অ্যাপেই মেলে পশুপাখির চিকিৎসা 

এ পর্যন্ত প্রায় ৮৯ লাখ পশুপাখিকে চিকিৎসা দিয়েছে বিডিভেটস
ছবি: প্রথম আলো

খামারের বেশ কয়েকটি মোরগ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় দুশ্চিন্তাতেই পড়ে গিয়েছিলেন আবদুল আলিম। জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে তাঁর বাড়ি। আবদুল আলিম বুঝেছিলেন, তাঁর মোরগগুলো রক্ত আমাশয়ে আক্রান্ত। কিন্তু কিছু করার আগেই মারা পড়ে বেশ কয়েকটি মোরগ। এমন সময় পরিচিত একজন তাঁকে ‘বিডিভেটস’–এর খোঁজ দেন। মুঠোফোনে অ্যাপটি ডাউনলোড করে রোগের বর্ণনা লিখে সহায়তা চান আলিম।

অ্যাপের মাধ্যমেই ব্যবস্থাপত্র দেন বগুড়া সদর উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবদুস সামাদ। এটা বছরখানেক আগের কথা। সেবার সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পর থেকে নিয়মিত অ্যাপ ব্যবহার করছেন আবদুল আলিম।

জয়পুরহাট ছাড়াও দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের অনেক খামারিই এভাবে বিডিভেটসের মাধ্যমে তাঁর কাছ থেকে চিকিৎসাসেবা নেন, জানিয়েছেন ভেটেরিনারি চিকিৎসক আবদুস সামাদ।

অ্যাপটির উদ্ভাবক মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মিঠুন সরকার। অ্যাপের সাহায্যে যে কেউ সহজে পশুপাখির চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন।

বাঁচে সময় ও অর্থ। এ জন্য একাধিক সম্মাননাও পেয়েছেন মিঠুন। এই সরকারি কর্মকর্তা জানান, ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় প্রাণিসম্পদ বিভাগে যোগ দেন তিনি। হাওরবেষ্টিত এই উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় পশুপাখির রোগবালাই লেগেই থাকত। যোগাযোগব্যবস্থা খারাপ বলে চিকিৎসা নিতে উপজেলা সদরে আসতে বেগ পেতে হতো খামারিদের। 

এ অবস্থা দেখে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পশুপাখির চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে ভাবতে শুরু করেন মিঠুন। প্রতিদিন অফিসের কাজ শেষে
অনলাইনে ঘাঁটাঘাঁটি করতে থাকেন। পাঁচ বছর পরিশ্রমের পর ২০১৮ সালে প্রথমে ‘বিডিভেটস ডটকম’ (bdvets.com) নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেন। এরপর অ্যাপ তৈরির উদ্যোগ নেন তিনি।

গুগল প্লে স্টোরে এখন বিডিভেটস অ্যাপটি পাওয়া যাচ্ছে। ওয়েবসাইট থেকে জানা গেল, ইন্টারনেট সংযোগ না থাকা অবস্থায়ও অ্যাপটি ব্যবহার করা সম্ভব। পশুপাখির রোগের ধরন লিখে ভিডিও কলের মাধ্যমেও চিকিৎসাসেবা নেওয়া যায়। এই অ্যাপের মাধ্যমে বিনা মূল্যে টিকাদান কর্মসূচিসহ পশুপাখির বিভিন্ন রোগ ও প্রতিকার সম্পর্কে নিয়মিত সচেতনতামূলক বার্তা পাঠানো হয়।

মিঠুন সরকার বলেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক সব সময় থাকেন না। যাঁরা আছেন, তাঁরাও অনেক সময় নানা কাজে মাঠে ব্যস্ত থাকেন। এ সময়ে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কোনো খামারি বা কৃষক অসুস্থ গবাদিপশুর চিকিৎসার জন্য পরামর্শ নিতে এলে চিকিৎসক না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যান। বিডিভেটস অ্যাপ এ সমস্যা দূর করেছে।

অ্যাপটি কেন পরিবেশবান্ধব, তা–ও জানালেন মিঠুন সরকার, একজন চিকিৎসক প্রতিদিন কাগজে ৩০ থেকে ৪০টি ব্যবস্থাপত্র লেখেন। এতে বছরে লাগে ১৪ হাজার টুকরা কাগজ। এ কাগজ তৈরির জন্য প্রয়োজন গাছ। অ্যাপ ব্যবহারের কারণে কাগজে ব্যবস্থাপত্র লিখতে হচ্ছে না। তাই দুটি গাছও কাটা পড়ছে না।

গত ১৫ জুলাই বিকেল পর্যন্ত অ্যাপটির মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রায় সাড়ে তিন হাজার খামারি ও কৃষক সেবা নিয়েছেন। ২৯৩টি উপজেলার ৮৮৫ পশুচিকিৎসক এতে যুক্ত আছেন। ডিজিটাল ব্যবস্থাপত্রের মাধ্যমে এ পর্যন্ত তাঁরা ৮৮ লাখ ৮২ হাজার ৪৭৪টি হাঁস-মুরগি ও ১ হাজার ২০টি গরু, ছাগল ও ভেড়াকে চিকিৎসা দিয়েছেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার সালমা খাতুন ১০ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে গরু পালন করে আসছেন। দু-তিন মাস আগে তাঁর একটি গরু খুরারোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। পরে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে বিডিভেটস সম্পর্কে জানতে পারেন। মুঠোফোনে অ্যাপটি ডাউনলোড করে চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থাপত্র নেন। সালমা খাতুন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অ্যাপটি খুব ভালো। ঘরে বসেই বিনা খরচে সেবা নিয়ে উপকার পেয়েছি।’

২০২১ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে ‘সেরা উদ্ভাবনী’ পুরস্কার পায় বিডিভেটস। প্রাণিসম্পদে বিশেষ অবদান রাখায় একই বছর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে মিঠুন সরকারকে দেওয়া হয় সম্মাননা স্মারক ও সনদ। এ ছাড়া ২০২০ সালে সেরা উদ্ভাবনী পুরস্কার হিসেবে নরসিংদী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় স্মারক।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আইসিটি শাখায় কর্মরত জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শামীম হোসেন বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বিডিভেটস অ্যাপ ও বেরিয়াম ক্লোরাইডের মাধ্যমে পশুর গর্ভ পরীক্ষার দুটি উদ্ভাবনীই সেরা হিসেবে বাছাই করেছিল। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এগুলোর লিংক দেওয়া আছে। উদ্ভাবনী দুটি যেন দেশের মানুষের কাজে লাগে, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

লেখক:প্রথম আলোর জুড়ী প্রতিনিধি