, ‘আমার একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, আমি উঠছি, গুডবাই।’ সে খপ করে আমার কবজি চেপে ধরে বলে, ‘ইউ মাস্ট ফাইন্ড আউট হোয়াট ইউ ওয়্যার ইন অ্যাটলিস্ট ওয়ান আদার লাইফ।’ আমি না বলার সুযোগ পাই না। সে কানের কাছে মুখ এনে বলে, ‘লিসেন কেয়ারফুলি, ইউ ওয়্যার আ আপার কাস্ট প্রিস্ট। তুমি যে একসময় উচ্চবর্ণের বামুন ছিলে, তা তো আমি কস্মিনকালেও ভাবিনি। তোমার স্ত্রী ছিল অনেকগুলো, অল ওয়্যার আন্ডার–এজ গার্লস, তাদের বলা হতো গৌরি। দশ-বারো বছরের বালিকাগুলো তাদের মা-বাবার বাড়িতে বাস করত।’ ডেইজির যোগধ্যানলব্ধ তথ্য সঠিক হলে কোনো এক অতীত জন্মে আমি ছিলাম কুলীন, আর আমার দুলহানরা সবাই–ই ছিল নেহাত নাবালিকা! বিষয়টিতে যুক্ত আছে সামাজিক নিন্দা, ভেবে এ জন্মে আমি দারুণভাবে শরমিন্দা বোধ করি। কিন্তু এ বাবদ এখনই আর অধিক কিছু শুনতে চাই না। তাই ফের ‘বাই বাই’ বলে দুয়ারের দিকে অগ্রসর হই। ডেইজি এগিয়ে এসে কপাট খুলে দিতে দিতে বলে, ‘যদি আগ্রহ হয়, তাহলে আমাকে ই–মেইল করতে পারো, তোমার শ্বশুরবাড়িগুলোর অবস্থান কোন কোন গ্রামে, সে তথ্যও আমার কাছে আছে।’ আমি ‘থ্যাংক ইউ ডেইজি, আমার আর কোন ক্রেইজি ইনফরমেশনের দরকার হবে না’—বলে বেরিয়ে আসি তার বসতবাড়ি থেকে।