কলকাতার ব্রিগেড সমাবেশ: পাটিগণিত বনাম রসায়নের লড়াই শুরু

কলকাতায় বিজেপিবিরোধী সমাবেশে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের নেতারা। ছবি: ভাস্কর মুখার্জী
কলকাতায় বিজেপিবিরোধী সমাবেশে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের নেতারা। ছবি: ভাস্কর মুখার্জী

কলকাতায় বিপুল ব্রিগেড সমাবেশ দুটো বড় প্রশ্নের মীমাংসা আপাতত করে দিল। প্রথমটি, এবারের লোকসভা ভোট বিজেপির পক্ষে মোটেই ‘কেক ওয়াক’ হতে যাচ্ছে না। জিততে হলে বিজেপিকে রীতিমতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে। তাও সেই জয় যে গেলবারের মতো ‘নিরঙ্কুশ’ হবে, অতি বড় আশাবাদীও বুক ঠুকে তা বলতে পারছে না।

দ্বিতীয় বিষয়টি আরও স্পষ্ট। অধিকাংশ রাজ্যেই বিরোধীরা এই ভোটটা লড়তে চায় মোটামুটি ‘একের বিরুদ্ধে এক’ প্রার্থী খাড়া করে। ব্রিগেড সমাবেশ থেকে বিরোধীরা এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে। ছোট–বড় মোট ২৩টি দলের নেতারা মঞ্চে উপস্থিত থেকেছেন। মাত্র দুটি রাজ্যের শাসক দল এই সমাবেশে যোগ দেয়নি—ওডিশা ও তেলেঙ্গানা। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, বিজেপিবিরোধী লড়াই তার তীব্রতা হারাল।

লড়াই যে ক্ষুরধার এবং সেই লড়াইয়ের অভিমুখ যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘একনায়কতন্ত্র’–এর বিরুদ্ধে, সমাবেশে যোগ দেওয়া প্রায় প্রত্যেক নেতাই সে কথা জানিয়ে দিয়েছেন। প্রত্যেকের অভিযোগের তির মোদির দিকেই ধাবিত। প্রত্যেকের বক্তব্যেই এই কথাটি বড় হয়ে উঠেছে, মোদিই যত নষ্টের গোড়া। অতএব, সেই মোদিকে হারাতে হবে। লক্ষণীয়, ব্রিগেডের সুর যতটা ‘অ্যান্টি–মোদি’, ততটা ‘অ্যান্টি–বিজেপি’ কিন্তু ছিল না। থাকলে এখনো বিজেপিতে টিকে থাকা শত্রুঘ্ন সিনহা সমাবেশে আমন্ত্রণ পেতেন না। যশোবন্ত সিনহা বিজেপি-সঙ্গ নিজেই ছেড়ে দিয়েছেন। ছেড়েছেন অরুণ শৌরিও। কিন্তু শত্রুঘ্ন সিনহা এখনো বিজেপির সদস্য।

এই সমাবেশ সবদিক দিয়েই ছিল মমতা ব্যানার্জির ‘শো’। তিনিই উদ্যোক্তা। দুই মাস আগেই তিনি এই সমাবেশের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর এই ডাকে সুর মেলায়নি তাঁরই রাজ্যের দুই বিরোধী শক্তি—কংগ্রেস ও বামপন্থীরা। কিন্তু এই গরহাজিরার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে এটা প্রমাণিত হয় না যে এই দুই শক্তি বিজেপিপন্থী। সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপিবিরোধী জোট গড়তে কংগ্রেসের নেতৃত্বদান নিয়ে মমতার যত আড়ষ্টতাই থাকুক না কেন, কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী কিন্তু তাকে আমল দেননি। বরং সমাবেশের প্রাক্কালে ব্যক্তিগতভাবে ‘মমতাদি’কে রাহুল চিঠি লিখেছেন। লোকসভায় দলের নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের সাহচর্যে রাজ্যসভায় নির্বাচিত দলীয় মুখপাত্র অভিষেক মনু সিংভিকে সমাবেশেও পাঠিয়েছেন। রাহুল বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর কাছে বিজেপি হটাও প্রথম ও একমাত্র ‘প্রায়োরিটি’। বাকি প্রশ্নের মীমাংসা পরে।

কলকাতায় বিজেপিবিরোধী সমাবেশে জনতার ঢল। ছবি: ভাস্কর মুখার্জী
কলকাতায় বিজেপিবিরোধী সমাবেশে জনতার ঢল। ছবি: ভাস্কর মুখার্জী

বস্তুত, ‘মোদি হটাও’ সুরটাই শনিবাসরীয় ব্রিগেডে সারাক্ষণ গমগম করে বেজেছে। সেই সুরের আলাপ ও বিস্তারে ‘মোদিবিরোধিতার’ প্রাবল্য থাকলেও বিস্ময়ের কথা, বিজেপিবিরোধিতা সেভাবে কিন্তু ছিল না। বরং মমতার ভাষণে কোথাও যেন ‘মোদি খারাপ, বিজেপি ততটা নয়’ গোছের একটা সুর রিনরিন করে বেজেছে। অনেকটা সেই ‘ভালো তালেবান, খারাপ তালেবান’ পার্থক্য টানার মতো। তাই যদি না হবে, মমতা কেন তাহলে তাঁর ভাষণে বিজেপির অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠী বিন্যাসকে তুলে ধরবেন? কেনইবা তিনি দল ও সরকারে রাজনাথ সিং, নিতিন গড়কড়ি, সুষমা স্বরাজদের সম্মান না-পাওয়ার প্রসঙ্গটির অবতারণা করবেন? মমতা কি এর মধ্য দিয়ে এই বার্তাই পৌঁছে দিতে চাইলেন, ভবিষ্যতে বিজেপি প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তন করতে চাইলে মোদিকে বাদ দিয়ে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ সম্ভব? প্রশ্নটি আপাতত ঊহ্য রইল।

বিরোধীদের মাছের চোখ যে তিনিই, নরেন্দ্র মোদি তা বিলক্ষণ বুঝেছেন। শনিবারে ব্রিগেড যখন গমগম করছে, মোদি তখন দিউ ও দমনে এক জনসভায় তাঁর বিরোধীদের আক্রমণের মোকাবিলায় সচেষ্ট। সেই জনসভায় নিজেকে তিনি একমাত্র ‘সৎ ও স্বচ্ছ’ রাজনীতিক হিসেবে তুলে ধরেছেন। বিরোধীদের ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘ওরা সবাই হাত ধরাধরি করে’ বাঁচতে চাইছে। বলেছেন, ‘সবকা ভালা’ করার জন্য দেশের স্বার্থে তাঁর আরও একবার ক্ষমতায় আসা জরুরি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: রয়টার্স
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: রয়টার্স

মোদির সাম্প্রতিক প্রচার অবশ্যই পাঁচ বছর আগের মতো তীক্ষ্ণ নয়। তাঁর ধার, ভার ও ওজন অনেকটাই কমে গেছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দাবিও জোলো হয়ে গেছে নোটবন্দীর সিদ্ধান্তে। সুপ্রিম কোর্টের রায় সত্ত্বেও রাফাল বিতর্ক বড় করে তুলে ধরেছে বহু গুরুতর প্রশ্ন। এই বিষয়ে সংসদকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও তুলে দিয়েছে অনেক অপ্রিয় প্রশ্ন, যেগুলোর গ্রহণযোগ্য উত্তর মোদি আজও দিতে পারেননি। গতবার ভোটের আগে দেশের শিক্ষিত যুব সম্প্রদায় তাঁকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেছিল। আশার ফানুস উড়িয়েছিল। আজ সেই যুব সম্প্রদায়ের চোখে তিনি আর মোটেই ‘মসিহ’ নন। বরং ‘চাকরিহীন প্রবৃদ্ধির’ দরুন অপরাধী। বিরোধীদের ক্রমাগত প্রচারে তিনি আজ ‘জুমলাবাজ’ ও ‘কাগুজে বাঘ’। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। দিল্লির প্রথম শ্রেণির এক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত কলেজ পাঁচ বছর আগে বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করে নিয়ে এসেছিল নরেন্দ্র মোদিকে। সেই কলেজ এই সেদিন সম্মান জানাল মোদি দ্বারা অসম্মানিত ও অপসারিত সিবিআইয়ের মহাপরিচালক অলোক নাথকে। ভাগ্য ও রাজনীতির চাকা এভাবেই ঘোরে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও এবারের ভোটে সবচেয়ে উঁচু মাথার মালিক নরেন্দ্র মোদি। তালগাছের মতো সব মাথা ছাড়িয়ে আকাশে উঁকি মারছে তাঁর মাথাই। বিজেপির একমাত্র তুরুপের তাসও তিনিই। এবারের নির্বাচনকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ঢঙে ‘প্রেসিডেনশিয়াল’ ভোটে পরিণত করতে চাইছেন। জোট-পাটিগণিত অবশ্যই তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু রসায়নও যে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবে, জোর দিয়ে এখনই তা বলা যাচ্ছে না। ব্রিগেড সমাবেশ রাজনৈতিক সমীকরণ ও মেরুকরণের ইঙ্গিত দিয়েছে মাত্র। আগামী দিনে সেটাই নরেন্দ্র মোদির প্রধান চ্যালেঞ্জ।