বঙ্গদেশে ক্রিকেটের সূচনাপর্ব

শিল্পীর কল্পনায় নাটোর ইলেভেনের দুই কর্তাব্যক্তি জগদিন্দ্রনাথ রায় ও সারদারঞ্জন রায়ের ক্রিকেট খেলা। অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
শিল্পীর কল্পনায় নাটোর ইলেভেনের দুই কর্তাব্যক্তি জগদিন্দ্রনাথ রায় ও সারদারঞ্জন রায়ের ক্রিকেট খেলা। অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
চলছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। টিম বাংলাদেশের জন্য টেনশনে সময় যাচ্ছে সমর্থকদের। কিন্তু ‘নাটোর ইলেভেন’ নামের সেই ক্রিকেট দলটির কথা মনে আছে? অবিভক্ত ভারতের প্রথম বাঙালি ক্রিকেট সংগঠক মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় কি বিস্মৃত? লিখেছেন মাহবুব সিদ্দিকী

ক্রিকেটের জন্মভূমি ইংল্যান্ডে শুরু হয়েছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। বিশ্ব ক্রিকেটে ধীরে ধীরে আগুয়ান হচ্ছে টিম বাংলাদেশ। গ্রাম থেকে শহর—সবখানেই এখন ক্রিকেটের জয়জয়কার। ক্রিকেট মানেই উন্মাদনা। এই উন্মাদনার হাত ধরে একটু ঘুরে আসা যাক বঙ্গ–ক্রিকেটের সূচনাপর্ব থেকে।

রাজকীয় খেলা ক্রিকেট ইংল্যান্ড থেকে ধীরলয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল তার উপনিবেশগুলোয়। এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা ছিল ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, সিভিলিয়ান ও সামরিক বিভাগ–সংশ্লিষ্ট মানুষদের। শুরুতে খেলাটি সীমাবদ্ধ ছিল কেবল অভিজাত শ্রেণির মধ্যে। যে কারণে একে বলা হতো ‘গেম অব লর্ড’। তবে দিন দিন সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে।

বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে রাজশাহী শহরে ক্রিকেট খেলার প্রচলন হয়েছে তুলনামূলকভাবে আগে। খ্রিষ্টীয় আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত পদ্মাতীরবর্তী রাজশাহী শহরে ইংরেজ, ডাচ ও ফরাসি নাগরিকদের সমাবেশ ঘটেছিল। এরা এই শহরে নীল, রেশম, কার্পাস, সরু চাল ও লাক্ষার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এদের মধ্যে ইংরেজরা ছিল সংখ্যায় বেশি। এ বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ীর বেশির ভাগ তাঁদের পরিবার-পরিজন রেখে এই অঞ্চলে একাকী বসবাস করতেন। তাঁরাই পদ্মাতীরবর্তী সাহেবগঞ্জ নামক স্থানে (১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে) ১৮৮২ সালে ‘ভিক্টোরিয়া ক্লাব’ নামে একটি খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রথম দিকে ক্লাবটি ছিল ইনডোর গেমসনির্ভর। এর দুই-তিন বছরের মধ্যে সাহেবগঞ্জের কাছাকাছি পদ্মাতীরবর্তী পাঁচআনি খেলার মাঠে তাঁরা হকি ও ফুটবল খেলার প্রচলন করেন। এই পাঁচআনি মাঠে ১৮৯০ সালে ইংরেজরা প্রথম ক্রিকেট খেলা প্রদর্শন করে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। বলা ভালো, খেলাধুলার ক্ষেত্রে ওই ভিক্টোরিয়া ক্লাব ছিল রাজশাহীর খেলাধুলার ইতিহাসে প্রথম পূর্ণাঙ্গ ক্লাব।

১৮২৫ সালে রাজশাহী জেলার সদর দপ্তর নাটোর থেকে সরিয়ে রাজশাহী শহরে (তখনকার নাম রামপুর বোয়ালিয়া) আনা হয়। এরপর থেকেই বৃহত্তর রাজশাহীর জমিদার, ব্যবসায়ী, ধনাঢ্য ব্যক্তি, উকিল-মোক্তার—এই শ্রেণির মানুষ ব্যাপকভাবে রাজশাহী শহরে বসবাস করতে শুরু করে। তখনকার রাজশাহী, তথা বৃহত্তর বঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জমিদার রানি ভবানীর পরবর্তী বংশধর মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় (১৮৬৮–১৯২৬) থাকতেন নাটোর শহরে। পড়াশোনার জন্য ১৮৭৯ সালে (ফাল্গুন ১২৮৫) ১১ বছর বয়সে তিনি রাজশাহী শহরে আসেন, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষায়তন কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন পঞ্চম শ্রেণিতে। ১৮৮৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হন তিনি। রাজশাহীতে পড়ালেখা করার সময় পাঁচআনি মাঠে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ সাহেবদের ফুটবল, হকি, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলা দেখতেন জগদিন্দ্রনাথ। তখনো বর্তমান রাজশাহী কলেজের সুন্দর সবুজ মাঠটি তৈরি হয়নি। সেখানে ছিল জাদুকুণ্ড নামে একটি বড় দিঘি—১৯২৯-৩০ সালে এটি ভরাট করে মাঠ নির্মাণ করা হয়। ছাত্রজীবনে রাজশাহীতে ক্রিকেট খেলা দেখে এই খেলার প্রতি মনেপ্রাণে আকৃষ্ট হন জগদিন্দ্রনাথ। তবে কেবল আকৃষ্ট হয়েই থেমে থাকেননি, ক্রিকেটকে ঘিরে তাঁর মূল কর্মকাণ্ডই শুরু হলো কলকাতায়।

নাটোর ইলেভেনের প্রধানপুরুষ নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়। ছবি: সংগৃহীত
নাটোর ইলেভেনের প্রধানপুরুষ নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়। ছবি: সংগৃহীত

১৮৯৩ সালে পারিবারিক সিদ্ধান্তে স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন জগদিন্দ্রনাথ। প্রথম দিকে কলকাতার ৪ নম্বর ক্রিকরোডে বসবাস শুরু করলেও পরে ৫০ নম্বর পার্ক স্ট্রিট, ৩৫ নম্বর ওয়েলিংটন স্ট্রিট এবং সব শেষে ১৮৯৬ সালে ল্যান্সডাউন রোডে বাড়ি কিনে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। ১৮৯৯–তে কলকাতার বালিগঞ্জের বুন্দেল রোডে ৪৫ বিঘা বাগানবাড়ি কিনলেন তিনি। এর নামকরণ করলেন ‘নাটোর পার্ক’ নামে। সেখানে একটি ক্রিকেট মাঠ ও বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন নাটোরের এই মহারাজা।

জগদিন্দ্রনাথ সপরিবার কলকাতার বাসিন্দা হওয়ার পর কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামের বিখ্যাত রায় পরিবারের সদস্য সারদারঞ্জন রায়ের (১৮৫৮–১৯২৫) সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। সারদারঞ্জন রায় ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভাই। বলাবাহুল্য, উপেন্দ্রকিশোরের নাম ছিল কামদারঞ্জন।

প্রতিভাধর মানুষ ছিলেন সারদারঞ্জন। তিনি যেমন ছিলেন গণিতশাস্ত্রের অসাধারণ পণ্ডিত, তেমনি সংস্কৃত সাহিত্যের বিখ্যাত বই শকুন্তলা, রঘু, উত্তরচরিত, কিরাত, মুদ্রারাক্ষস, রত্নাবলী ইত্যাদির ব্যাখ্যাকার হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি আলীগড় এমএও কলেজ, ঢাকা কলেজসহ দেশের বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় গণিতের শিক্ষক ছিলেন। হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ। তবে এত কিছুর পরও তাঁর আসল পরিচয় খুঁজলে ক্রিকেটের কথাই আসবে বেশি করে। কারণ, তিনি ছিলেন বাংলার ক্রিকেটের জনক। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি যুবসমাজে মূলত তাঁর আগ্রহ ও প্রচেষ্টাতেই ক্রিকেট খেলার প্রচলন ঘটে। সারদারঞ্জন নিজেও ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেটার। কলকাতা শহরে নিজস্ব খেলার সরঞ্জাম ও পুস্তকের দোকান ছিল তাঁর।

এই রায়দ্বয়—সারদারঞ্জন রায় ও জগদিন্দ্রনাথ রায়—দুজনেই ছিলেন পূর্বপরিচিত। কিন্তু কলকাতায় এসে এই পরিচয় বন্ধুত্বে পরিণত হলো ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে। আগেই বলেছি, রাজশাহীতে পড়াশোনার সময় ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচিত হয়ে এ খেলার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন জগদিন্দ্রনাথ। কলকাতায় এসে সাহিত্যবিষয়ক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তিনি নিজেকে যুক্ত রাখলেও ক্রিকেট বিষয়ে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সারদারঞ্জনের পরামর্শ ও সহযোগিতায়।

ক্রিকেট খেলায় মগ্ন বঙ্গ–ক্রিকেটের জনক সারদারঞ্জন রায়। ছবি: সংগৃহীত
ক্রিকেট খেলায় মগ্ন বঙ্গ–ক্রিকেটের জনক সারদারঞ্জন রায়। ছবি: সংগৃহীত

উনিশ শতকের আশির দশকে কলকাতা শহরে ক্রিকেট খেলায় বেশ প্রসিদ্ধ ছিল টাউন ক্লাব। বাঙালিদের ক্লাব ছিল এটি। কলকাতায় সে সময়কার উল্লেখযোগ্য ক্রিকেট ক্লাবগুলোর মধ্যে ছিল ক্যালকাটা ক্লাব, বালিগঞ্জ ক্লাব, ডালহৌসি ক্লাব, কাস্টমস রেঞ্জার্স প্রভৃতি। প্রথম দিকে সারদারঞ্জন ছিলেন টাউন ক্লাবের সদস্য। তাঁর ছোট ভাই মুক্তিদারঞ্জন ও কুলদারঞ্জন—তাঁরাও টাউন ক্লাবের সদস্য হয়ে নিয়মিত ক্রিকেট খেলতেন। তো সারদারঞ্জনের পরামর্শে টাউন ক্লাবের সদস্য হলেন জগদিন্দ্রনাথ। একপর্যায়ে ক্লাবটির সভাপতির পদ অলংকৃত করলেন তিনি। টাউন ক্লাবের উন্নতির জন্য জগদিন্দ্রনাথ, সারদারঞ্জন ও তখনকার আরেকজন ক্রিকেটবোদ্ধা চারুচন্দ্র মিত্রের সাহচর্য ও পরামর্শে মনেপ্রাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। বিশেষ করে সারদারঞ্জনের সঙ্গে পরামর্শ করে ক্লাবের খেলোয়াড়দের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য একজন পেশাদার প্রশিক্ষক (কোচ) নিয়োগ করা জরুরি মনে করলেন জগদিন্দ্রনাথ। এ জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা ভাবলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। এ সময় কিছু বিষয় নিয়ে জগদিন্দ্রনাথের সঙ্গে টাউন ক্লাব কর্তৃপক্ষের মতপার্থক্য ঘটে। জগদিন্দ্রনাথ রায় তাঁর ক্রীড়াক্ষেত্রের অন্যতম প্রধান পরামর্শদাতা—যাঁকে তিনি সর্বদাই ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতেন—সেই সারদারঞ্জন রায়সহ তাঁর অন্য দুই ছোট ভাই মুক্তিদারঞ্জন ও কুলদারঞ্জনকে নিয়ে টাউন ক্লাব ছেড়ে চলে গেলেন। এ পর্যায়ে তাঁর বালিগঞ্জের বিশাল বাগানবাড়ির চত্বরে চলতে থাকল ক্রিকেট প্র্যাকটিস এবং মাঝেমধ্যে ম্যাচের আয়োজন।

এ সময় রাজশাহীর কমিশনার রাজশাহী শহরে ক্রিকেট, ফুটবল ও পোলো খেলার একটি টুর্নামেন্টের আয়োজন করে আমন্ত্রণ জানালেন জগদিন্দ্রনাথকে। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কলকাতায় একটি শক্তিশালী ক্রিকেট ও ফুটবল দল গঠন করলেন নাটোরের মহারাজা। তাঁর নেতৃত্বে রাজশাহীতে এসে টুর্নামেন্টে অংশ নিল উভয় দল। ফুটবলের পাশাপাশি রাজশাহী কলেজের শক্তিশালী ক্রিকেট দলকে হারালো মহারাজার ক্রিকেট টিম। বিজয়ীর বেশে কলকাতায় ফিরে এলেন তাঁরা। এই বিজয় ছিল জগদিন্দ্রনাথের খেলোয়াড়ি জীবনের একটি মাইলফলক। এখান থেকেই একটি শক্তিশালী ক্রিকেট দল গঠনের চিন্তা তিনি শুরু করলেন গভীরভাবে।

অবশেষে তৈরি হলো দল। এ ক্রিকেট দলের একজন উপযুক্ত ও পেশাদার প্রশিক্ষক পেতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হলো। নির্দিষ্ট দিনে মহারাজার বালিগঞ্জের বাগানে কয়েকজন প্রার্থী এসে উপস্থিত। জগদিন্দ্রনাথ সারদারঞ্জনকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘স্যার, প্রার্থী উপস্থিত, পরীক্ষা করুন।’ পরীক্ষার পর মনোনীত হলেন একজন প্রার্থী—তখনকার বোম্বে থেকে আসা পারসি খেলোয়াড় মেহতা।

সমসাময়িককালে কলকাতায় যে কয়েকটি ক্রিকেট দল ছিল, সেখানে দেশি ক্রিকেটার থাকলেও বিদেশি খেলোয়াড়দের প্রাধান্য ছিল বেশি। এই বাস্তবতায় নিজেদের দল গঠনের সময় জগদিন্দ্রনাথ চাইলেন এক শ ভাগ দেশি খেলোয়াড়দের নিয়ে এমন একটি টিম গড়তে, ইউরোপের শক্তিশালী দলগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও যারা জয়ী হতে সক্ষম। সারদারঞ্জনের সঙ্গে পরামর্শের পর জগদিন্দ্রনাথ ঠিক করলেন, বোম্বেসহ ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে দক্ষতাসম্পন্ন ভালো ভালো ক্রিকেটার আনবেন। তাঁর দলে তখন সারদারঞ্জন ও তাঁর অন্য দুই ছোট ভাইসহ আরও কয়েকজন দক্ষ বাঙালি ক্রিকেটার রয়েছেন। এরপর শক্তিশালী ক্রিকেট দল গঠনের জন্য অবশিষ্ট যে কয়েকজন খেলোয়াড় আনা হলো, তার অধিকাংশই এল বোম্বে থেকে। বোম্বের বিখ্যাত ক্লাব হিন্দু জিমখানার সভাপতি ছিলেন জগদিন্দ্রনাথের বন্ধু। অতএব ক্রিকেট দল গঠনে তাঁকে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। এভাবেই ১৯০১ সালে জগদিন্দ্রনাথ রায়ের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কলকাতার বালিগঞ্জের নাটোর পার্কে প্রতিষ্ঠা পেল ‘নাটোর ইলেভেন’ নামে বাঙালিদের একটি ক্রিকেট দল। দলটি ‘নাটোর টিম’ নামেও পরিচিতি পেয়েছিল।

এর মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার টাকা ব্যায়ে নাটোর পার্ককে সুন্দর ক্রিকেট মাঠে পরিণত করেছেন মহারাজা। অতিরিক্ত কয়েক হাজার টাকা খরচায় ক্রিকেট গ্রাউন্ডের পাশে নির্মাণ করেছেন সুন্দর একটি প্যাভিলিয়নও।

এ সবকিছু দেখে মনে হয়, জগদিন্দ্রনাথের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল বাংলার ক্রিকেটকে উন্নত মানে নিয়ে যাওয়া। এ জন্য ১৯০১ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রতিটি ক্রিকেট মৌসুমে কলকাতা শহরের ব্রিটিশ সাহেবদের বিভিন্ন ক্রিকেট দলের সঙ্গে নিয়মিত ম্যাচ খেলার আয়োজন করতেন তিনি। এ ছাড়া স্থানীয় বাঙালি ক্লাবের সঙ্গে খেলা হতো দুটি করে ম্যাচ। কলকাতার বাইরে ভারতের অন্যান্য জায়গাতেও অনেকগুলো খেলায় অংশ নিয়েছিল নাটোর টিম। তখন ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বিখ্যাত ক্রিকেট দলগুলোর সঙ্গেও নাটোর ইলেভেনের খেলা শুরু হয়। এদের মধ্যে ছিল, পাতিয়ালার মহারাজার ক্রিকেট দল, জামনগরের বিখ্যাত রঞ্জিত সিংয়ের ক্রিকেট দল, কোচবিহারের মহারাজার ক্রিকেট দলসহ রাজস্থানের যোধপুর দল, কাশ্মীর (শ্রীনগর) দল, কলম্বো টিম, রেঙ্গুন টিম প্রভৃতি। এই শক্তিশালী ক্রিকেট দলগুলোর সঙ্গে নাটোর ইলেভেনের খেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাটোর টিম বিজয়ী হতে থাকে। এভাবে ১৯০১ থেকে শুরু করে ১৯১৪ সালের মধ্যে নাটোর টিম ভারতবর্ষে একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিকেট দল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। সে সময় বঙ্গের লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিজের গভর্নর হাউসে জগদিন্দ্রনাথকে নিমন্ত্রণ করে তাঁর সঙ্গে নাটোর ইলেভেন নিয়ে আলাপ–সালাপ করতেন বলেও জানা যায়।

ক্রিকেট অনুরাগী হলেও ক্রিকেট ভালো খেলতে পারতেন না জগদিন্দ্রনাথ। তিনি সুঠাম দেহের অধিকারী হলেও শৈশবেই তাঁর একটি চোখ দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে। ফলে ক্রিকেট খেলা ছিল তাঁর জন্য দুরূহ। তবে বরাবরই নাটোর টিমের দলপতির (ক্যাপ্টেন) ভূমিকা পালন করতেন জগদিন্দ্রনাথ। দলপতি হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ। নাটোর ইলেভেনে সেকালে যেসব বিখ্যাত ক্রিকেটারের সমাবেশ ঘটেছিল, তাঁরা হলেন সারদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, বালু, বিথাল, শিবরাম, অগাধশংকর, ওয়ার্ডেন, শেষাচারি, রাজ্জাক, আজিজ, রঙ্গলাল, মিস্ত্রী, স্যাম্পর, পুরুষোত্তম, সালামুদ্দীন, বাকু, রাজু, হিমু ও মনু। তাঁদের মধ্যে মনু ছিলেন জগদিন্দ্রনাথের একমাত্র ছেলে। তিনি ছিলেন নাটোর টিমের একজন নিপুণ ব্যাটসম্যান। এই দলের বিখ্যাত বোলার ছিলেন বালু, ওয়ার্ডেন, স্যাম্পর, মিস্ত্রী, পুরুষোত্তম, সালামুদ্দিন, অগাধশংকর প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে বালু ছিলেন আবার ভারতের বিখ্যাত বাঁহাতি বোলার। এই টিমের বিখ্যাত ব্যাটসম্যানদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাজ্জাক, বাকু, রঙ্গলাল, মনু ও কুলদারঞ্জন।

নাটোর ইলেভেন গঠনের শুরুতেই ভারতবর্ষের সেরা বোলারদের নিজ দলে প্রাধান্য দিয়েছিলেন মহারাজা। এর প্রধান উদ্দেশ্য একটিই—বালু, ওয়ার্ডেন বা সালামুদ্দিনের মতো প্রসিদ্ধ বোলারের বিরুদ্ধে খেলতে খেলতে স্থানীয় বাঙালি ব্যাটসম্যানরা যেন দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠেন। হয়েছিলও তা-ই। নাটোর ইলেভেনের বিখ্যাত ব্যাটসম্যান কুলদারঞ্জন রায়ের স্মৃতিমূলক রচনা থেকে উদ্ধৃত করা যাক: ‘আমার নিজের অবস্থা দিয়াই বলিতেছি, টাউন ক্লাবে যখন ছিলাম, তখন কোনো ম্যাচে দশ রান করিতে পারিলেই ভাবিতাম খুব খেলিয়াছি, Double figure হইয়াছে। অবশ্য একবার ক্যালকাটা ক্লাবের সঙ্গে খেলায় পঞ্চাশ রানও করিয়াছিলাম, সেদিন মহারাজা খেলায় উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং আমার মনে ধারণা ছিল যে আমি খেলোয়াড় “কেউকেটা” নই। কিন্তু সেই আমি প্রথম যেদিন বালুর bowling-এ প্র্যাকটিস করি, সেদিন আমার bat-এর সঙ্গে ball-এর কোনো সম্পর্কই হইল না। যখন চক্ষু খুলিল, বুঝিতে পারিলাম, এত দিন শুধু ছেলে খেলাই খেলিয়াছি, প্রকৃত ক্রিকেট খেলি নাই। ক্রমে মহারাজের শিক্ষাগুণে এবং ভাল bowling-এ প্র্যাকটিস করিবার দরুণ অনেক উন্নতি লাভ করিয়াছিলাম। তখন ম্যাচে ৫০/৬০ রান করিয়া out হইলেও তৃপ্তি হইত না, একশত run (century) করিতে পারিলাম না বলিয়া দুঃখ হইত।’

মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ নাটোর ইলেভেনের সার্বিক উন্নতিকল্পে কেবল বোলিং ও ব্যাটিংয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তা নয়; এই দলকে সে সময় ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে দলের প্রত্যেক ক্রিকেটারকে নিয়মিত ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করাতেন তিনি। তিনি নিজেই ছিলেন নাটোর টিমের শিক্ষাগুরু। পেশাদার প্রশিক্ষক নিয়োগ করে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তো রেখেছিলেনই, দলের ক্রিকেটারদের উন্নতির জন্য করেছিলেন আরও নানা কৌশল। যেমন প্রতিদিন তিনি প্রথমেই নেট প্র্যাকটিস শুরু করতেন। এরপর বসতেন নেটের পেছনে। একে একে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের বোলিং ও ব্যাটিং নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। খেলোয়াড়দের ভুলত্রুটি খেয়াল করে প্রশিক্ষকের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। এরপর তাৎক্ষণিকভাবে খেলোয়াড়দের ভুলগুলো সংশোধনও করে দিতেন। প্রত্যেক ক্রিকেটারকে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে বাধ্যতামূলক ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করানো হতো।

১৯০৭ সালে নাটোর ইলেভেন একাদশের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত
১৯০৭ সালে নাটোর ইলেভেন একাদশের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

দলের উত্তরণের জন্য ছিল আরও কিছু বিষয়–আশয়—প্রতিটি ম্যাচ শেষে বালিগঞ্জের রাজবাড়িতে দলের সভা হতো। ম্যাচে যেসব ভুল হতো, জগদিন্দ্রনাথ সেগুলো উল্লেখ করে সংশোধন করে দিতেন। যেসব খেলোয়াড় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ম্যাচে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিতেন, তাঁরা পুরস্কৃত হতেন। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভালো খেলোয়াড়দের সোনার ঘড়ি ও চেইন, হিরের আংটি ইত্যাদি পুরস্কার দিতেন জগদিন্দ্রনাথ। মাঝেমধ্যে খেলোয়াড়দের দেওয়া হতো নগদ অর্থও। একজন ক্রিকেটারের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি হবেন বিনয়ী ও শৃঙ্খলাবোধসম্পন্ন রুচিশীল মানুষ—নাটোর ইলেভেনের ‘ক্যাপ্টেন’ জগদিন্দ্রনাথ রায় তাঁর দলে এ-জাতীয় শৃঙ্খলাবোধ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নামীদামি খেলোয়াড়দের চেয়ে তিনি দল ও দলের ঐক্যের প্রতিই সব সময় দৃষ্টি দিয়েছেন। তাই উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়েছে নাটোর পার্কের নাটোর ইলেভেন।

বিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের জামনগরে একটি বিখ্যাত ক্রিকেট দল ছিল। এই টিমের দলনেতা ছিলেন তখনকার ‘ক্রিকেট সম্রাট’—যাঁর নামে হয়েছে রঞ্জি ট্রফির নামকরণ—সেই রঞ্জিত সিং। একবার তিনিও তাঁর দল নিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়; নাটোর ইলেভেনের সঙ্গে ম্যাচ খেলতে। সে সময় এই দলের অনেক প্রশংসাও করেছিলেন তিনি।

বাংলার ক্রিকেটের কীর্তিমান পুরুষ নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ। সারদারঞ্জন রায় ছিলেন বঙ্গ–ক্রিকেটের জনক আর জগদিন্দ্রনাথ রায় ছিলেন অবিভক্ত ভারতের প্রথম বাঙালি ক্রিকেট সংগঠক। বিশ শতকের শুরুতে এই দুই স্বপ্নদ্রষ্টার আন্তরিক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল বাঙালির ক্রিকেট দল—নাটোর ইলেভেন। আজ মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিশ্ব ক্রিকেটে অঙ্গনে সুনাম কুড়াচ্ছে এক বর্ণাঢ্য ঐতিহ্যের সার্থক উত্তরাধিকারী হয়েই।

তথ্য সূত্র:

১. মানসী ও মর্মবাণী, মাঘ ১৩৩২ বঙ্গাব্দ,
পৃ. ৬১০-৬২৬।

২. ‘জগদিন্দ্র জীবনপঞ্জী’, শ্রীরামকান্ত ভট্টাচার্য, মানসী ও মর্মবাণী, শ্রাবণ, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৫২৭।

৩. মহারাজা জগন্দ্রিনাথ রায়, ফজলুল হক, বাংলা একাডেমি ঢাকা, ১৯৯২।

৪. নাটোর মহকুমা সম্মিলনী ১৯৮১, পৃ. ৬১-৭৫।

৫. শহর রাজশাহীর আদিপর্ব, মাহবুব সিদ্দিকী, নবরাগ প্রকাশনী, ঢাকা, পৃ. ১৪১-১৪৬।