প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি

প্রথম আলোর ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।

আমার সাংবাদিকতাজীবনের সবচেয়ে বড় ইভেন্ট করোনা মহামারি। গভীর মনোযোগ দিয়ে বৈশ্বিক এই ইভেন্ট আমি কাভার করেছি। গর্বের বিষয় হচ্ছে কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, প্যারিস, রোম, নিউইয়র্কের বড় বড় সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের রিপোর্টাররা যে বিষয় নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, আমিও সেই বিষয় নিয়ে দিনের পর দিন রিপোর্ট করেছি। অলিম্পিক গেমস ছাড়া সারা বিশ্বকে এক সুতোয় বাঁধা এত বড় ইভেন্ট আর হয় না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বের সেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সেরা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দিন-রাত যুক্ত থেকে ছোট-বড় অনেক সংবাদ ‘ব্রেক’ করেছি। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক নতুন বিজ্ঞানী, গবেষক, চিকিৎসক, সমাজকর্মীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পরিচিতদের সঙ্গে সম্পর্কের নবায়ন হয়েছে, ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। সুতরাং মতি ভাইয়ের প্রস্তাব নিয়ে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সঙ্গে কথা বলা আমার জন্য কঠিন কাজ ছিল না।

মতি ভাই, মালেকা আপা বাসায় ফিরলেন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আমি ফোন করলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমানকে। আমি তাঁকে ‘খসরু ভাই’ ডাকি। বললাম জরুরি কথা আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে চাই। তিনি মত দিলেন। সিএনজি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। পেয়ারা আর কাঠবাদাম খেতে খেতে খসরু ভাইকে মতি ভাইয়ের ইচ্ছা, গবেষণার বিষয়বস্তু খুলে বললাম। বললাম, টাকা যা লাগে দেবে প্রথম আলো।

খসরু ভাই কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা খুশি হলেন। বিস্মিত হলেন এই ভেবে যে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ‘আইডিয়া’ এসেছে সংবাদপত্রের সম্পাদকের কাছ থেকে। শুধু তাই না, গবেষণায় অর্থায়ন করবে ওই সংবাদপত্র। খুশি হলেন এই ভেবে যে কেন বাংলাদেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু কম, এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই ওষুধবিজ্ঞানী আমাকে বললেন, ‘ঠিক এই কারণেই মতিউর রহমান বড় সম্পাদক, প্রথম আলো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্র।’

বিএসএমএমইউ থেকে সরাসরি অফিসে আসি। ওই দিন কাজের ফাঁকে আরও দুজন বিজ্ঞানীকে ফোন করে মতি ভাইয়ের ‘আইডিয়া’ জানাই। একজন চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অধ্যাপক সমীর সাহা। দ্বিতীয়জন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাহমিদ আহমেদ।

প্রত্যেকের সাড়া ছিল আশাব্যঞ্জক। দুজনই গবেষণার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। অধ্যাপক সমীর সাহা বলেছিলেন, প্রধান গবেষকদের পারিশ্রমিক বা সম্মানী বাদ দিলেও গবেষণার জন্য কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকার প্রয়োজন হবে।

দ্বিতীয় দফা আলোচনা

দ্বিতীয় দফায় তিন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের গবেষণায় যুক্ত করার কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। কাজটি ছিল জটিল। এত বড় বড় বিজ্ঞানীর ইগো, অবস্থান, নৈতিকতার বিষয়গুলো সামাল দিতে পারব কি না, তা নিয়ে মনের মধ্যে কিছুটা সংশয় তৈরি হয়েছিল। ভরসা ছিল এই যে কাজটি প্রথম আলোর, মতি ভাইয়ের।

৬ মার্চ আলোচনা হয় অধ্যাপক সায়েদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়কে যুক্ত না করেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে গবেষণায় যুক্ত হতে পারবেন। তিনি কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেন: ক. তিন প্রতিষ্ঠানের বাইরে একজন ব্যক্তিকে প্রধান গবেষক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ওই ব্যক্তি হতে পারেন বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলোজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম; খ. বিএসএমএমইউ হাসপাতাল থেকে রোগীর তথ্য নেওয়া সম্ভব হবে। আইসিডিডিআরবির মাঠের নমুনা সংগ্রহের দক্ষতা বেশি। চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন ভাইরাসের মিউটেশন নিয়ে মৌলিক কাজ করার ক্ষমতা রাখে; গ. ওষুধ কোম্পানির অর্থ নিয়ে গবেষণায় স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয় চলে আসার ঝুঁকি আছে; ঙ. গবেষণা প্রটোকল লিখবে আইসিডিডিআরবি; চ. জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার আগে গবেষণার তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না।

৮ মার্চ আলোচনা হয় সমীর সাহা ও তরুণ অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহার সঙ্গে। তাঁরা বলেন, ক. কাজটি দ্রুত মাঠে নামাতে হবে, খ. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিয়মনীতি মেনে ওষুধ কোম্পানির অর্থে গবেষণায় তাদের নীতিগত সমস্যা নেই, গ. অধ্যাপক সায়েদুর রহমানকে প্রধান গবেষক করা যেতে পারে, ঘ. অন্য করোনাভাইরাস বাংলাদেশের গ্রামে আছে কি না, তা গবেষণা করে দেখার প্রয়োজন আছে।

৯ মার্চ আইসিডিডিআরবিতে কথা হয় তিন গবেষক ও বিজ্ঞানীর সঙ্গে। অধ্যাপক তাহমিদ আহমেদ ছাড়াও আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন টিকাবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফেরদৌসী কাদরী ও জ্যেষ্ঠ পরিচালক শামস-এল-আরেফিন। তাঁরা বলেন, ক. কিছু বিষয়ে তথ্য আছে। বাকি তথ্যের জন্য নতুন গবেষণার দরকার হবে, খ. ওষুধ কোম্পানির অর্থ নিয়ে গবেষণায় কোনো আপত্তি নেই, গ. এত বড় গবেষণার জন্য ৫০ লাখ টাকা প্রয়োজনের তুলনায় কম, ঘ. তিন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের একসঙ্গে বসতে হবে।

কাজের অগ্রগতি আমি নিয়মিত মতি ভাইকে জানাতাম। তিনটি পৃথক মিটিং থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে বিজ্ঞানীরা প্রথম আলোর সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলতে চান। সম্পাদকের সঙ্গে বসার আগে তিন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা নিজেরা সবাই একবার মিলিত হতে চাইলেন। ঠিক হয় ১৬ মার্চ আইসিডিডিআরবিতে বিজ্ঞানীরা একসঙ্গে বসবেন।

শেষ সভা ১৬ মার্চ, ২০২১

ছয়জনের সভাটি হয় আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালকের সম্মেলনকক্ষে। সেঁজুতি সাহা সভায় উপস্থিত থাকতে পারেননি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলাম আমি। আমার ভালো প্রস্তুতি ছিল। শুরুতে আমি গবেষণার পটভূমি, প্রয়োজনীয়তা ও অর্থায়নের কথা স্পষ্ট করে বলতে পেরেছিলাম।

সভায় একাধিক বিজ্ঞানী বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণ কম হয়েছে, এটা বলার সুযোগ কম। সংক্রমণ অনেক বেশি হয়েছে। অ্যান্টিবডি টেস্টে তার প্রমাণ মিলেছে। সরকার তা প্রকাশ করেনি। দেশে করোনায় মৃত্যু কেন কম, সেটাই গবেষণা করে দেখা দরকার। শামস-এল-আরেফিন বলেন, নতুন গবেষণা করতেই হবে।

সভায় ফেরদৌসী কাদরী বলেন, ‘ও +’ রক্তের গ্রুপ যাঁদের, তাঁদের মধ্যে কলেরার প্রকোপ বেশি। রক্তের গ্রুপের সঙ্গে করোনার আক্রান্ত হওয়ার বা তীব্রতার সম্পর্ক থাকতে পারে। তিনি বলেন, কিছু দৈনন্দিন অভ্যাসও হয়তো করোনার ক্ষেত্রে সুরক্ষা দিয়েছে। এ দেশের মানুষের বয়সকাঠামো হয়তো মৃত্যু কম হওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে।

সভায় তাহমিদ আহমেদ বলেন, কিছু সামাজিক উদ্যোগ করোনা সংক্রমণ কম হওয়ার পেছনে কাজ করেছে। করোনা সংক্রমণ কম হওয়ার পেছনে ব্লাড গ্রুপ ও বিসিজি টিকার প্রভাব আছে কি না, তা নিয়ে আইসিডিডিআরবিতে গবেষণা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইতিমধ্যে অনেক গবেষণা হয়েছে, বেশ কিছু গবেষণা চলমান আছে। এসব গবেষণা ফলাফল বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যায় সহায়ক হবে।  

সমীর সাহা বলেন, করোনা সংক্রমিত হওয়া না-হওয়ার সঙ্গে শরীরে ভিটামিন ডির পরিমাণের সম্পর্ক আছে। আবহাওয়ার সঙ্গে কিছু সম্পর্ক আছে। সায়েদুর রহমান বলেন, ওষুধের ব্যবহার কী হয়েছিল, তা জানার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের হাসপাতালের নথি পর্যালোচনা করতে হবে। এ সময়ে কোন কোন ওষুধ বেশি ব্যবহৃত হয়েছিল, তা–ও গবেষণা করে বের করা সম্ভব হবে।

সিদ্ধান্ত হয়

বস্তির ১ হাজার মানুষ ও গ্রামের ১ হাজার মানুষের ওপর গবেষণা হবে। আইসিডিডিআরবি একজন তরুণ বিজ্ঞানীকে দায়িত্ব দেবে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের কাজের সমন্বয় করার জন্য। এ গবেষণাকাজে নেতৃত্ব দেবেন ফেরদৌসী কাদরী। পুরো বিষয়টি চূড়ান্ত হবে প্রথম আলোর সম্পাদকের সঙ্গে বিজ্ঞানীদের সভা হওয়ার পর।
মতি ভাইয়ের সঙ্গে সেই সভা আর হয়নি। দীর্ঘ সময়ের জন্য মতি ভাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর দেখা দেয় করোনার ডেলটা ঢেউ। তখন মৃত্যু বাড়তে থাকে। এরপর আসে অমিক্রন ঢেউ, সংক্রমণ বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে দেশের মানুষকে টিকার আওতায় আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় সরকার।

দেশে এ পর্যন্ত ২০ কোটি ৪৫ হাজার ৯২৩ মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ২৯ হাজার ৪৭৭ জন। দেশে ১৫ কোটির বেশি মানুষ করোনা টিকার প্রথম ডোজ এবং ১৪ কোটির বেশি মানুষ দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছে।

এরপরও অনেকের মনে প্রশ্ন আছে, এই জনবহুল দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু কম থাকার মূল কারণ কী? এ প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি।