ভাষা আন্দোলনে প্রথম গুলিবর্ষণ

কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় যশোরে গুলিবর্ষণের খবর, ১৫ মার্চ ১৯৪৮
কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় যশোরে গুলিবর্ষণের খবর, ১৫ মার্চ ১৯৪৮

ডেটলাইন: যশোর, ১৩ মার্চ ১৯৪৮

২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮। পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজিকে গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করা হলো। গণপরিষদে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেগণপরিষদেরভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করলেন। পাকিস্তান গণপরিষদে তাঁর প্রস্তাব অগ্রাহ্য হলে পূর্ব বাংলায় শুরু হলো প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। এর পরম্পরায় ২৭ ফেব্রুয়ারি এক সভায় গঠিত হলো ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। সভায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে ১১ মার্চ বৃহস্পতিবার সারা দেশে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

যশোরের ছাত্ররা মার্চ মাসের শুরু থেকেই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আহূত হরতালের প্রস্তুতি নিতে থাকে। স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের একাংশ ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। ওদিকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকা ১১ মার্চের হরতাল প্রতিহত করতে জেলা প্রশাসন যশোরে জারি করে ১৪৪ ধারা। ১১ মার্চ কোনো অঘটন ছাড়াই যশোরের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের ছাত্ররা পালন করে হরতাল। ১৪৪ ধারা ভেঙে বের হয় মিছিল। কলকাতা থেকে প্রকাশিত যুগান্তর-এর ১৫ মার্চ সংখ্যার ভাষ্য:

১১ই মার্চ্চ মশ্লিম ছাত্রদের নেতৃত্বে শহরের ছাত্ররা হরতাল প্রতিপালন করে একটি শোভাযাত্রা বাহির করে এবং শেষ পর্যন্ত একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সরকার এই প্রকার সভা নিষিদ্ধ করিয়া আদেশ জারী করেন। পুলিশ ৪ জন হিন্দুসহ [আনন্দবাজার পত্রিকায় উল্লেখ ছিল ৩ জন হিন্দু] ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করে।

১২ মার্চ। যশোর শহরের স্কুল ও কলেজের ছাত্ররা আগের দিনে গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে কোনো বাধাবিপত্তি ছাড়াই পালন করে হরতাল। মিছিলও বের করে তারা। ১৩ মার্চ বন্দীদের মুক্তির দাবিতে আবারও মিছিল করে ছাত্ররা। এদিন আন্দোলনরত ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় পুলিশের। ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এই প্রথম ঘটল গুলিবর্ষণের ঘটনা। এ ঘটনা স্থান পায় বিভিন্ন পত্রিকায়। ১৫ মার্চের আজাদ-এ লেখা হয়:

আজ [১৩ই মার্চ] প্রায় বেলা ১০টার সময় বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা ও ধৃতবন্দী নেতাদের মুক্তি দাবীতে যশোর শহরের স্কুল কলেজে ধর্মঘট করিয়া ছাত্র-ছাত্রী মিছিল করিয়া ১৪৪ ধারা সত্ত্বেও রাস্তায় বাহির হইয়া পড়ে। তাহারা মিছিলের সঙ্গে ‘আজাদ পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ‘আমাদের দাবী মানতে হবে’ ‘নেতাদের মুক্তি চাই’ ‘বাঙলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা চাই’ ‘পুলিশ জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি ধ্বনি করিয়া মিছিলটী ধীরে ধীরে কোর্টের দিকে লইয়া যাইতে থাকে। কিন্তু পুলিশে বাধা দেয়। পুলিশের লাঠি চালনায় কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী আহত হইয়াছে। গ্রেপ্তারের সংখ্যা অনুমান ১৫০ জন।

এ ঘটনার পরের অংশটি পাওয়া যায় যুগান্তর-এর ১৮ মার্চের সংখ্যায়:

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ১৩ই মার্চ যশোহর সহরে যে আন্দোলন হয়, জেলা কর্তৃপক্ষ কিভাবে তাহা দমন করেন সে সম্পর্কে উদ্বেগজনক বিবরণ এখন পাওয়া গিয়াছে। [...] ১৩ই তারিখে আরও অধিকসংখ্যক ছাত্র এক শোভাযাত্রা করিয়া মহকুমা হাকিমের আদালতে উপস্থিত হয় এবং ১১ই তারিখে ধৃত ছাত্রদের মুক্তি দাবী করে। পুলিশ ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ্জ করে এবং প্রকাশ যে, প্রতিশোধস্বরূপ কিছু ছাত্রও পুলিশের উপর ইষ্টক বর্ষণ করে। তখন পুলিশ উন্মত্ত হইয়া বেপরোয়াভাবে গুলীবর্ষণ করিতে থাকে। পাঁচ রাউন্ড গুলীবর্ষণ করা হয় কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ গুলীবর্ষণের ফলে কেহ আহত হয় নাই।

অতঃপর পুলিশ সহরের নাগরিকদের উপর বালক-বৃদ্ধ-নির্বিশেষে চড়াও হইয়া মারিতে থাকে। দশ বৎসরের অনধিক বয়স্ক বালক এবং ৬০ বৎসরেরও অধিক বয়স্ক বৃদ্ধকে গুরুতরভাবে আঘাত করা হয়। প্রায় ২০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ধৃত ব্যক্তিদের অধিকাংশই মুসলমান।

আবার এ নিয়ে ১৭ মার্চের আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন:

শেষ পর্যন্ত ৭০ জন ছাত্রকে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। উহাদের প্রায় অর্ধেকই হিন্দু—যদিও তাহারা আন্দোলনে কিছু মাত্র যোগ দেয় নাই।

যশোরে ১৩ মার্চ যে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে, সেই ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত করা হয়। যশোর জেলার তৎকালীন সদর এসডিও এস এ চৌধুরী এই তদন্তকর্ম পরিচালনা করেন। তিনি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন ১৬ এপ্রিল। তাঁর উদ্‌ঘাটিত তথ্যগুলোর সারমর্ম ছিল: ১৩ মার্চ বন্দীদের মুক্তির দাবিতে যশোর কলেজ থেকে ছাত্রদের একটি বড় মিছিল শহর প্রদক্ষিণ শেষে এসডিও মুজতবার অফিসের সামনে সমাবেশ করে। সমাবেশের কারণে আদালতের কাজে বিঘ্ন ঘটে। ছাত্রদের শান্ত করার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সমাবেশ ধীরে ধীরে উগ্র হয়ে ওঠে। পরে লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। এ সময় অন্য একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা আদালতসংলগ্ন ট্রেজারিতে দায়িত্বরত পুলিশের ওপর চড়াও হলে থানা থেকে ওসিসহ বেশ কিছু পুলিশ এসে জনতার ওপর লাঠিচার্জ করে। তবে জনতাকে এতেও নিরস্ত করা যায়নি। অগত্যা ওসি গুলির আদেশ দেন। গুলিতে কেউ হতাহত হয়নি। তদন্তকারী কর্মকর্তা এ মত প্রকাশ করেন, ট্রেজারি রক্ষার জন্য পুলিশের কাছে এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি পুলিশের গুলিবর্ষণকে ‘আইনানুগ’ বলেও উল্লেখ করেন।

১৯ মার্চের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়:

পত্রপ্রেরক মহাশয় [পত্রপ্রেরকের নাম উল্লেখ ছিল না] জানাইয়াছেন, এই ঘটনার [১৩ মার্চের ঘটনা] পর স্থানীয় হিন্দুদের মনে উদ্বেগ ও ত্রাসের সৃষ্টি হইয়াছে এবং তাহারা সহর ছাড়িয়া যাইতেছে। ইহা কিছুমাত্র বিচিত্র নয়, কারণ বাঙ্গলা ভাষার আন্দোলন দমনের জন্য পূর্ববঙ্গের কর্তৃপক্ষ যে অপকৌশল ও অপপ্রচার অবলম্বন করিয়াছিলেন, যশোহরে তাহাই উৎকৃষ্টভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার লক্ষ্যে ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয় ১৫ মার্চ। চুক্তির প্রথম শর্তানুযায়ী ভাষা আন্দোলনের কারণে গ্রেপ্তার হওয়া সবাইকে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। যশোরে মার্চের ১১ ও ১৩ তারিখে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে একমাত্র অনন্তকুমার মিত্র ছাড়া বাকি সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয় ১৬ ও ১৭ মার্চ। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ভাষা আন্দোলনসংশ্লিষ্ট আরও কেউ কেউ জেলে আটক ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগ থাকায় মুক্তি পাননি। ১৭ মার্চ বিকেলে মুক্তিপ্রাপ্তদের নিয়ে ছাত্ররা জেলগেট থেকে আনন্দ মিছিল বের করে। ২০ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকায় ছিল সেই খবর:

বহু ছাত্র জেল গেটে [১৭ মার্চ বিকালে] উপস্থিত হয় এবং মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণসহ একটি শোভাযাত্রা করিয়া টাউন হল প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়। ঐ স্থানে একটি সভা হয় এবং আন্দোলনের সাফল্যে আনন্দ প্রকাশ করা হয়। এ সময় পুলিশের অত্যাচারে অসন্তোষও দেখা যায়।

 ২১ মার্চ যুগান্তর-এ প্রকাশ পায়:

মুক্তিপ্রাপ্ত ছাত্রগণ সভায় অবাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে (যেহেতু তাহারা ছাত্রদের মারধোর করিয়াছিল) স্লোগান দেওয়ায় বিহারীরা ক্ষেপিয়া যায়।

 ২১ মার্চের অমৃতবাজার পত্রিকা উল্লেখ করে:

১৭ ই-এ তাদের মুক্তিপ্রাপ্তিতে তারা একটি সমাবেশ করে, যেখানে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও সদর সাবডিভিশন অফিসারের জোরালো সমালোচনা করা হয়।

উল্লেখ্য, যশোরে সে সময় প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও পুলিশের মধ্যে অবাঙালিদের আধিক্য ছিল।

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে দেশভাগের পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার থেকে বেশ কিছু শরণার্থী বা মোহাজের যশোরে এসে আশ্রয় নেয়, এদের অধিকাংশই ছিল অবাঙালি। প্রাথমিকভাবে এদের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নির্মিত শহরসংলগ্ন শানতলা সৈনিক ব্যারাকে স্থান দেওয়া হয়। এসব অবাঙালি বরাবরই ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে আসছিল। ফলে যশোরে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে আগে থেকেই বিরাজ করছিল উত্তেজনা। ১১ ও ১৩ মার্চের হরতাল, মিছিল, সমাবেশ, লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ পরম্পরায় ১৭ মার্চ টাউন হলে ছাত্রদের সভা থেকে অবাঙালিদের গালমন্দ করা হলে উভয়ের মধ্যে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়। দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একটি শান্তি কমিটি গঠন করেছিলেন। ১১ মার্চের পর থেকে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা প্রশমনের জন্য শান্তি কমিটি একটি সভার আয়োজন করে; কেবল তা-ই নয়, ১৮ মার্চ শহর প্রদক্ষিণ করে শান্তি শোভাযাত্রা।

১৭ মার্চের সভা থেকে অবাঙালিদের গালমন্দ করার জের হিসেবে ১৮ মার্চ দুপুরের পর শানতলা মোহাজির ক্যাম্প থেকে প্রায় এক শ অবাঙালি লাঠি ও অন্যান্য ধারালো অস্ত্রশস্ত্রসহ শহরে প্রবেশ করে। বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে তারা। তাদের শহরে প্রবেশে বাধা দেয় পুলিশ। পরে শান্ত হলে পুলিশ ভ্যানে করে ক্যাম্পে ফেরতও পাঠানো হয় অবাঙালিদের। এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। বিকেল পাঁচটায় অবাঙালিদের বেশ কয়েকজন ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে যশোর রেলস্টেশনে হাজির হয়। স্থানীয়দের আক্রমণ করে। এ ঘটনায় আহত হয় ১৬ জন, যাদের বেশির ভাগই ছিল অমুসলিম।

২৩ মার্চের অমৃতবাজার পত্রিকা থেকে জানা যায়: পূর্ব বাংলা লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে খুলনা থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস দলের চিফ হুইপ গোবিন্দলাল ব্যানার্জিকে যশোর থেকে শশধর আচারিয়া, রাজেন্দ্রনাথ সরকার ও আবদুস সবুর ২০ মার্চ চিঠি পাঠিয়ে যশোরের ঘটনাসমূহ জানিয়েছেন। গোবিন্দলাল বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনকে জানালে তিনি তাঁকে জানান, যশোরের পরিস্থিতি জানতে ১৯ মার্চ জেলা কর্তৃপক্ষকে তিনি ফোন করেছিলেন। তখন জানতে পেরেছেন, উত্তজনা থাকলেও ১৮ তারিখের পর আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তিনি পরবর্তী সময়েও খোঁজখবর রাখবেন বলে গোবিন্দলালকে আশ্বস্ত করেন। যদি পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, তবে তিনি (মুখ্যমন্ত্রী) পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী তলব করবেন। সংবাদে আরও উল্লেখ ছিল, গোবিন্দলাল এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।

১৮ মার্চের ঘটনাকে ভারতীয় কিছু পত্রিকায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত হিসেবে উপস্থাপন করলে ২৪ মার্চের আজাদ (তখনো পত্রিকাটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো) এর প্রতিবাদ জানিয়ে উল্লেখ করে:

যশোর প্রভৃতি স্থান হইতে এক শ্রেণীর অবাঙ্গালী মুছলমানের অত্যাচারের সংবাদ আসিতেছে। রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত আন্দোলন উপলক্ষেই এই অত্যাচার দেখা দিয়াছে এবং পূর্বোক্ত লোকেরা স্থানীয় নাগরিকদের উপর আক্রমণ চালাইয়াছে। সর্বশেষ সংবাদে দেখা যায় যে, তাহারা একটি ট্রেন আক্রমণ করিতেও ইতস্ততঃ করে নাই। আক্রমণ কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকের উপরই হইয়াছে, কলিকাতার কোন কোন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ এই রূপই ছিল। স্থানীয় প্রতিনিধিস্থানীয় নাগরিকগণ এক বিবৃতিতে উক্ত সংবাদের প্রতিবাদ করিয়া বলিয়াছেন যে, ঘটনা আদৌ সাম্প্রদায়িক নহে।

২৪ মার্চ দুপুরে পূর্ব বাংলা লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সভার শুরুতে বিরোধীদলীয় নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যশোরে ঘটে যাওয়া বিগত কয়েক দিনের ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘যশোর থেকে পাওয়া বিবরণ ও একই সাথে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বিবৃতি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ১১ মার্চ হতে, যেদিন বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ছাত্রদের দাবির পরবর্তী ধাপ হিসেবে হরতাল পালন করে, যশোর শহরে একটানা অরাজক অবস্থা বিরাজ করছে।’

 তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে এ বিষয়ে দোষারোপ করেন। মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ বিষয়ে তাঁকে বিবৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান। স্পিকারের কাছে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অপসারণ দাবি করেন তিনি। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী কাউন্সিলকে জানান, ‘যশোরের বিষয়ে বিরোধীদলীয় নেতা নিজেই স্বীকার করেছেন যে ১১ তারিখ থেকে সেখানে অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। স্থানীয় অফিসাররা সেখানে আইন ও শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৮ তারিখ বিরাটসংখ্যক বিহারী শহরে এসে উপস্থিত হয়; তবে পুলিশ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে যান এবং তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। তারা ফেরৎ চলে যায়। দুর্ভাগ্যবশত এবং বেশ অপ্রত্যাশিতভাবে এবং কোন কিছু জানার আগেই স্টেশনে [তারা] আকস্মিক আক্রমণ চালায়।’

কেন আক্রমণকারীদের আটক করা হয়নি, তা তিনি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন। তিনি সভাকে এ-ও জানান যে ১৮ তারিখের পর যশোরে আর কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলেও সেখানে বেশ উত্তেজনা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।

২৭ মার্চের আজাদ পত্রিকা থেকে জানা যায়, ১৮ মার্চের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় খ্যাতনামা আইনজীবী ও ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মসিউর রহমান রেলস্টেশনের ঘটনার নিন্দা করে বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বলা হয়:

পূর্ব ও পশ্চিম-উভয়বঙ্গই যশোরের সাম্প্রতিক এই ঘটনায় মর্ম্মাহত হইয়াছে। স্থানীয় পুলিশ বিভাগীয় ডি-আই-জি আমার এই বিবৃতির সত্যতা নিরূপণ করিবেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস স্থানীয় হিন্দু ও মুছলমানদের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রতি বর্তমান রহিয়াছে; এই সকল ঘটনা সত্ত্বেও তাহা অটুট থাকিবে।

৪ এপ্রিলের যুগান্তর পত্রিকা মারফত জানা যায়, যশোরে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা আইনজীবী হাবিবুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার করে জেলখানায় পাঠানো হয়েছে। তাঁর জামিনের জন্য জোর চেষ্টা চলে, আইনজীবী মসিউর রহমান চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অন্যদিকে, ১৬ এপ্রিলের অমৃতবাজার পত্রিকার সংবাদ, জেলা পরিষদের নবনির্বাচিত সভাপতি আইনজীবী মসিউর রহমানকেও ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কারাগারে আটক ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বন্দীরা বিভিন্ন দাবিতে, বিশেষত তাঁদের সঙ্গে সাধারণ কয়েদির মতো আচরণের কারণে জেলখানায় অনশন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেন। এ সময়—১২ এপ্রিল মসিউর রহমান বন্দীদের মুক্তির জন্য মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে আলাপ করেন।

এদিকে কলকাতায় অবস্থানরত অবিভক্ত বাংলার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বন্দীদের অনশন না করার জন্য অনুরোধ করেন। পত্রপত্রিকার সূত্রে জানা যায়, ১৬ এপ্রিল তিনি যশোর আসবেন এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

২০ এপ্রিলের আনন্দবাজার পত্রিকা লেখে, ১৭ এপ্রিল থেকে বিশ্বাসরঞ্জন কুমার মিত্রসহ সাতজন অনশন শুরু করেছেন। হাবিবুর রহমান ও মসিউর রহমান অনশনকারীদের অনশন ভঙ্গের অনুরোধ করলেও তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্তে অনড়। এর এক দিন পর ওই পত্রিকা আরও জানায়, ১৯ এপ্রিল মুক্তি দেওয়া হয়েছে হাবিবুর রহমানকে।

এরপর ২৬ এপ্রিলের অমৃতবাজার পত্রিকা থেকে পাওয়া যায় চমকপ্রদ খবর, ভাষা আন্দোলনের কারণে যশোরে গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে ২২ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে পালিত হয়েছে ‘যশোর দিবস’। এদিন নারায়ণগঞ্জের বালিকা বিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা মিছিলসহ শহর প্রদক্ষিণ করে এক সভায় মিলিত হয়। সভায় যশোরে গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রদের অনতিবিলম্বে মুক্তি প্রদানের দাবি করা হয়।

১৫ মার্চে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা, ১৯ থেকে ২৮ মার্চ পাকিস্তানের সেই সময়ের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ব বাংলা সফর, ভাষা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট নেতাদের মধ্যে মতানৈক্য ইত্যাদি কারণে এ সময় ভাষা আন্দোলন জনভিত্তি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। ফলে ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া আন্দোলন স্তিমিত হতে শুরু করে মার্চেই। এপ্রিল মাসের মধ্যে এই আন্দোলন দৃশ্যপট থেকে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। তবেযশোরের এই গুলিবষর্ণের ঘটনা যে উত্তাপ সঞ্চার করে, দেশজুড়ে সেই উত্তাপ তরঙ্গ তোলে এর মাত্র দু-বছর বাদে—১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। না, এবার আন্দোলন আর ব্যর্থ হয়নি।

সর্বশেষ: প্রতিবেদন-পরবর্তী কার্যক্রম

১৮ এপ্রিল যশোর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট এইচ এইচ নোমানী তদন্তকারীর মতামতের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে প্রতিবেদনটি বিভাগীয় কমিশনার টি আই এম নুরুন্নবীর কাছে পাঠিয়ে দেন। বিভাগীয় কমিশনার গুলিবর্ষণের ওপর কোনো মন্তব্য না করে উল্লেখ করেন, পরিস্থিতি যথেষ্ট অতিরঞ্জিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর ৭ জুন প্রতিবেদনটি পূর্ব বাংলা সরকারের স্বরাষ্ট্র (পুলিশ) বিভাগে পাঠিয়ে দেন তিনি। ২৫ জুন স্বরাষ্ট্র বিভাগের এ কিউ আনসারী নোটশিটের মাধ্যমে বিষয়টি সিদ্ধান্তের জন্য তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে উপস্থাপন করেন। নোটশিটে তিনি উল্লেখ করেন, সারা দেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে বিক্ষোভের জের হিসেবে যশোরে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল, এতে কেউ হতাহত হয়নি। অবৈধ সমাবেশ ক্রমেই আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং উপস্থিত অফিসারদের ওপর চড়াও হয়। এ কারণে গুলিবর্ষণ করা হয়। বিষয়টি লেজিসলেটিভ সভায়ও আলোচিত হয়েছে। কমিশনার যে কোনো মত দেননি এবং প্রতিবেদনে বর্ণিত ঘটনাকে অতিরঞ্জিত বলেছেন, তা-ও তিনি নোটশিটে উল্লেখ করেন। তবে চূড়ান্তভাবে গুলিবর্ষণ যৌক্তিক বলে মত দেন। জুলাই মাসে নথিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অফিস অব দ্য সাবডিভিশনাল অফিসার, সদর, যশোর

মেমো. নং. কন.৩৭১ তারিখ যশোর ১৬.৪.৪৮

প্রতি: জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, যশোর

বিষয়: কালেক্টরেট এলাকায় (ট্রেজারি বিল্ডিং) ১৩.৩. ৪৮ তারিখে পুলিশ ফায়ারিংয়ের তদন্ত প্রতিবেদন।

পিআরবির রুল ১৫৭-এর আওতায় আমি ওপরে উল্লেখিত পুলিশ ফায়ারিংয়ের তদন্ত করেছি। সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রতীয়মান হয়, ১৩.৩.৪৮-এর দুপুরে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দিতে একটি বিশাল মিছিল যশোর কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে এবং যেসব বন্দী বিশেষ ক্ষমতা অধ্যাদেশের আওতায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অথবা এসডিওর অনুমতি ব্যতিরেকে সভা ও মিছিল নিষিদ্ধকরণের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ অমান্য করার কারণে হাজতে আছে তাদের মুক্তি দাবি করে। এই মিছিলটিও ওপরে বর্ণিত ডিএম-এর আদেশের পরিপন্থী ছিল। এটি শহর প্রদক্ষিণ করে এবং শেষে এসডিওর আদালতকক্ষের উত্তর দিকের দহলিজে এসে থামে। সেকেন্ড অফিসার জনাব মুজতবা সাধারণ কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এই অবৈধ সমাবেশ এত চিৎকার করছিল যে আদালতের কর্মসম্পাদন অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে কিছু আইনজীবী বেরিয়ে এসে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু শান্ত হওয়ার পরিবর্তে তারা আরও বেশি হিংস্র হয়ে ওঠে; তাদের ওপর চড়াও হয়ে একজনকে আহত করে (আবদুল মালেক মুক্তার) এবং অপর একজনের হাতঘড়ি ভেঙে ফেলে (মৌলভি আবদুল সোবহান)। জনাব মুজতবাও তাদের এসডিওর আদালতে ফেরত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তারা তাতে কর্ণপাত করে না। এবং তৎক্ষণাৎ এসডিওকে তলব করে। এরপর জনাব মুজতবা আদালতকক্ষ ছেড়ে ডিএম-এর সঙ্গে ফোনে পরামর্শ করেন। এরপর উচ্ছৃঙ্খল জনতা আদালতকক্ষে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে। সিএসআই অতঃপর সিআইয়ের সঙ্গে আলোচনা করেন; এবং লাঠিচার্জ করে সহিংস উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেন। ইতিমধ্যে জনাব মুজতবা ডিএম-এর কক্ষ থেকে ফিরে আসেন এবং উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে লাঠিচার্জের মাধ্যমে ছত্রভঙ্গ করার আদেশ দেন। লাঠিচার্জ চলাকালে দুজন কনস্টেবল গুরুতর আহত হলে তাঁদের হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়, সিএসআইও আহত হন। ইতিমধ্যে ৫০০ জন নারী ও পুরুষের আর একটি ক্রুদ্ধ উচ্ছৃঙ্খল দল, যারা ট্রেজারি রুমের সম্মুখে জমায়েত ছিল, তারাও হিংস্র হয়ে ওঠে। ট্রেজারির প্রহরীদের ওপর ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে এবং ট্রেজারি আক্রমণের আলামত দেখা যায়। দায়িত্বে থাকা হাবিলদার বিপৎসংকেত বাজান এবং কোতোয়ালি থানার ওসিকে খবর দেন। পরবর্তীজন [ওসি] তাঁর টিএসআই ও উপস্থিত ১০ জন কনস্টেবলসহ চলে আসেন এবং অবৈধ সমাবেশকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করেন। তিনি তাদের যথাযথ সতর্কীকরণ করেন কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল জনতা আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। এরপর ওসি লাঠিচার্জ করেন, কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হন। তিনি নিজে আঘাত পান এবং তাঁর টিএসআই ও কয়েকজন কনস্টেবলও মারাত্মভাবে আহত হন।

প্রকৃত অর্থে এরপর ট্রেজারিকে রক্ষা করার জন্য গুলি চালানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। তারপর ওসি প্রয়োজনীয় সতর্কীকরণের পর গুলি ছোড়ার আদেশ দেন। এক এক করে চার রাউন্ড গুলি ছোড়া হয় এবং যখনই উচ্ছৃঙ্খল জনতার ছত্রভঙ্গের আলামত পাওয়া যায়, গুলি ছোড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। গুলি ছোড়ার ফলে কোনো হতাহত হয়নি এবং ধারণা করা যায় যে গুলি ওপরে ছোড়া হয়েছিল, যাতে কেউ আঘাত না পায়। যেহেতু ঝুঁকিটা খুবই তাৎক্ষণিক ও আসন্ন ছিল, তাই গুলি ছোড়ার জন্য কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে আদেশ নেওয়া সম্ভব হয়নি। আমার মতে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে—যা ওপরে বর্ণনা করা হয়েছে—গুলি ছোড়া পুরোপুরি যুক্তিযুক্ত। খালি খোসাগুলো যশোর রিজার্ভ ইন্সপেক্টরের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।

এস এ চৌধুরী

সাবডিভিশনাল অফিসার, সদর (যশোর)।

ইংরেজি দলিলের অনুবাদ

মুহাম্মদ লুৎফুল হক: গবেষক।