ধারাবাহী

একসময় তোমরা এই বিদ্যালয়ে ছিলে—দূরে গেলে মনের বিচ্ছেদ ঘটতেও পারে, সেই জন্য দু-একটি কথা তোমাদের কাছে বলা প্রয়োজন মনে করি।
আমাদের এই বিদ্যালয় নানা রকম যোগাযোগে গড়ে উঠেছে, কিন্তু সর্বদাই এর মধ্যে একটা মূল তত্ত্ব কাজ করছে। আমি যদি বলি সে তত্ত্ব আমার, কঠিন ছাঁচে ঢালাই করে তাকে রক্ষা করতে হবে—তা হবার নয়; আমি বলব না যে এমন একটা কাঠামো তৈরি করতে হবে যা চিরকাল থাকবে। এর ভিতরকার সে মূল কথাটি এই যে একটি বৃহত্তর জীবনের ভূমিকায় আমরা অনেকে একসঙ্গে এখানে মিলিত হয়েছি—নানা বিচিত্রতা বিরুদ্ধতার মধ্য দিয়ে একটি প্রাণবান অনুষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সে নিজেও জানে না কোন পথে যাবে, তার কোনো বাঁধা পথ নেই।
একলা যখন ছিলুম তখন আমার অভিপ্রায়ই এ অনুষ্ঠানের মধ্যে কাজ করেছে। পথ তখন সহজ ছিল। যখন কথা হলো যে সাধারণের হাতে সমর্পণ না করলে এ বেশি দিন স্থায়ী হবে না, দেশের যোগ থাকবে না, তখন একটা কনস্টিটিউশন করতে হয়েছিল—তৎপূর্বেই অন্যান্য দেশের সঙ্গে এর যোগ ঘটেছিল, অনেকে জেনেছিল এর কথা। আমার মতে, এই কলাকৌশলের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করবার প্রয়োজন আছে। তোমরা অনেকে জানো এই বিদ্যালয়ের জন্য নিজেকে আমি অনেক বঞ্চিত করেছি—সাহিত্য যে আমার পন্থা তাতেও আমি আঘাত সয়েছি। আমার অবর্তমানে এ যদি একটা কল মাত্র হয়, তবে কেন এত করেছি। আমার সেই গোপন দুঃখের ইতিহাস কখনো কেউ জানবে না। আনুকূল্যের চেয়ে অধিক মিথ্যে উক্তি আমি লাভ করেছি—বহু বিদ্রূপ–নিন্দা করে এখন আমার জীবনের শেষ ভাগ উপস্থিত। এখন যদি একটা জীবন্মৃত পদার্থে পরিণত হয়, এর প্রাণশক্তি না থাকে, তবে ব্যর্থ হলুম। যতটা দিয়েছি তার কিছুই ফল পাব না তা ইচ্ছে করে না।
তোমরা সবাই অনুকূল হবে এমন আমি আশা করি নে, তবে আশা করি এক দল আছ যাদের এর সম্বন্ধে মমতা থাকা স্বাভাবিক। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এ বিদ্যালয় প্রাণবান, এর মধ্যে অসংগতি থাকতে পারে, কিন্তু এর অন্তরে প্রাণ সঞ্চারিত। তোমরাও যদি তা–ই মনে করো তবে এর অঙ্গীভূত হয়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটা স্থায়ী প্রভাব এর উপরে বিস্তার করতে পারো।
বিরুদ্ধতাকেও আমি স্বীকার করি—তোমাদের কাছে আমি শুধু এইটুকু চাই যে অকৃত্রিম মমতার সঙ্গে একে তোমরা গ্রহণ করো।
কী করে তার অবকাশ হতে পারে তা আমি জানি নে—কনস্টিটিউশন সম্বন্ধে কিছু বলতে আমি অক্ষম—আমি শুধু আমার ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারি; যখন আমি থাকব না তখন এর মধ্যে প্রাণকে জাগিয়ে রাখতে পারে এমন একটা শক্তি থাকা দরকার—তোমরা যদি অগ্রসর হয়ে একে গড়ে নাও তবে সেই অভাব মোচন হতে পারে।

সংগ্রহ ও ভূমিকা: ভূঁইয়া ইকবাল
কবির বেশ কয়েকটি ভাষণ-অভিভাষণ-বক্তৃতা রবীন্দ্র-রচনাবলিতে সংগ্রথিত। বাংলাদেশে ১৯২৬-এ ঢাকায় ও ময়মনসিংহে প্রদত্ত ভাষণ কবি নিজেই ‘পূর্ববঙ্গে বক্তৃতা’ শিরোনামে প্রকাশের জন্য প্রবাসী পত্রিকায় পাঠিয়েছিলেন। ওই সব বক্তৃতা পুস্তকাকারে প্রকাশের জন্য কবি বসুমতী সাহিত্য মন্দিরকে ভার দিয়েছিলেন। তিনি নিজে ওই বইয়ের গ্রুফও দেখে দিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত অজ্ঞাত কারণে বইটি তখন বেরোয়নি (২০১০ সালে ঢাকা থেকে প্রথমা প্রকাশন বইটি প্রকাশ করে)।
রবীন্দ্রসমালোচক নিত্যপ্রিয় ঘোষ চার খণ্ডে সংকলন করেছেন কবির ভাষণমালা—মুখের কথা লেখার ভাষায় (২০০৬-০৯)। সম্পাদক জানিয়েছেন, এতে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত কবির বক্তৃতা সংকলিত হয়েছে। কবির বহু লিখিত ও কথিত (প্রথমে অনুলিখিত এবং পরে বক্তা কর্তৃক সংশোধিত, পরিমার্জিত) ভাষণ সমকালের সাময়িকপত্রে প্রকাশ পায়। কিন্তু সব কটি রবীন্দ্র-রচনাবলিতে গ্রথিত হয়নি।
রবীন্দ্রনাথের এই অগ্রন্থিত অভিভাষণটি বিশ্বভারতীর তেত্রিশ খণ্ড রচনাবলিতে নেই। শান্তিনিকেতন ‘আশ্রমিক-সংঘের প্রতিনিধিমণ্ডলীর নিকট কথিত’ এই ছোট বক্তৃতাটি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বিশ শতকের প্রথমার্ধের প্রভাবশালী পত্রিকা প্রবাসীতে প্রকাশ পায় (ফাল্গুন ১৩৪১)। এর সঙ্গে ছিল ‘বিশ্বভারতী পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে আচার্যের অভিভাষণ’—আরেকটি বক্তৃতাও (৮ পৌষ ১৩৪১)। সে সময় বক্তৃতা দুটি একসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল। (কিন্তু এখানে পত্রস্থ করার সময় একটি বক্তৃতা প্রকাশ করা হচ্ছে) তখন সম্পাদকীয় মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়, ‘দু-টি ভাষণই শ্রীযুক্ত পুলিনবিহারী সেন কর্তৃক অনুলিখিত ও তদনন্তর বিশ্বকবি কর্তৃক সংশোধিত ও অনুমোদিত।’ কৃতজ্ঞতা স্বীকার: মখছুদুর রহমান, গ্রন্থাগার সহকারী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর। এখানে প্রকাশিত অগ্রন্থিত অভিভাষণটির ক্ষেত্রে সমকালীন বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।