স্বপ্ন বেচেই স্বপ্ন দেখান

সাবিরুল ইসলাম
সাবিরুল ইসলাম

নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছাতে ১২ মিনিট দেরি! অনেকটা পথ হেঁটে এসে আফসোস নিয়েই আলাপচারিতা শুরু করলেন সাবিরুল ইসলাম। সময় নিয়ে আফসোসটা অবশ্য তাঁকেই মানায়। ‘টেন আউটস্ট্যান্ডিং ইয়াং পারসন অব দ্য ওয়ার্ল্ড ২০১০’ এবং ‘প্রভাবশালী ১০০ ব্রিটিশ বাংলাদেশি ২০১২’ তালিকায় স্থান পাওয়া তরুণ উদ্যোক্তার কাছে সময়টাই যে মূলধন। সাবিরুল পৃথিবীজুড়ে তরুণদের স্বপ্নের কথাই বলে বেড়ান। তাঁর কথা শুনতেই ভরে ওঠে মিলনায়তন; এমনকি স্টেডিয়ামও! ১৪ বছর বয়স থেকেই আলো ছড়াচ্ছেন তরুণ সাবিরুল। বয়স যখন বিশের কোঠায়, তাঁর নামের পাশে যুক্ত হয় মিলিয়নিয়ার তকমা। খোদ যুক্তরাজ্যের ৬৫০টি স্কুলে তাঁর ব্যবসা শেখার গেম ‘টিন-ট্রাপ্রেনার’ আছে পাঠ্যসূচিতে।
শোনা যাক, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা এই তরুণের হয়ে ওঠার গল্প।
শুরুতে বরখাস্ত
তখন সবে তেরোতে পা দিয়েছেন সাবিরুল ইসলাম। সোয়ানলি বিজনেস স্কুলে তাঁর সহপাঠী ১৪ বছর বয়সের চাচাতো ভাই কবিরুল খুলে বসলেন স্কুল ক্যালেন্ডার ডিজাইনের ব্যবসা। ভাইয়ের পদবি ব্যবস্থাপনা পরিচালক! এইটুকুন বয়সে ভাইয়ের কাজকারবার মুগ্ধ করে তাঁকে। সাবিরুল বলেন, ‘একদিন ভাইকে সাহস করে বলি, তোমার প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চাই; সহজেই চাকরিটা হয়ে গেল। পড়াশোনার সঙ্গে প্রোডাকশন ডাইরেক্টর হিসেবে চাকরি। নিজেকে বেশ বড় বড় ভাবতে লাগলাম। কিন্তু দুই সপ্তাহের মাথায় দাপ্তরিক সিল দেওয়া চিঠিটা সবকিছু বদলে দিল। বাসার ঠিকানায় আসা অফিসের চিঠিটা খুলে দেখি লেখা; “প্রিয় সাবিরুল, তোমাকে বরখাস্ত করা হলো!” মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।’ কিন্তু সাবিরুল ভেঙে পড়লেন না।

সাবিরুল ইসলামের বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অতিথি ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন
সাবিরুল ইসলামের বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অতিথি ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন

সাবিরুল বলেন, ‘আমার উল্টো প্রচণ্ড জেদ চেপে যায়। স্কুলের আরও ছয় বন্ধুকে পরিচালকের পদ দিয়ে শুরু করে দিলাম ওয়েব ডিজাইনের ব্যবসা। দৌড়ঝাঁপ শুরু করলাম লন্ডনের নামীদামি কোম্পানিগুলোতে।’
কিশোরদের কিছু করার আগ্রহে সাধুবাদ জানালেও কেউ কাজ দিতে চাইল না। ব্যতিক্রম ঘটালেন লন্ডনে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল লিনচ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সাবিরুলদের একাগ্রতা তাঁর মনে ধরল। পেয়ে গেলেন তাঁদের কোম্পানির ওয়েব ডিজাইনের কাজ। দুই সপ্তাহের মাথায় দুই হাজার পাউন্ড লাভের মুখ দেখলেন সাবিরুলরা। আত্মবিশ্বাস গেল বেড়ে।
দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাট ইয়োর ফিট
দুই বছরের চেষ্টায় ব্যবসার মৌলিক কিছু বিষয় শিখে নিলেন সাবিরুল। ১৬ বছর বয়সে নিউইয়র্ক স্টক মার্কেটে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ হয়। প্রতি সেকেন্ডে যেখানে ১০ লাখ বা মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা আসে-যায়, সেখানে কী করলেন তরুণ সাবিরুল!
বললেন, ‘মেরিল লিনচের উদ্দেশ্য ছিল আমাকে আগামী দিনের জন্য তৈরি করা। স্টক মার্কেটের অভিজ্ঞতা আমার কাজে নতুন মাত্রা জোগায়। ব্যবসায়িক ঝুঁকি নেওয়ার পথে আরও সাহসী হয়ে উঠি। লন্ডন স্টক মার্কেটে জুনিয়র ট্রেডার হিসেবে যাত্রা শুরু করলাম।’
সতেরোতে পা দিয়ে সাবিরুল ভাবলেন, তাঁর নিজ অভিজ্ঞতাকে তরুণদের মধ্যে ভাগাভাগি করা দরকার। লিখলেন তাঁর প্রথম বই দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাট ইয়োর ফিট। সমস্যা হলো, ৪০টি প্রকাশনা সংস্থায় পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েও লাভ হলো না। কেউই বইটি ছাপতে আগ্রহী নয়। সাবিরুল বলেন, ‘নিরাশ হইনি, নিজ উদ্যোগেই বই ছাপলাম।’
প্রকাশের পরপরই অবিশ্বাস্য সাড়া। প্রকাশের নয় মাসে বই বিক্রি হলো ৪২ হাজার ৫০০ কপি! আর এই সময়টায় ৩৭৯টি অনুষ্ঠানে নিজের বই ও ভাবনা নিয়ে বক্তব্য দিলেন সাবিরুল।

দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাট ইয়োর ফিট
দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাট ইয়োর ফিট

ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন সাবিরুলের বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে উপস্থিত হয়ে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে প্রেরণার প্রতীক হয়ে আলো ছড়াবে এই তরুণ।’ তাঁর আশাবাদ মিথ্যা হয়নি। দ্বিতীয় বই প্রকাশ করলেন, দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাট ইয়োর ফিট-থ্রি স্ট্রাইকস টু এ সাকসেসফুল এন্ট্রাপ্রেনিউর নামে। সিঙ্গাপুরের খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মার্শাল ক্যাভেন্ডিস থেকে বের হলো বইটি। বইটি মূলত নানা দেশের ২৫ জন টিন-স্পিকারের (কিশোর বক্তা) সাফল্যগাথা। সাবিরুলের তৈরি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১৬-২৫ বছর বয়সী তরুণদের বক্তৃতা দেওয়ার জায়গা ‘টিন স্পিকার’ এর সাফল্য ছিল এটি।
মজার খেলা ‘টিন-ট্রাপেনার’
কেবল বই আর বক্তৃতা নয়। এবার সাবিরুলের মাথায় এল ‘টিন-ট্রাপেনার’ গেম তৈরির ভাবনা। স্কুলপড়ুয়া তরুণদের ব্যবসা শেখার মজার এই বোর্ড গেম প্রকল্পে বিনিয়োগ করলেন ২০ হাজার ডলার। এখানেও সফল সাবিরুল। একসঙ্গে বিশ্বের ১৪টি দেশে শুরু হলো ‘টিন-ট্রাপেনার’ বিক্রি। নানা দেশে এ পর্যন্ত পাঁচ লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে গেমটি। ইংরেজির বাইরে আরও ১৩টি ভাষায় বের হয়েছে এটি। খোদ যুক্তরাজ্যের ৬৫০টি স্কুলে পাঠ্যসূচির অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের খেলতে দেওয়া হয় সাবিরুলের এই উদ্ভাবন।
নাইজেরিয়ায় স্বাগত
একদিন নাইজেরিয়া থেকে ফোন এল। নাইজেরীয় তরুণদের সাফল্যের গল্প শোনাতে দুই মাস পর নাইজেরিয়ার পথে সাবিরুল। বিমানবন্দরে নেমেই সাবিরুলের চোখ চড়কগাছ। বিমানবন্দরের ভেতরে তাঁর ছবি; বাইরে বিশাল বিলবোর্ডে লেখা, ‘সাবিরুল; নাইজেরিয়ায় স্বাগত!’
দুই মাসের প্রচারণায় নাইজেরিয়ায় সাবিরুল রীতিমতো তারকা।
‘স্কুল, কলেজে তরুণদের সঙ্গে অনুষ্ঠান করছি। একপর্যায়ে জায়গা হলো না; অগত্যা স্টেডিয়ামে যেতে হলো। সেখানে কাটানো সময়টা এখনো আমাকে আলোড়িত করে।’ সাবিরুল বলছিলেন নাইজেরিয়া সফরের অভিজ্ঞতা।
পুরস্কারের ঝুলি
মাত্র ২২ বছর বয়সেই সাবিরুলের ঝুলিতে জমা পড়েছে অনেকগুলো পুরস্কার। সাবিরুল বলেন, ‘২০০৮ সালে প্রিন্স অব ওয়েলস ও প্রিন্সেস অব জর্ডানের কাছ থেকে পাওয়া “মোজাইক বেস্ট এন্ট্রাপ্রেনিউর অব দ্য ইয়ার” পুরস্কার পাওয়ার মুহূর্তটা খুব মনে পড়ে। একই বছরই যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে পাই “গ্রোয়িং আপ সিইও অ্যাওয়ার্ড” ও “আউটস্ট্যান্ডিং ইয়াং অ্যাচিভার অ্যাওয়ার্ড”। ২০০৪ সালে স্কুল থেকে দেওয়া হয় “ইয়াং কোম্পানি অব দ্য ইয়ার” ও “বেস্ট প্রেজেন্টেশন অব দ্য ইয়ার”।’
অতঃপর বাংলাদেশ

যুবরাজ চার্লসের কাছ থেকে ‘মোজাইক বেস্ট এন্ট্রাপ্রেনিউর অব দ্য ইয়ার (২০০৮)’ নিলেন সাবিরুল ইসলাম
যুবরাজ চার্লসের কাছ থেকে ‘মোজাইক বেস্ট এন্ট্রাপ্রেনিউর অব দ্য ইয়ার (২০০৮)’ নিলেন সাবিরুল ইসলাম

সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায় দাদার বাড়ি সাবিরুল ইসলামের। ‘দাদার সঙ্গে গাভিকে খড় খাওয়ানোর আবছা স্মৃতিটাই শুধু মনে আছে। তিন বছর বয়সে একবার বাংলাদেশে গিয়েছিলাম।’ সাবিরুল বলেন, ‘আমার পরিচয় আমি বাঙালি; আমার শিকড় বাংলাদেশ। নানা দেশে ঘুরে বেড়ালেও বাংলাদেশে গিয়ে কাজ করার টান সব সময়। পূর্ব লন্ডনের বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকায় নানা সমস্যার মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠি। সমবয়সীদের বিপথগামিতার মধ্যেও নিজেকে বের করার চেষ্টা চালিয়ে গেছি। শুধু অর্থের দিক দিয়ে তরুণদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠাই যেন মূলমন্ত্র না হয়। নিজেকে জাগিয়ে তুলতে পারলেই আলোকিত হবে চারপাশ। আমি সে চেষ্টাই করছি।’
সাবিরুলের বাবা শফিকুল ইসলাম বললেন, ‘ছেলের একাগ্রতায় আমরা বাধা হয়ে দাঁড়াইনি। সব সময় সহযোগিতার চেষ্টা করেছি।’

ইন্সপায়ার ওয়ান মিলিয়ন
ইন্সপায়ার ওয়ান মিলিয়ন

ইন্সপায়ার ওয়ান মিলিয়ন
মাদকাসক্ত নাইজেরীয় যুবক ওসোয়েমন ইগাদেলো। মাদক ছেড়ে কাজ নিলেন; লক্ষ্য লন্ডনে আসার অর্থ জোগাড়। ছয় মাসের মাথায় হয়েও গেল। তারপর একদিন সাতসকালে সাবিরুলের ঘরে। সাবিরুল নিজেই দরজা খুলে দিলেন। হাত বাড়িয়ে ইগাদেলো বললেন, ‘সাবিরুল, ইউ হ্যাভ চেইঞ্জড মাই লাইফ!’ পুরো ব্যাপারটাই অপ্রত্যাশিত। সাবিরুল বলেন, ‘একটা তরুণ তার জীবনের পথ বদলে দিয়েছে আমার বক্তৃতা শুনে! নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেল। ২০১১ সালের মে মাসে মালদ্বীপ থেকে শুরু করলাম প্রজেক্ট “ইন্সপায়ার ওয়ান মিলিয়ন”। পৃথিবীজুড়ে ১০ লাখ তরুণ উদ্যোক্তা তৈরির প্রকল্প।
এ প্রকল্প নিয়ে বিশ্বের ২৫টি দেশ চষে বেড়িয়েছেন সাবিরুল। তাঁর প্রকল্পে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আট লাখের ওপর। সাবিরুল বললেন, ‘বাংলাদেশে গিয়ে এক মিলিয়ন পূর্ণ করার ইচ্ছা আছে; জানি না কী হয়।’ সব ঠিকঠাক থাকলে এ মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশে যাওয়ার কথা সাবিরুলের।