রজতজয়ন্তীর বিশেষ লেখা
জয়নুল আবেদিন: শূন্য থেকে শুরু
জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।
একসময়ের কলেজ আর পরে অনুষদে রূপান্তরিত হওয়া আর্ট ইনস্টিটিউটে পড়ালেখা এবং শিক্ষকতার সুবাদে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বহু কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ আমার ঘটেছিল। নৈকট্যের কারণে তাঁর আঁকার ধরন, ভাবনার রকম এবং সেসবের প্রকাশ দেখা–বোঝা ছাড়াও তাঁর শিল্পকলার রুচি প্রসারের প্রচেষ্টা, গোঁড়া সমাজের সংস্কার, শিল্পী এবং শিল্পকলাকে সম্মানজনক করে তুলতে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি বহু কিছু জানতে পেরেছি। সেসব থেকে প্রকারান্তরে নিজেকে তৈরি করার ঘটনাটিও যে ঘটেছিল, তা নিয়ে গর্ববোধ করি।
শিল্পকলা হোক বা সমাজ-সংসারের অন্য কোনো দিক, কিছু করার আগে বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নিতেন জয়নুল আবেদিন। এসবের ভালো-মন্দ, দোষ–গুণ নিয়ে অন্যদের ধারণা জানার চেষ্টা করতেন। তবে আলোচনা করতে গিয়ে নেতিবাচক অবস্থান দেখলে সমাধানে নিজস্ব চিন্তা এবং পরিকল্পনা যা করতেন, তা–ই বাস্তবায়ন করে ছাড়তেন।
লক্ষ করে দেখেছি, এ ব্যাপারে তাঁর অবস্থান হতো জেদি। এমন দুটি বৃহৎ মাপের জেদি কাজ হলো চারুকলা শিক্ষার জন্য ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প জাদুঘর স্থাপন। এ ছাড়া ‘বিসিক’-এ ডিজাইন সেন্টার, পিটিভিতে (বর্তমান বিটিভি) আমাদের শিল্পীদের বেশি করে অন্তর্ভুক্তি, টিভি দর্শকদের শৈল্পিক রুচিতে অভ্যস্ত করার বিষয়েও তার ভূমিকা ছিল জোরালো। শিল্পকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণে অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা থাকায় তাঁকে দিয়ে পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিভাগগুলোতে প্রাথমিকভাবে প্রধানের দায়িত্বও তাঁকে নিতে হয়েছিল।
আর এসব কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার নিজস্ব শিল্পচর্চা। তাঁর চিত্রকলার চর্চা প্রাথমিকভাবে ব্যাহত করেছিল আসলে ভারতভাগ। দেশে ফিরে শিল্পকলার কোনো পরিবেশ বা শিল্পীদের সুষ্ঠু জীবনযাপনের দিকটি প্রায় শূন্য দেখে সেসব নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ফলে ব্যাহত হয় নিজের আঁকা। ইচ্ছা করলে তিনি শুধু চিত্রকলা চর্চাতেই নিয়োজিত থাকতে পারতেন; কিন্তু দেশের প্রয়োজনে, জনগণের স্বার্থে, শিল্পীদের দিকে তাকিয়ে নিজের ক্ষতি তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
তড়িঘড়ি এসবে মনোযোগী হওয়ার অন্য আরেকটি কারণ, পূর্বের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পকলার সুষ্ঠু অবস্থা। লাহোরে ব্রিটিশ আমল থেকেই সরকারি একটি নামী আর্ট কলেজ ছিল। আগে থেকেই চর্চার চমত্কার পরিবেশ তৈরি থাকায় সেটিকে ঘিরে শিল্পী সাকের/শাকির আলী, জোবেদা/জোবাইদা আগা প্রমুখ কাজ করতেন। বড় শিল্পী হিসেবেও পরিচিতি ছিলেন তাঁরা।
জয়নুল আঁচ করেছিলেন, সেখানকার শিল্পী এবং কলেজটি পুরো পাকিস্তানের শিল্পকলাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। শিল্পকলার কেন্দ্র হয়ে উঠবে লাহোর। খ্যাতিমান হওয়ার ইচ্ছা থাকলে অধ্যাপক হয়ে অনায়াসে লাহোর কলেজে চলে যেতে পারতেন তিনি। কিন্তু তিনি তা করেননি, তেমন স্বার্থপর তিনি হতে চাননি। তিনি কলকাতা থেকে আসা আর সব শিল্পীর কথা ভেবে এবং শিল্পকলার ক্ষেত্রটিকে দেশের সাবলীল চর্চার উপযোগী করতে, আরও শিল্পী তৈরি করতে একটি আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেন। ।
এ কাজ করতে গিয়ে তাঁর নিজস্ব কাজ অনেকটাই থেমে যায়। নিজের চর্চা যে ব্যাহত হয়েছে, পরে তা নিয়ে আক্ষেপ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘কলকাতায় সব শিল্পীই বেশ ভালো ছিলাম। শ্রদ্ধা ছিল, সম্মান ছিল, কাজও ছিল। সাতচল্লিশে ঢাকায় আইসা তো একেবারে শূন্যের ভেতরে পড়ছিলাম আমরা। ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল আমাগো এই দিকটায়।’
কথাগুলো সংক্ষিপ্ত হলেও আতঙ্কিত হওয়ার মতো। ১৯৪৭–পরবর্তী সময়ে দেশে আসলেই শিল্পকলা এবং শিল্পীদের কাজ করার মতো পরিস্থিতি ও পরিবেশ ছিল না বললেই চলে। স্বাভাবিকভাবেই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত অবস্থানে থাকা, শিল্পকলার সম্মানজনক ও আদরণীয় পরিবেশ থেকে ছিটকে পড়া জীবনকে সর্বতোভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু জীবনযাপন পুনরুদ্ধার, শিল্পকলাচর্চার স্বাভাবিক পরিবেশ নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়ে। সহশিল্পীদের নিয়ে দেশে এই সবকিছুকে প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে অবতীর্ণ হন জয়নুল।
জয়নুল জানতেন যে তাঁর নিজের আকাশচুম্বী খ্যাতি এবং সম্মানকে নবগঠিত দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত উচ্চপর্যায়ের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগে কাজে লাগাতে হবে। এ ব্যাপারে নিজের ওপর দারুণ আস্থাবান ছিলেন তিনি। বলা বাহুল্য, তাঁর এই প্রচেষ্টা কাজেও লেগেছিল। তিনি এবং কলকাতা থেকে আগত শিল্পীবৃন্দ সফল হয়েছিলেন। তাঁর এবং সঙ্গীদের খ্যাতি সোনা ফলিয়েছিল।
তাঁদের সেই সাফল্যের ফসল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের চারুকলা অনুষদ। চারুকলা শিক্ষার প্রতিষ্ঠানটি এখন বিশাল বৃক্ষ। শুধু তা–ই নয়, এটিকে এ ক্ষেত্রের ‘নিউক্লিয়াস’ও বলা যায়। কারণ, এখান থেকে ছাত্রছাত্রীরা বেরিয়ে পড়ে দেশজুড়ে বহু শিল্পকলা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। সব কটি থেকে ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া শেষে বিদেশে যাচ্ছে, নাম করছে, খ্যাতিমান হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, সারা দেশে শিল্পকলাচর্চার সুন্দর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। শিল্পকলা নিয়ে ভাবার জগৎ তৈরি হয়েছে, বাজার সৃষ্টি হয়েছে, নানা দিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। শিল্পকলাচর্চা এখন একটি সম্মানীয় ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য। সমাজের বড় বড় স্থানে শিল্পীরা অধিষ্ঠিত রয়েছেন। শিল্পকলাচর্চার ক্ষেত্রে শিল্পীদের আবেগ বেড়েছে। নির্দ্বিধায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখন তরুণ শিল্পীদের নিত্যদিনের কাজ। বিদেশে সেসব প্রদর্শিত হচ্ছে, প্রশংসিত হচ্ছে, বৈশ্বিক ভাবনাকে সঙ্গী করে নতুন নতুন চিন্তা বিকশিত হচ্ছে। চর্চায় আন্তর্জাতিকতা এসেছে। আবার সেসবকে দেশীয় ঐতিহ্যিক ধারণা এবং ধরন-ধারণের সঙ্গে মিশিয়ে বাইরের জগৎকে জানানো যাচ্ছে।
যে নিউক্লিয়াসের কথাটি উল্লেখ করেছি, এই মুহূর্তে তা দেশের সাংস্কৃতিক, জাগতিক এবং সেই সঙ্গে বৈশ্বিক মতো সব আয়োজনে-প্রয়োজনের প্রধান প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্যতা হলো যে শিল্পীরা নিজেরাই এই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস তৈরি করেছে, এটিকে খুঁটি বানিয়ে নিজেদের জীবনকে পরিচালিত করছে, চর্চাকে রাখছে বেগবান। এই সবকিছুর মূল মানুষটি প্রচ্ছন্নে সব শিল্পীর অনুপ্রেরণা হিসেবে আজও ভূমিকা পালন করে চলেছেন। আর তিনিই জয়নুল। কখনো শিল্পী জয়নুল, কখনো সংগঠক জয়নুল, কখনোবা দুর্ভিক্ষ–ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের দুর্গতিকে নিয়ে ভাবা মানবদরদি জয়নুল আবেদিন।
লোকে বলে কম এঁকেছেন, নিজেও বলেছেন ‘আরও আঁকতে হতো।’ কিন্তু ‘পাইন্যার মা’, ‘সংগ্রাম’, ‘বিদ্রোহ’, ‘গুনটানা’, ‘প্রসাধনরতা’, ‘মনপুরা’সহ কয়েকটি বিশাল মাপের স্ক্রল এবং ‘দুর্ভিক্ষের চিত্রাবলি’সহ যে কয়েক হাজার ছবি রেখে গেছেন, তা–ই বা কম কিসে। এগুলো তো এখন জাতীয় সম্পদ। তাঁর এসব শিল্পকর্ম আর বিপুল কর্মকাণ্ডের জন্যই না তিনি শিল্পাচার্য।
রফিকুন নবী: জয়নুল আবেদিনের ছাত্র ও সহকর্মী; চিত্রশিল্পী