একটি প্রকৃতিবান্ধব নগরের খোঁজে

ঢাকা মহানগর দেশের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও বাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে সবচেয়ে নিম্নে অবস্থান করছে
ছবি: প্রথম আলো

জাতিসংঘের নেতৃত্বে বিশ্বনেতাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সেন্ডাই ফ্রেমওয়ার্ক, বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য ফ্রেমওয়ার্ক এবং নিউ আরবান অ্যাজেন্ডা গৃহীত হয়েছে। বৈশ্বিক এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সব দেশ নিজের সাধ্যমতো বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।

তবে ২০২০ সালের করোনা মহামারি প্রভাবিত করেছে সারা বিশ্বকে। জাতিসংঘের মতে, বিগত ৭৫ বছরের মধ্যে এই করোনা মহামারিতে বিশ্বের অর্থনৈতিক, জনস্বাস্থ্য, উন্নয়ন, খাদ্যসহ সামাজিক সব স্তর সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়।

করোনা মহামারির এই ভয়াবহতা কাটতে না কাটতেই শুরু হলো আরেক বৈশ্বিক সংকট: প্রথমে রাশিয়া-ইউক্রেন এবং পরে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ, যার ফলে খাদ্য অনিরাপত্তা, মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, লাখ লাখ মানুষের বাস্তুহীনতার মতো ভয়াবহ সংকট তৈরি হচ্ছে।

পাশাপাশি নগরায়ণ এবং শিল্পায়নের উপজাত হিসেবে বিশ্ব ক্রমাগত জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। গ্রিনহাউস গ্যাস, বিশেষ করে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট গ্রিনহাউস প্রভাবের কারণে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, দিন-রাতের তাপমাত্রার বড় পার্থক্য দেখা দিয়েছে, শহরগুলো পরিণত হচ্ছে তাপীয় দ্বীপ (হিট আইল্যান্ড) হিসেবে। ফলে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রতি বিপর্যয় পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রাণপ্রকৃতি।

বাংলাদেশ এই বৈশ্বিক চলমান বাস্তবতার বাইরে নয়। তবু বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভের সব কটি মানদণ্ড পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে এবং ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করবে।

শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান

কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা কাটিয়ে ২০২২ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৭ দশমিক ১০ শতাংশে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জারি করা সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ২০৯ মার্কিন ডলার, যা ২০২২ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২ হাজার ৭৯৩ মার্কিন ডলার।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে নগরায়ণের হার বর্তমানে ৩৮ শতাংশ এবং দেশে বর্তমানে ১২টি সিটি করপোরেশন, ৩২৯টি পৌরসভা এবং ৫৭০টি নগরকেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের নগরায়ণ হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে, যার প্রভাবে প্রতিনিয়ত ঢাকাসহ দেশের সব নগর ও শহর এলাকায় পরিবেশ ও প্রতিবেশগত বিপর্যয় দেখা যায়। যদিও সরকারের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি কাঠামোয় ২০৪১ সাল নাগাদ নগরায়ণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সম্প্রতি বিআইপি কর্তৃক গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৯৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নগরীর সবুজ এলাকা ও জলাধারের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, ঢাকার সবুজ এলাকা ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ এবং জলাধার ২০ দশমিক ৫৮ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৯১ শতাংশে নেমে এসেছে।

এর মূল কারণ হলো জলাধার ভরাট এবং সবুজ এলাকা ধ্বংস করে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন আবাসিক, বাণিজ্যিক এলাকা ও শিল্পকারখানা। ফলে যানজট, জলজট ও পানিনিষ্কাশনের দুর্দশা, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য মানসম্মত আবাসনের অভাব, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থানের অভাব, খেলাধুলার স্থানাভাব, মানসম্পন্ন অবকাঠামোর অভাব, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অপ্রতুল নাগরিক পরিষেবা, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে এবং ক্রমান্বয়ে ঢাকা মহানগরী হয়ে উঠছে বসবাসের অযোগ্য।

