চীনের বিস্ময়কর উত্থান

যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় দেড় শ বছরের একচ্ছত্র আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শেষ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি আদায় করে নিল চীন। এটি সামরিক শক্তির নয়, অর্থনীতির। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে চীন এখন অর্থনৈতিক শক্তিতে বিশ্বের এক নম্বর দেশ। অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের এ উত্তরণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে বিশ্বজুড়ে। পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সামনে চীন আজ সমৃদ্ধি আর উন্নয়নের মডেল।
আইএমএফের সাম্প্রতিক জরিপে চীনের অর্থনীতি বিশ্লে­ষণ করে আরও বলা হয়েছে, ১৮৭২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রই ছিল বিশ্বসেরা অর্থনীতি। এতকাল পরে এসে চীন অদ্যম শক্তিতে সেই শীর্ষস্থান দখল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেলে দিয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। সংস্থার জরিপে আরও দেখানো হয়েছে, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের পর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ভারত। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে জাপান, পঞ্চমে জার্মানি, এর পরেই রয়েছে রাশিয়া, ব্রাজিল, ফ্রান্স ও ইন্দোনেশিয়া। আর সেরা দশে শেষ নামটি যুক্তরাজ্য।
আইএমএফের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সদ্য অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের বর্তমান অর্থনীতির আকার আর্থিক মূল্যে ১৭ দশমিক ৬১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে শীর্ষস্থানচ্যুত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আকার ১৭ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এদিকে ১৭ দশমিক ৬১ ট্রিলিয়ন ডলারেই চীনের অর্থনীতির উল্লম্ফন থেমে নেই। সংস্থার পূর্বাভাস হচ্ছে, ২০১৯ সাল নাগাদ চীনের অর্থনীতির আকার ২৬ দশমিক ৯৮ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে, যা হবে ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আকারের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হলেও ৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি থেকে একটা দীর্ঘ সময় ধরে প্রবৃদ্ধি বার্ষিক ১১ থেকে ১৩ বা তারও বেশি শতাংশ অব্যাহত রয়। চীন হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ রপ্তানিকারক দেশ। বিগত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা চলাকালে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ চীন ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের অনেক দেশকে বিশাল অর্থনীতির ধস থেকে উদ্ধার করেছে।
১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ চীনে রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শ্রমশক্তি। চীনের রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাস্টিন লিন ২০১১ সালে বলেন, ২০১০ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত চীন ২০৩০ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে, যদি বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে। স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক তার ২০১১ সালের এক প্রতিবেদনে মত প্রকাশ করে যে চীন ২০২০ সালের মধ্যেই বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে। অ্যাঙ্গাস ম্যাডিসন প্রণীত ২০০৭ সালের একটি ওইসিডির প্রতিবেদনের হিসাব অনুযায়ী, চীন যদি তার দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় কিছুটা সমতা আনতে পারে, তাহলে ২০১৫ সালের মধ্যে দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেমস উলফেনসনের ২০১০ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের সর্বমোট মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের দুই-তৃতীয়াংশই হবে চীনের অধিবাসী।
২০২১ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) তার শতবর্ষপূর্তি পালন করবে। চীন তার কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক অবস্থান বিশ্ব বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণীর উল্লি­খিত সময়ের বহু আগেই অর্জন করে সবাইকে একরকম তাক লাগিয়ে দিয়েছে। পার্টিপ্রধান শি নেতৃত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন। তিনি পার্টির শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন এবং দলে শক্ত শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করেন, বিভিন্ন অঞ্চল ও মানুষের মধ্যে আয়ের অসমতা দূর করার অঙ্গীকার করেন এবং শহর ও গ্রামাঞ্চল, উন্নত ও অনুন্নত এলাকা এবং ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে তৎপর হন।
চীনের বর্তমান নেতৃত্ব অর্থনীতিকে আরও সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চীন তার বিশাল অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখছে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর মধ্য দিয়ে। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় চীন রপ্তানি বাজার সংকুচিত করে সুবিশাল এশিয়া মহাদেশের উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বাণিজ্য প্রসারে প্রয়াস নিয়েছে। দেশটি তার মুদ্রা ইউয়ানকে আন্তর্জাতিকভাবে বিনিয়োগযোগ্য মুদ্রায় রূপান্তরিত করার ব্যবস্থা করেছে। ইউয়ান ইতিমধ্যে একটি আঞ্চলিক অর্থব্যবস্থার অংশ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের আদলে ব্রিকস চীন একটি এশীয় ব্যাংক করার উদ্যোগ নিয়েছে, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে এর সদস্যপদ লাভে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
চীন, রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট। চীন একে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই জোটে অচিরেই ভারত যোগ দেবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে আসিয়ান হবে অন্যতম খুঁটিস্বরূপ। আসিয়ান ডলার ব্লক। চীন এটাকে ইউয়ান ব্লকে রূপান্তর করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ঐতিহ্যগতভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আসিয়ানের অর্থনৈতিক জোট বাঁধার প্রবণতা রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতসহ সার্কভুক্ত সব কটি দেশের সঙ্গে চীনের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। চীন দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী। চীনের প্রেসিডেন্ট ভারতসহ কয়েকটি দেশে সফর করেছেন। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ গোটা এশিয়া মহাদেশকে একটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির মহাদেশ হিসেবে পরিণত করতে চায় চীন। আর এসবই সে করতে চায় শান্তিপূর্ণ উপায়ের মাধ্যমে। চীন সব দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও অন্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে।
বর্তমান বিশ্বে চারদিকে অস্থিরত ও যুদ্ধের দামামা। দেশে দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংঘাত, সন্ত্রাসবাদ, জাতি-গোষ্ঠীর ঘৃণা, হানাহানি। আরও আছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও রোগব্যাধি। শান্তি এখনো সুদূরপরাহত। স্থিতিশীলতা বিশ্বজুড়ে নানাভাবে বিঘ্নিত। সমতা ও ন্যায়বিচারের অভাব প্রকট। বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর এক-পঞ্চমাংশ রয়েছে চীনে। দেশটি নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছে এবং অবশ্যই ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সাধনে অনেক দীর্ঘ পথ এগিয়ে গেছে। চীন জনগণের দারিদ্র্য বিমোচন করেছে। তাদের জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং মানবজাতির উন্নয়ন ও প্রগতির ক্ষেত্রে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
আজ চীন বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষে দাঁড়িয়ে। বোধগম্য কারণেই চীনের প্রতি বিশ্বের মনোযোগ বাড়ছে। বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, চীনের বর্তমান নেতৃত্ব চীনকে শান্তি, অগ্রগতি ও মর্যাদার আরও নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে এবং এশীয় অঞ্চলে ও সাধারণভাবে গোটা বিশ্বকে আরও শান্তিময়, সম্প্রীতিময় ও বাসযোগ্য করে গড়ে তোলায় প্রভূত অবদান রাখবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তিনটি পৃথক অনুষ্ঠানে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। শান্ত, সৌম্য, স্থিতধী, অত্যন্ত সংবেদনশীল এক মহান ব্যক্তিত্ব শি জিনপিং। মুখে তাঁর সর্বদা লেগে থাকে প্রীতিময় মৃদু হাসি এবং উষ্ণ আন্তরিকতার ঔজ্জ্বল্য। আমি তাঁর মধ্যে দেখেছি সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌ এনলাইয়ের প্রতিচ্ছবি। চীনের জয়রথ অব্যাহত থাক, আরও বেগবান হোক। সাফল্যের নব নব দিগন্ত উন্মোচিত হোক।
লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান: সাবেক সেনাপ্রধান।