রাজনীতি, অর্থনীতি, অপরাধ, দুর্নীতির মতো ভারী বিষয়গুলো যখন খবরের কাগজের মূল উপজীব্য হয়ে যায়, তখন দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বার্তা থেকে পাঠকেরা বঞ্চিত হন। প্রকৃতির মতো প্রাণশক্তিতে ভরপুর এ দেশের মানুষ। শত প্রতিকূলতার মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তাঁদের। সেই গল্পও জায়গা পায় না জাতীয় সংবাদপত্রের পাতায়। একই কারণে পাঠকেরা বঞ্চিত হন জেলা–উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গর্বের অর্জনের খবর জানতে।

পাঠকদের এই বঞ্চনার অবসান ও বেশি বেশি করে সেসব বিষয় জানাতে এগিয়ে এসেছে প্রথম আলো। ২২তম প্রতিষ্ঠানবার্ষিকীর পর থেকে শুরু হয় আঞ্চলিক ক্রোড়পত্রের যাত্রা। বাংলাদেশের অনেক অর্জনের সঙ্গে প্রথম আলোর নাম যেমন জড়িয়ে গেছে, ঠিক তেমনি পাঠকের কাছে আঞ্চলিক ক্রোড়পত্র পৌঁছে দেওয়া আরেকটি অর্জন। নেতিবাচক খবরের ভিড়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পেয়েছেন পাঠক।

আঞ্চলিক ক্রোড়পত্রের শুরুটা কিন্তু কঠিন সময়ে, করোনা মহামারির মধ্যে, প্রথম ধাপের শেষের দিকে। মানুষের জীবনযাপন যখন এক ভয়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ব্যবসা–বাণিজ্যে প্রায় ধস নেমেছিল। মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। প্রথম দিকে ক্রোড়পত্রের বিষয়গুলো ছিল করোনাকেন্দ্রিক। করোনার ধকল থেকে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প, ব্যবসা–বাণিজ্যে গতি ফেরানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত। শিল্প–সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের স্থবিরতা কীভাবে কাটানো যায়, সে নিয়ে আলোচনা। অর্থাৎ আড়মোড়া ভাঙার চেষ্টার সহযোগী ছিল এসব ক্রোড়পত্রের আধেয়। 

দ্বিতীয় ধাপের ক্রোড়পত্রগুলোর বিষয় ছিল মূলত ব্যবসা–বাণিজ্য ও কৃষিভিত্তিক শিল্পে জেলাগুলোর অবস্থান ও ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে। সঙ্গে ছিল প্রতিটি অঞ্চলের সেরা খাবার, ঐতিহাসিক নিদর্শন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে। তৃতীয় ধাপে ২০২১ সালের মার্চে প্রকাশিত ক্রোড়পত্রগুলোর বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে। নাম ছিল জনপদের যুদ্ধ। স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন যুদ্ধ, গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী স্থান, স্মৃতিস্তম্ভ, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে।

প্রতিটি ক্রোড়পত্র প্রকাশের দিনে বেড়েছে ওই অঞ্চলের প্রচারসংখ্যা। পাঠকপ্রিয়তার সঙ্গে বদলেছে ক্রোড়পত্রের বিষয়বস্তু, জেলা–উপজেলার পাঠাগার, ক্রীড়াঙ্গনের সাফল্য, সম্ভাবনা। বাদ যায়নি স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের মেগা প্রকল্পের প্রভাবও। স্থান পেয়েছে পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ব্যবসা–বাণিজ্য কিংবা ভোলার চরে মহিষ পালনের মতো বিষয়। পর্যটন সম্ভাবনার স্থান নিয়ে ছিল লেখা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও দুটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে, যার বিষয়বস্তু ছিল দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নে পদ্মা সেতুর সুবিধা কাজে লাগাতে কী ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন।

শহরকে জানার উদ্যোগ হিসেবে চলতি বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত শহর সিলেট নামক ক্রোড়পত্রটি ছিল নতুন সংযোজন। ছোটখাটো বাজার থেকে বড় শহরে পরিণত হওয়ার গল্প। ১০০ বছর আগের সিলেট কেমন ছিল—সেটা এ প্রজন্মের অনেক পাঠকের কল্পনায় জগৎকে প্রসারিত করবে। শহর সিলেট নিয়ে প্রবীণ ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণা অনেককে হয়তো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শহর ঘুরে দেখার বিষয়ে আগ্রহী করে তুলবে।

সৃষ্টিশীল পরিকল্পনায় জাতীয় দৈনিকে যুক্ত হওয়া আঞ্চলিক ক্রোড়পত্র চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকা সংবাদপত্রশিল্পকে নতুন করে ভাবতে শেখাবে তিনটি কারণে। বিষয়বৈচিত্র্য, আঞ্চলিক পাঠক ও আঞ্চলিক বিজ্ঞাপন। শুরুটা তো হয়েছে, নিশ্চয়ই আরও নতুন নতুন ধারণা আসবে, সঙ্গে জাগাবে সম্ভাবনা। 

লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, প্রথম আলো