উপরন্তু অগ্নিদুর্ঘটনা, ভূমিকম্প, তাপীয় দ্বীপের মতো আরও বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে নগরবাসী। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত ২০১৭ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ঢাকায় অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ হাজার ৬৫১টি, যা বর্তমানে আরও বেড়েছে।

এ ছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর কর্তৃক ২০০৯ সালের একটি গবেষণা থেকে দেখা যায়, সরাসরি ঢাকা শহরের ভূপৃষ্ঠে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে নগরের প্রায় ৫৬ শতাংশ ভবন ধসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তুরস্কের ভূমিকম্পের মতো অনেক বড় একটি বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।

এসব পরিস্থিতি উত্তরণের কি কোনোই উপায় নেই? বাংলাদেশে পরিকল্পিত নগরায়ণের উপায়ই বা কী? বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পরিকল্পিত নগরায়ণের ভূমিকা অপরিসীম এবং চলমান চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলার মাধ্যমে সারা দেশে পরিকল্পিত এবং টেকসই নগরায়ণ নিশ্চিত করা সম্ভব।

তবে সারা দেশের এই নগরায়ণ হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায্য এবং প্রকৃতিবান্ধব। রবি ঠাকুরের ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব বাংলাদেশের ছোট-বড় সব নগর, শহর ও গ্রামীণ জনপদকে।

এই লক্ষ্যে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের পক্ষ থেকে প্রণয়ন করা হয়েছে জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা কাঠামো। এই কাঠামো মূলত বাংলাদেশ সরকারের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১-এ বর্ণিত ৮০ শতাংশ নগরায়ণের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের রোডম্যাপ। এই পরিকল্পনা কাঠামোয় ১৯৭৩ সালে প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী সারা দেশের স্থানিক পরিকল্পনা রূপরেখা, আঞ্চলিক পরিকল্পনা (বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চল, জেলা) এবং স্থানীয় পর্যায়ের পরিকল্পনা (উপজেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন) প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কাঠামোপদ্ধতি, প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো এবং আইনগত ভিত্তিসহ বিস্তর প্রস্তাবনা প্রণয়ন করা হয়েছে।

পাশাপাশি ওই কাঠামো বাস্তবায়নে দেশের পরিকল্পনাবিদদের কীভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে তার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবনা, দেশের পরিকল্পনা এবং বাজেটের অসম হারসংক্রান্ত জটিলতা দূরীকরণে স্থানিক পরিকল্পনা ডিজাইন এবং বাজেট করার সময় একটি যুক্তিসংগত রেট শিডিউল সংযুক্ত করা হয়েছে।

এই প্রকাশনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি পরিকল্পনার একটি ভৌগোলিক প্রকাশ হিসেবে কাজ করবে, যা সরাসরি জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ের ভূমি, ভৌত অবকাঠামো এবং বিভিন্ন নির্মাণ কার্যক্রমের পরিকল্পনায় প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। একটি ব্যাপক, স্বক্রিয়াশীল (রিফ্লেক্সিভ) ও অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন স্থানিক পরিকল্পনাকাঠামো বাংলাদেশের জন্য সংঘবদ্ধ স্থানিক পরিকল্পনা অনুশীলনকে ধারণ ও টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করতে পারে।

প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্থানিক পরিকল্পনার ওপর জোর দেওয়ার পর ইতিমধ্যে পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। তবে দীর্ঘ সময় পরে হলেও প্রয়োজনীয় সব অংশীজনের অংশগ্রহণ এবং সম্মিলিত কাজসহ একটি সমন্বিত স্থানিক পরিকল্পনাকাঠামো প্রতিষ্ঠা করার এটিই উপযুক্ত সময়। না হলে মাথাপিছু আয়ের নিরিখে আমরা হয়তো উন্নত রাষ্ট্রের মানদণ্ড অর্জন করতে পারব, কিন্তু পরিবেশ, প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় হিসেবে নগর, শহর ও গ্রামীণ জনপদসমূহকে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।

শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান: নগর-পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক।