>দীনেশচন্দ্র সেন ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রাচীন পালাগানের সংকলন মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশ করেন। প্রথম খণ্ডে পালা ছিল ১০টি। এই ১০টি পালার রচয়িতা ভিন্ন হলেও সংগ্রাহক একজনই—চন্দ্রকুমার দে। মৈমনসিংহ গীতিকার বেশির ভাগ পালাই নায়িকাদের নাম অনুসারে। আর এই পালার নায়িকারা আবহমান বাঙালি ঐতিহ্যেরও উজ্জ্বল প্রতিনিধি। গ্রন্থনা করেছেন অনার্য তাপস।
মহুয়া
মৈমনসিংহ গীতিকার প্রথম খণ্ডে যে ১০টি পালাগান প্রকাশিত হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম পালা ‘মহুয়া’। এই পালার প্রধান চরিত্র মহুয়ার নাম অনুসারে পালার নামকরণ করা হয়। এর রচয়িতা দ্বিজ কানাই। এই পালার রচনাকাল ধরা হয় ১৬৫০ সাল। মহুয়া পালায় মোট ৭৮৯টি ছত্র আছে। দীনেশচন্দ্র সেন এই পালাগানকে ২৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেন। এ পালাটি কবিতা আকারে লেখা। রসের দিক থেকে ‘মহুয়া’ পালা রোমান্টিক ট্র্যাজেডি ঘরানার কাব্য।
মৈমনসিংহ গীতিকায় যে ঋজু নারী চরিত্রগুলো দেখা যায়, ‘মহুয়া’ পালার মহুয়া চরিত্রটি তাদের মধ্যে অন্যতম। এক দিকে ছয় মাস বয়সে চুরি হয়ে যাওয়া ও বেদে–সরদার হুমরার কাছে প্রতিপালিত হওয়া অনিন্দ্যসুন্দরী মহুয়া এবং অন্যদিকে রাজাপুত্র নদের চাঁদের অদম্য প্রেমকাহিনিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এ পালার কাহিনি; যেখানে সমস্ত রোমান্টিকতার ওপরে মৃত্যুই ছিল অবধারিত। দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকার প্রথম খণ্ড–এর ভূমিকায় লিখেছেন, ‘মহুয়ার প্রেম কী নির্ভীক, কী আনন্দপূর্ণ! শ্রাবণের শতধারার ন্যায় দুঃখ আসিতেছে, কিন্তু এই প্রেমের মুক্তাহার কণ্ঠে পরিয়া মহুয়া চিরবিজয়ী, মৃত্যুকে বরণ করিয়া মৃত্যুঞ্জয়ী হইয়াছে।’
মলুয়া
‘রাগে উজ্জ্বল, বিরাগে উজ্জ্বল, সহিষ্ণুতায় উজ্জ্বল এই মহীয়সী প্রেমের মহাসম্রাজ্ঞীর তুলনা কোথায়?’ মৈমনসিংহ গীতিকার সম্পাদক দীনেশচন্দ্র সেন যে নারী চরিত্রটির জন্য এই মন্তব্য করেছেন তার নাম মলুয়া, তিনি ‘মলুয়া’ পালার প্রধান চরিত্র। ‘মলুয়া’ পালার রচয়িতা অজ্ঞাত। যদিও পালার শুরুতে চন্দ্রাবতীর একটি ভণিতা থাকার কারণে কেউ কেউ অনুমান করেন এটি চন্দ্রাবতীর রচনা। তবে দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকার প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় বলেছেন যে এই অনুমান তাঁর কাছে ‘সত্য বলিয়া’ মনে হয় না। কিন্তু বাংলার পুরনারী নামের বইয়ে ‘মলুয়া’ পালার আলোচনায় তিনি বলেছেন, ‘মলুয়া চন্দ্রাবতীর রচনা।’ এই গাথার মোট ছত্রসংখ্যা ১২৪৭। সম্পাদক এই পালাকে ১৯ অঙ্কে বিভক্ত করেছেন।
কাজির ক্ষমতায় হঠাৎ বিচ্ছেদের সুর বেজে ওঠা মলুয়া এবং চাঁদ বিনোদের প্রেমময় দাম্পত্য সম্পর্ক, সংসারের উত্থান–পতন, ক্ষমতাবান কাজির দাপট এবং সেই ক্ষমতার কাছে মাথা নত না–করা এক বাঙালি নারীর মর্যাদার লড়াইকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ‘মলুয়া’ পালার কাহিনি।
কমলা
মৈমনসিংহ গীতিকার পালাগুলোর মধ্যে যে পালাগুলোর নামকরণ করা হয়েছে প্রধান চরিত্রের নাম থেকে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম পালা ‘কমলা’। পালাটির রচয়িতা দ্বিজ ঈশান। ‘কমলা’ পালাটিতে রয়েছে মোট ১৩২০টি ছত্র এবং এটি ১৭টি অঙ্কে বিভক্ত।
প্রিয়তমা স্ত্রীর শখ পূরণ করতে রাজা জানকীনাথ মল্লিক তার স্ত্রী কমলার নামে ‘কমলা সায়র’ দিঘি খনন করেছিলেন। কিন্তু দৈবক্রমে দিঘিতে জল উঠল না। এ কারণে রাজার পূর্বপুরুষেরা ‘নরকপ্রাপ্ত’ হতে পারে বলে রাজা চিন্তিত হলে রানি কমলা স্বামীকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন। তিনি তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে দাসীদের হাতে সমর্পণ করে সদ্য খোঁড়া দিঘিতে নিজেকে উৎসর্গ করে চিরতরে হারিয়ে গেলেন। রাজা শোকে পাথর হয়ে কিছুদিনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। এই বিয়োগান্ত কাহিনি নিয়ে রচিত হয়েছে ‘কমলা’ পালা। মৈমনসিংহ গীতিকার ভূমিকায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা আলোচনা করে দীনেশচন্দ্র সেন ধারণা করেছেন, এই কাহিনির মূল ঘটনা সত্য।
কাজল রেখা
মৈমনসিংহ গীতিকায় যুক্ত হওয়া একমাত্র রূপকথা ‘কাজল রেখা’ পালা। এই পালার রচয়িতা অজ্ঞাত। কিছুটা গল্প বর্ণনা এবং কিছুটা কবিতা বা গান এই ভঙ্গিতে ‘কাজল রেখা’ পালাকে পাওয়া যায় দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায়। এই পালার কিছুটা সংক্ষিপ্ত রূপ সংকলিত হয়েছে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার সম্পাদিত ঠাকুরমার ঝুলিতে।
ধনেশ্বর তার অর্থনৈতিক দুর্ভাগ্যের কারণে শুকপাখির উপদেশে কন্যা কাজল রেখাকে এক গভীর নির্জন বনের ভাঙা মন্দিরে রেখে আসে। সেই মন্দিরে এক সন্ন্যাসী কোনো এক মৃতপ্রায় রাজপুত্রের জীবন ফিরিয়ে আনার জন্য সুচ বিঁধিয়ে রেখেছিলেন। পিতা ও সন্ন্যাসীর কথায় কাজল রেখা সেই সুচরাজপুত্রকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করে নেয়। তার সুচ তুলে যখন সে রাজরানি হয়ে স্বামীর রাজ্যে সুখে বসবাস করবে, ঠিক তখনই আবার ঘটে যায় দুর্ঘটনা। হাতের কাঁকন দিয়ে কিনে নেওয়া দাসীর কৃতঘ্নতায় কাজল রেখা নিজেই দাসী হয়ে স্বামীর রাজ্যে বসবাস করতে থাকে। দীর্ঘ সময় নিজের দুর্ভাগ্য আর সন্ন্যাসীর উপদেশের জন্য ভীষণ কষ্ট করে সব প্রতিকূলতাকে জয় করে কাজল রেখা—এই কাহিনিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে ‘কাজল রেখা’ পালা। সূত্র: মৈমনসিংহ গীতিকা, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৮, সম্পাদক: দীনেশচন্দ্র সেন; বাংলার পুরনারী, দি ন্যাশনাল লিটারেচার কোং, কোলকাতা, প্রথম সংস্করণ, ১৯৩৯, দীনেশচন্দ্র সেন।