দেশ গার্মেন্টসের হাত ধরে...

চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকেরা
ছবি: প্রথম আলো

সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর চট্টগ্রামের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় প্রায় ৯ একর জমির ওপর ‘দেশ গার্মেন্টস’ গড়ে তুলেছিলেন নুরুল কাদের। সালটা ১৯৭৭। এটিই দেশের প্রথম তৈরি পোশাকের কারখানা, যার শুরু হয়েছিল এই বন্দরনগর থেকে। এরপর গত ৪৫ বছরে বন্দরনগর চট্টগ্রামে এই খাতের কারখানা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে রপ্তানি আয়।

বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে তৈরি পোশাকে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ছয় বিলিয়ন ডলারে-এমনটাই বলছেন পোশাক কারখানার মালিকেরা। তবে এই সাফল্যের তত্ত্বতালাশে ফিরে যেতে হবে দেশ গার্মেন্টসের শুরুর দিনগুলোতে। কারণ, সেই দেশ গার্মেন্টস থেকেই সারা দেশে বিস্তৃত হয়েছিল পোশাকশিল্প খাত। পথ দেখিয়েছিল চট্টগ্রাম।

দেশ গার্মেন্টসের কর্ণধার নুরুল কাদের ছিলেন বিমানবাহিনীর পাইলট। কিন্তু সেই কাজ ছেড়ে তিনি শুরু করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থশাস্ত্রের পড়াশোনা। এরপর পাকিস্তান সরকারের অধীনে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন পাবনার জেলা প্রশাসক। এই সময়ে সরাসরি অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। খান সেনাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের অংশ হিসেবে নুরুল কাদের নিজের নাম থেকে ‘খান’ পদবিটিও বাদ দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খুব বেশি দিন সরকারি চাকরি করা হয়নি নুরুল কাদেরের।

১৯৭৩ সালে ইস্তফা দিয়ে ব্যবসায় উদ্যোগী হন। ব্যবসা-বাণিজ্যের নানা পথ ঘুরে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু করপোরেশনের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন দেশের প্রথম তৈরি পোশাক রপ্তানির কারখানা দেশ গার্মেন্টস। অবশ্য কারখানা শুরুর আগে ১৩০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দক্ষিণ কোরিয়ায় নিয়ে গিয়ে ছয় মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পরে যাঁদের অনেকেই হয়েছিলেন কারখানার মালিক। তবে নুরুল কাদেরের হাত ধরেই শুরু হয় এ দেশে তৈরি পোশাকের বিদেশযাত্রা। বলা চলে পোশাক খাতের ভিত তৈরি করেছিল দেশ গার্মেন্টস।

১ থেকে ৬৩৫

আশির দশকে যাত্রা শুরু হওয়া তৈরি পোশাকের কারখানার সংখ্যা এই চট্টগ্রামে নেহাত কম নয়। বর্তমানে নিবন্ধিত মোট রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে ৬৩৫টি। এর মধ্যে সচল আছে ৩৩৪টি। সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রয়েছে ২১৪টি কারখানা। দেড় থেকে দুই বছর ধরে বন্ধ আছে ৮৭টি কারখানা। এ ছাড়া ২৪টি কারখানা এখনো রপ্তানির অনুমতি পায়নি।

দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে তৈরি পোশাকশিল্পের অবদান রয়েছে। আশির দশকের শুরুতেও দেশে তৈরি পোশাকশিল্প এক মিলিয়ন ডলারের কম মূল্যমানের শিল্প ছিল। বর্তমানে এটি পৌঁছেছে প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলারে। এ ছাড়া বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বৈশ্বিক বাজারে যার শেয়ার ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। তৈরি পোশাকশিল্পের এমন অগ্রগতির পেছনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ দৃশ্যমান। অন্য শিল্পকারখানাকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত করপোরেট কর দিতে হয়, কিন্তু পোশাক কারখানার জন্য এই করের হার ১০ থেকে ১২ শতাংশ। এর বাইরে এই শিল্প খাতের জন্য রয়েছে নগদ সহায়তা, মূসক অব্যাহতি, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নেওয়া কিংবা শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুবিধা।

চট্টগ্রামের পোশাকশিল্প মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আশির দশকের পর দেশজুড়ে পোশাকশিল্প কারখানা বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামে নানা কারণে সেই হারে কারখানা বাড়েনি। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকায় রানা প্লাজা ধসের পর চট্টগ্রামেও ওই ঘটনার প্রভাব পড়ে। নানা শর্তে কমে যায় পোশাকের অর্ডার। অবশ্য বেশ কিছু শর্ত পূরণ করে আবার ঘুরে দাঁড়ান কারখানার মালিকেরা। কিন্তু এরপর করোনা মহামারির আঘাতে অনেকটা সরু হয়ে যায় এ খাতের ‘পথঘাট’। কমতে থাকে অর্ডার। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।

বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসিরউদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেছেন, নব্বইয়ের দশকেও দেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ৪০ শতাংশের বেশি হিস্যা ছিল চট্টগ্রামের। এখন সেটি কমে ১২ থেকে ১৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

অবশ্য বর্তমানে এশিয়ান গ্রুপ, প্যাসিফিক গ্রুপ, ক্লিপটন গ্রুপ, ইয়াংওয়ানের মতো শিল্প গ্রুপের হাত ধরে চট্টগ্রামের তৈরি পোশাকশিল্প খাত এগোচ্ছে।

১০০ কোটি ডলারে ইয়াংওয়ান

দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্যোক্তা কিহাক সাংয়ের মালিকানাধীন ইয়াংওয়ান করপোরেশনের সুনাম এখন দেশজুড়ে। দুই দশক আগে এই শিল্পগোষ্ঠীর তৈরি পোশাক রপ্তানি ছিল দুই কোটি ডলারের কম। তখন ঢাকা ও চট্টগ্রামে তাদের কারখানা ছিল সাতটি। পরে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ২ হাজার ৪৯২ একর জমির ওপর কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (কেইপিজেড) নির্মাণ করা হয়। ২০১১ সাল থেকে কেইপিজেডে কারখানা চালু হতে থাকে। সেই সঙ্গে দ্রুত বাড়তে থাকে তাদের রপ্তানি।

সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে পৌঁছেছে দক্ষিণ কোরিয়ার এই কোম্পানি। এই অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানি করেছে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৯ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকার পোশাক। এ শিল্পগোষ্ঠীই বর্তমানে বাংলাদেশের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক। এই সাফল্যের জন্য শুরু থেকেই কারখানায় ব্যবহার করা হয় উন্নত প্রযুক্তি। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যের পোশাক তৈরিতেও মনোযোগ ছিল এ শিল্পগোষ্ঠীর।

জিনসের নেতৃত্বে প্যাসিফিক

বাংলাদেশ থেকে প্রথম জিনস রপ্তানির নেপথ্য কারিগর ছিলেন চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা এম নাসিরউদ্দিন। তাঁর হাতে গড়া প্যাসিফিক জিনস এখনো জিনস রপ্তানির নেতৃত্ব দিচ্ছে। বর্তমানে জিনসের পাশাপাশি নিট ও কাজের পোশাক (ওয়ার্কওয়্যার) রপ্তানি করছে তারা। তবে প্যাসিফিক  গ্রুপের রপ্তানি পণ্যের ৯১ শতাংশই জিনস প্যান্ট।

প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্যাসিফিক জিনসের বড় ক্রেতা জাপানের বহুজাতিক খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠান ইউনিক্লো। এ ছাড়া সিঅ্যান্ডএ, টেসকো, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, টম টেইলরের মতো ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো আস্থায় রাখছে প্যাসিফিককে। বিশ্বের ৫২টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে প্যাসিফিকের পোশাক। গত অর্থবছরে এই গ্রুপের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৩৮ কোটি টাকা বা ৪০ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁর বাবার হাত ধরেই যাত্রা শুরু হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠানের। দ্বিতীয় প্রজন্ম হিসেবে তিনি হাল ধরেছেন। ডেনিম দিয়ে শুরু করলেও এখন তাঁরা বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করছেন। নতুন নতুন নকশায় পণ্য উদ্ভাবনের মাধ্যমে আরও উচ্চ মূল্যের পোশাক রপ্তানিই তাঁদের লক্ষ্য।

বাধা ডিঙিয়ে রপ্তানি বাড়ছে

প্রচলিত বিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশের কোনো তৈরি পোশাক কারখানা বিদেশি পণ্য রপ্তানি করতে চাইলে রপ্তানি আদেশের বিপরীতে বিজিএমইএর কাছ থেকে সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক। যদি রপ্তানি পণ্যের জন্য বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করার প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে বিজিএমইএর কাছ থেকে ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) সনদ নিতে হয়। আর দেশের কাঁচামাল ব্যবহার করে কোনো প্রতিষ্ঠান রপ্তানি করতে চাইলে সে ক্ষেত্রে বিজিএমইএর কাছ থেকে ‘রপ্তানি সনদ’ নিতে হয়। অর্থাৎ বিজিএমইএর সনদ ছাড়া তৈরি পোশাক রপ্তানির সুযোগ নেই।

চট্টগ্রামে প্রতিবছরই বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এই সনদ নিচ্ছে। রপ্তানির খাতায় নাম লেখাচ্ছে। এতে আয় বাড়ছে। বিজিএমইএ সূত্র বলছে, ২০১৩ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য চট্টগ্রামের বিজিএমইএ থেকে ইউডি  নিয়েছিল ৩৪৩টি কারখানা। ৬ কোটি ৮ লাখ ২২ হাজার ডজন তৈরি পোশাকের রপ্তানি আদেশের বিপরীতে এ ইউডি নেওয়া হয়। এক দশক পর ২০২৩ সালে এসে রপ্তানির জন্য ইউডি নিয়েছে ১৮৩ কারখানা। এ ছাড়া ২০২২ সালে নিয়েছে ১৭৯টি, ২০২১ সালেও ১৭৯টি এবং ২০২০ সালে ১৮০টি প্রতিষ্ঠান ইউডি নিয়েছে।

পোশাক কারখানার মালিকেরা বলছেন, নানা বাধা ডিঙিয়ে ধীরে ধীরে চট্টগ্রামের পোশাকশিল্প প্রসারিত হচ্ছে। যদিও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা এখনো ঢাকাকেন্দ্রিক। ক্রেতারাও ঢাকাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।

অবশ্য অর্ডার না পাওয়া, পোশাকের মান ধরে রাখতে না পারা, লোকসান দেওয়াসহ নানা কারণে গত পাঁচ বছরে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়েছে। চালু হয়েছেও কম। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল-এই ১০ বছরে চট্টগ্রামে প্রায় ৪০০ নতুন তৈরি পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছিল। সেই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ৪০টি করে নতুন কারখানা স্থাপিত হয়েছে চট্টগ্রামে। তার বিপরীতে ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এ ১০ বছরে গড়ে উঠেছে ১৭৪টি কারখানা। ২০১৫ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত স্থাপিত হয়েছে ৮৯টি কারখানা।

চট্টগ্রামের তৈরি পোশাকের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে আশার কথাই শোনা গেছে বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসিরউদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে। তাঁর মতে, দেশের প্রথম রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা দেশ গার্মেন্টসের মাধ্যমে এই খাতের যে শুরুটা হয়েছিল, তা চট্টগ্রাম থেকেই প্রসারিত হয়েছে। এখন এই শিল্পকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে অবকাঠামোগত কিছু উন্নয়ন দরকার। আরও দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা। তবে সব বাধা ডিঙিয়ে এই অঞ্চল থেকে রপ্তানি আয় ছয় বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।